অরুণ কর্মকার
আমাদের সুনসান নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে এক মার্চ এসেছিল ১৯৭১-এ। উন্মাতাল করা উত্তাপ ছিল তার। অনন্য এক বজ্রকণ্ঠের নির্দেশে সে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরে। অন্তর থেকে বাইরে। জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে। এই মাটির প্রতিটি ধূলিকণায়। তারপর সীমানা পেরিয়ে। দূর থেকে দূরান্তে। দেশ থেকে দেশে। পৃথিবীময়।
সেই মার্চে অমিত তেজদীপ্ত বজ্রকণ্ঠের নির্দেশ ছিল, ‘যার যা আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ তারপরই অস্ত্র হাতে দলবদ্ধ তরুণেরা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গ্রামে-গঞ্জে-মফস্বল শহরে ঝাঁকে ঝাঁকে। আমাদের গ্রামীণ জীবনেও আবির্ভাব ঘটেছিল তেমনই একঝাঁক তরুণের। হাতে তাঁদের বেয়নেটখচিত থ্রি নট থ্রি রাইফেল। সাব মেশিন গান। কিছু দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র। বিস্ফোরক। আর অন্তরজুড়ে শত্রুকে মোকাবিলা করার প্রত্যয়।
তারা এসেই আমাদের গ্রামীণ বাজারে বন্দরে আড্ডায় খেলার মাঠে ছড়িয়ে পড়ে। ঘুরে ঘুরে ছেলে-বুড়ো সবার সঙ্গে ভাব জমাতে শুরু করে। কিশোর-তরুণদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ, ভাববিনিময় বেশি নিবিড়। ফলে আমরাও সেই ঝাঁকের মধ্যে মিশে যেতে থাকি। কিন্তু তা নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ দেখি না; বরং আমাদের বাবা-চাচা-বড় ভাই কিংবা প্রতিবেশী মুরব্বিদের মুখেও শোনা যেতে থাকে যুদ্ধের অনিবার্যতার কথা। ছেলে-বুড়ো সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে, চতুর্দিকে এমন কথাও চাউর হয়ে যায়। খুব দ্রুতই কিছু পরিবর্তন ঘটে যেতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পল্টনে যাওয়ার সুবাদে একটি বন্দুকের বৈধ মালিকানা পেয়েছিলেন আমাদের তুজম্বর আলী মীর। মার্চের উত্তাপ সেই প্রৌঢ়কেও ব্যস্ত করে তোলে অস্ত্রটির খোলনলচে পরিষ্কারের কাজে। তারপর প্রতিদিন সকালে-বিকেলে সেই বন্দুক কাঁধে তাঁর আনাগোনা সবার নজর কাড়ে। তাতে সবাই আরও বেশি সাহসী হয়ে ওঠে। মার্চের উত্তাপ সেই একনলা বন্দুকের সামান্য শক্তিকেও জনমানসে অপরিমেয় করে তোলে।
আমরা হাইস্কুলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তত দিনে ইংরেজি র্যাপিড রিডারের ‘ওয়াইজ মেন অব দ্য ওল্ড’ পড়া শেষ করেছি। কিন্তু সক্রেটিসের দার্শনিক উক্তি ‘নো দাইসেল্ফ’-এর ঘোর তখনো কাটেনি। ইংরেজির শিক্ষক সুধাংশু বাবু আবার ওই উক্তির সঙ্গে ফকির লালন সাঁই আর রবীন্দ্রনাথকে যুক্ত করে সেই ঘোরকে ঘোরতর করে তোলেন। লালন ফকিরও তো বলেছেন, ‘আপনারে চিনতে পারলে রে, যাবে অচেনারে চেনা...’। একই কথা রবীন্দ্রনাথেরও, ‘আপনারে জানা আমার ফুরাবে না...’। কী আশ্চর্য দার্শনিক যোগসূত্র! প্রাচীন গ্রিস থেকে বাংলার লালন ফকির হয়ে রবীন্দ্রনাথ! ঘোর লাগার কথাই বটে।
কিন্তু সন্ধ্যার মশাল মিছিল সেই ঘোর কাটিয়ে আমাদের নিয়ে যায় ভিন্ন এক জগতে। সেই মিছিলে আমাদের কণ্ঠ উচ্চকিত হয় ‘ইয়াহিয়ার ক্যান্টনমেন্ট জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’ স্লোগানে। কিন্তু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ক্যান্টনমেন্ট নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব আছে বলে আমাদের জানা ছিল না। মিছিল শেষে তাই ক্যান্টনমেন্ট বিষয়টি কী, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়। কিন্তু তাতেও স্পষ্ট কোনো ধারণা মেলে না। তবে সেই মার্চ সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ আমাদের মনের গভীরে যে দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম দেয় তাতে ইয়াহিয়ার ক্যান্টনমেন্ট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে না দেওয়া পর্যন্ত যে থামা যাবে না, তা অনুধাবন করে নিজেরাই বিস্মিত হই।
মার্চের দিনগুলো যতই গড়িয়ে যেতে থাকে, পরিস্থিতির পরিবর্তনও ততই প্রকট হয়ে ওঠে। শহরে থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আমাদের অগ্রজেরা একে একে চলে আসেন গ্রামে। নিয়ে আসেন অনিবার্য যুদ্ধের বার্তা। তাঁদেরও সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য তাড়াহুড়া দেখি। তাতে আমাদের মনে হয় যেন যুদ্ধের মাঠে নামতে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন তাঁরা। তবে তাঁদের পথ দেখি ভিন্নতর। সে পথে আসন্ন যুদ্ধে শত্রু শুধু পাকিস্তানিরা। তাদের বিরুদ্ধে সব বাঙালি একপক্ষে ঐক্যবদ্ধ। এটা ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। এই পর্বে কোনো শ্রেণিশত্রু নেই।
আমরা তখনো এসব কথার তাৎপর্য বুঝি না। রাজনীতি বোঝার বয়সও আমাদের নয়। তবে শত্রু যে পাকিস্তান, আর তাদের বিরুদ্ধে সব বাঙালি যে এককাট্টা, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তা সত্ত্বেও আমাদের কয়েকজনের গাঁটছড়া বাঁধা পড়ে শ্রেণিশত্রু তত্ত্বে বিশ্বাসী সশস্ত্র তরুণ দলের সঙ্গে। সে অনেকটা পরিস্থিতির ফেরেও বটে।
তত দিনে ২৫ মার্চ কালরাতে ঘটনা ঘটে গেছে। পাকিস্তানি হানাদারেরা একের পর এক শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের চিরচেনা অগ্রজের দল তখন উধাও। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। পরে খবর পাওয়া গেল তাঁরা সব মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। শশাঙ্ক পাল, সাত্তার ভাইসহ কয়েকজন দেশের মধ্যেই তাঁদের সমমনা দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। অন্যরা সব ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেবেন। আমরা তখন কিছুটা অসহায় বোধ করি। মনে মনে আমরা বোধ হয় চাইছিলাম তাঁদের সঙ্গে যেতে।
এরই মধ্যে একদিন আমাদের নিকটতম শহর ঝালকাঠিতে হানা দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। প্রথম দিন বেলা শেষে গানবোটে এসে শহরে এলোপাতাড়ি শেল ছুড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বার্মা ইস্টার্নের তেলের ডিপোতে শেল ছুড়ে আগুন লাগায়। ভীতসন্ত্রস্ত দিশেহারা শহরবাসী তখন আশপাশের গ্রামাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অবিরাম লাইন ধরে, হাজার হাজার। শুরু হয় তাঁদের উদ্বাস্তু শরণার্থী জীবন। আমাদের গ্রাম কীর্তিপাশার দিকেও স্রোতের মতো আসতে থাকে মানুষের ঢল। পথে গোবিন্দধবল গ্রামের একদল দুষ্কৃতকারী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জিনিসপত্র লুট করতে শুরু করে।
আমরা তখন গ্রামের বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে ঝালকাঠি শহরের লেলিহান অগ্নিশিখা দেখছি। দেখছি গ্রামের প্রান্তে এসে পৌঁছানো শহরবাসী মানুষের ঢল। তাঁদের কাছেই খবর পাওয়া যায় পথে লুটপাটের। আমাদের সশস্ত্র তরুণ দলের কাছেও পৌঁছে যায় সে খবর। সঙ্গে সঙ্গে তারা রওনা দেয় ঘটনাস্থলের দিকে। আমরাও পিছু নিই। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছেই তারা গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমরা অবাক হয়ে দেখি। সেই আমাদের প্রথম রাইফেলের গুলি ছুড়তে দেখা।
গুলির শব্দে মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা স্তব্ধ হয়ে যায়। পরক্ষণেই শরণার্থীর ঢল, লুটেরানির্বিশেষে সবাই রাস্তার পাশের বাড়ি, খেত-খামারের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে থাকে। তখন গুলি থেমে যায়। হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা আসে, ‘ভয় নাই। আমরা মুক্তিবাহিনী। আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি।’ মুহূর্তেই আমরাও মুক্তিবাহিনীর অংশ হয়ে যাই। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। বুকের বল অসীম, অপরিমেয় বলে মনে হয়।
মাইকের ঘোষণা শুনে শরণার্থীর দল আবার রাস্তায় উঠে আসতে শুরু করে। আর লুটেরার দল কী ভেবে যেন সেই মুক্তিবাহিনীর দলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এগিয়ে আসে ঢাল-সড়কি নিয়ে। মুক্তিবাহিনী তখন আরও কয়েকটি গুলি ছোড়ে এবং ধাওয়া করে সরদারসহ লুটেরাদের কয়েকজনকে ধরে ফেলে। তাদের হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে আসা হয়। সেই বাঁধা অবস্থায়ই শিরশ্ছেদ করার ভঙ্গিতে লুটেরাদের বসানো হয় স্কুলের মাঠে। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের সামনে। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। আমাদেরও সেখান থেকে চলে যেতে বলা হয়।
পরদিন আমাদের জানানো হয়, আমরা চলে যাওয়ার পর সেখানে আদালত বসিয়ে লুটেরাদের বিচার করা হয়। বিচারে তাদের গণশত্রু হিসেবে অভিযুক্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। রাতেই সেই দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। গলা কেটে হত্যা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর আমাদের চেনাজানা তখনকার খুব ছোট্ট পরিসরে সেই প্রথম শত্রু নিধন। ওই ঘটনা আমাদের আরও উদ্দীপিত করে। আমরা আরও সাহসী হয়ে উঠি। শত্রুর সঙ্গে আমাদের করণীয় ঠিকঠাক বুঝে নিই।
ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনী এলাকার সর্বস্তরের মানুষের ভরসাস্থল হয়ে ওঠে। তাদের প্রতি মানুষের সম্মান ভালোবাসা বেড়ে যায়। এলাকায় প্রশান্তির ছায়া নেমে আসে। কিন্তু এর কয়েক দিন পরেই পরিস্থিতির উল্টো যাত্রা শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী ঝালকাঠিতে স্থায়ী ক্যাম্প বসায়। সেই ক্যাম্পে যোগাযোগ করতে শুরু করে নানা শ্রেণির অপরাধী ও দালালের দল। খবর পেয়ে গোবিন্দধবলের লুটেরাদের কয়েকজনও সেখানে গিয়ে সেদিনের ঘটনা জানায় সরাসরি মেজরের কাছে। কীর্তিপাশা ও এর আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি গাড়ার খবরও তারা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করে। শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর কীর্তিপাশা অপারেশনের প্রস্তুতি।
মুক্তিবাহিনীর কাছেও এ খবর চলে আসে। সিদ্ধান্ত হয় কীর্তিপাশার ক্যাম্প তিন কিলোমিটার উত্তরে পেয়ারাবাগান এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার। তাৎক্ষণিকভাবে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। আমাদের কয়েকজনকে করণীয় সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়ে সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর দল কীর্তিপাশা ছেড়ে উত্তরে যাত্রা করে। আশপাশের আরও কয়েকটি এলাকা থেকেও সশস্ত্র যোদ্ধারা জড়ো হতে থাকে পেয়ারাবাগানে।
প্রাথমিকভাবে তারা পেয়ারাবাগান ঘেরা ভীমরুলী ও শতদশকাঠিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারপরই পেয়ারবাগানকে ঢাল (হাইড) হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করে। আসলে পেয়ারাবাগানকে ঘিরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এই দলের যুদ্ধ করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়। ওই এলাকায় গিয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশল ও খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করা হয়।
শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বহুল আলোচিত পেয়ারাবাগানের যুদ্ধের প্রস্তুতি। তার কেন্দ্রস্থলে ছিল সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর একটি দল। আর তাদের ঘিরে তথ্য ও রসদ সরবরাহের জন্য ছিলাম আমরা অনেকে।
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
আমাদের সুনসান নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে এক মার্চ এসেছিল ১৯৭১-এ। উন্মাতাল করা উত্তাপ ছিল তার। অনন্য এক বজ্রকণ্ঠের নির্দেশে সে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরে। অন্তর থেকে বাইরে। জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে। এই মাটির প্রতিটি ধূলিকণায়। তারপর সীমানা পেরিয়ে। দূর থেকে দূরান্তে। দেশ থেকে দেশে। পৃথিবীময়।
সেই মার্চে অমিত তেজদীপ্ত বজ্রকণ্ঠের নির্দেশ ছিল, ‘যার যা আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ তারপরই অস্ত্র হাতে দলবদ্ধ তরুণেরা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গ্রামে-গঞ্জে-মফস্বল শহরে ঝাঁকে ঝাঁকে। আমাদের গ্রামীণ জীবনেও আবির্ভাব ঘটেছিল তেমনই একঝাঁক তরুণের। হাতে তাঁদের বেয়নেটখচিত থ্রি নট থ্রি রাইফেল। সাব মেশিন গান। কিছু দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র। বিস্ফোরক। আর অন্তরজুড়ে শত্রুকে মোকাবিলা করার প্রত্যয়।
তারা এসেই আমাদের গ্রামীণ বাজারে বন্দরে আড্ডায় খেলার মাঠে ছড়িয়ে পড়ে। ঘুরে ঘুরে ছেলে-বুড়ো সবার সঙ্গে ভাব জমাতে শুরু করে। কিশোর-তরুণদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ, ভাববিনিময় বেশি নিবিড়। ফলে আমরাও সেই ঝাঁকের মধ্যে মিশে যেতে থাকি। কিন্তু তা নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ দেখি না; বরং আমাদের বাবা-চাচা-বড় ভাই কিংবা প্রতিবেশী মুরব্বিদের মুখেও শোনা যেতে থাকে যুদ্ধের অনিবার্যতার কথা। ছেলে-বুড়ো সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে, চতুর্দিকে এমন কথাও চাউর হয়ে যায়। খুব দ্রুতই কিছু পরিবর্তন ঘটে যেতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পল্টনে যাওয়ার সুবাদে একটি বন্দুকের বৈধ মালিকানা পেয়েছিলেন আমাদের তুজম্বর আলী মীর। মার্চের উত্তাপ সেই প্রৌঢ়কেও ব্যস্ত করে তোলে অস্ত্রটির খোলনলচে পরিষ্কারের কাজে। তারপর প্রতিদিন সকালে-বিকেলে সেই বন্দুক কাঁধে তাঁর আনাগোনা সবার নজর কাড়ে। তাতে সবাই আরও বেশি সাহসী হয়ে ওঠে। মার্চের উত্তাপ সেই একনলা বন্দুকের সামান্য শক্তিকেও জনমানসে অপরিমেয় করে তোলে।
আমরা হাইস্কুলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তত দিনে ইংরেজি র্যাপিড রিডারের ‘ওয়াইজ মেন অব দ্য ওল্ড’ পড়া শেষ করেছি। কিন্তু সক্রেটিসের দার্শনিক উক্তি ‘নো দাইসেল্ফ’-এর ঘোর তখনো কাটেনি। ইংরেজির শিক্ষক সুধাংশু বাবু আবার ওই উক্তির সঙ্গে ফকির লালন সাঁই আর রবীন্দ্রনাথকে যুক্ত করে সেই ঘোরকে ঘোরতর করে তোলেন। লালন ফকিরও তো বলেছেন, ‘আপনারে চিনতে পারলে রে, যাবে অচেনারে চেনা...’। একই কথা রবীন্দ্রনাথেরও, ‘আপনারে জানা আমার ফুরাবে না...’। কী আশ্চর্য দার্শনিক যোগসূত্র! প্রাচীন গ্রিস থেকে বাংলার লালন ফকির হয়ে রবীন্দ্রনাথ! ঘোর লাগার কথাই বটে।
কিন্তু সন্ধ্যার মশাল মিছিল সেই ঘোর কাটিয়ে আমাদের নিয়ে যায় ভিন্ন এক জগতে। সেই মিছিলে আমাদের কণ্ঠ উচ্চকিত হয় ‘ইয়াহিয়ার ক্যান্টনমেন্ট জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’ স্লোগানে। কিন্তু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ক্যান্টনমেন্ট নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব আছে বলে আমাদের জানা ছিল না। মিছিল শেষে তাই ক্যান্টনমেন্ট বিষয়টি কী, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়। কিন্তু তাতেও স্পষ্ট কোনো ধারণা মেলে না। তবে সেই মার্চ সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ আমাদের মনের গভীরে যে দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম দেয় তাতে ইয়াহিয়ার ক্যান্টনমেন্ট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে না দেওয়া পর্যন্ত যে থামা যাবে না, তা অনুধাবন করে নিজেরাই বিস্মিত হই।
মার্চের দিনগুলো যতই গড়িয়ে যেতে থাকে, পরিস্থিতির পরিবর্তনও ততই প্রকট হয়ে ওঠে। শহরে থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আমাদের অগ্রজেরা একে একে চলে আসেন গ্রামে। নিয়ে আসেন অনিবার্য যুদ্ধের বার্তা। তাঁদেরও সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য তাড়াহুড়া দেখি। তাতে আমাদের মনে হয় যেন যুদ্ধের মাঠে নামতে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন তাঁরা। তবে তাঁদের পথ দেখি ভিন্নতর। সে পথে আসন্ন যুদ্ধে শত্রু শুধু পাকিস্তানিরা। তাদের বিরুদ্ধে সব বাঙালি একপক্ষে ঐক্যবদ্ধ। এটা ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। এই পর্বে কোনো শ্রেণিশত্রু নেই।
আমরা তখনো এসব কথার তাৎপর্য বুঝি না। রাজনীতি বোঝার বয়সও আমাদের নয়। তবে শত্রু যে পাকিস্তান, আর তাদের বিরুদ্ধে সব বাঙালি যে এককাট্টা, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তা সত্ত্বেও আমাদের কয়েকজনের গাঁটছড়া বাঁধা পড়ে শ্রেণিশত্রু তত্ত্বে বিশ্বাসী সশস্ত্র তরুণ দলের সঙ্গে। সে অনেকটা পরিস্থিতির ফেরেও বটে।
তত দিনে ২৫ মার্চ কালরাতে ঘটনা ঘটে গেছে। পাকিস্তানি হানাদারেরা একের পর এক শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের চিরচেনা অগ্রজের দল তখন উধাও। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। পরে খবর পাওয়া গেল তাঁরা সব মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। শশাঙ্ক পাল, সাত্তার ভাইসহ কয়েকজন দেশের মধ্যেই তাঁদের সমমনা দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। অন্যরা সব ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেবেন। আমরা তখন কিছুটা অসহায় বোধ করি। মনে মনে আমরা বোধ হয় চাইছিলাম তাঁদের সঙ্গে যেতে।
এরই মধ্যে একদিন আমাদের নিকটতম শহর ঝালকাঠিতে হানা দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। প্রথম দিন বেলা শেষে গানবোটে এসে শহরে এলোপাতাড়ি শেল ছুড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বার্মা ইস্টার্নের তেলের ডিপোতে শেল ছুড়ে আগুন লাগায়। ভীতসন্ত্রস্ত দিশেহারা শহরবাসী তখন আশপাশের গ্রামাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অবিরাম লাইন ধরে, হাজার হাজার। শুরু হয় তাঁদের উদ্বাস্তু শরণার্থী জীবন। আমাদের গ্রাম কীর্তিপাশার দিকেও স্রোতের মতো আসতে থাকে মানুষের ঢল। পথে গোবিন্দধবল গ্রামের একদল দুষ্কৃতকারী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জিনিসপত্র লুট করতে শুরু করে।
আমরা তখন গ্রামের বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে ঝালকাঠি শহরের লেলিহান অগ্নিশিখা দেখছি। দেখছি গ্রামের প্রান্তে এসে পৌঁছানো শহরবাসী মানুষের ঢল। তাঁদের কাছেই খবর পাওয়া যায় পথে লুটপাটের। আমাদের সশস্ত্র তরুণ দলের কাছেও পৌঁছে যায় সে খবর। সঙ্গে সঙ্গে তারা রওনা দেয় ঘটনাস্থলের দিকে। আমরাও পিছু নিই। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছেই তারা গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমরা অবাক হয়ে দেখি। সেই আমাদের প্রথম রাইফেলের গুলি ছুড়তে দেখা।
গুলির শব্দে মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা স্তব্ধ হয়ে যায়। পরক্ষণেই শরণার্থীর ঢল, লুটেরানির্বিশেষে সবাই রাস্তার পাশের বাড়ি, খেত-খামারের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে থাকে। তখন গুলি থেমে যায়। হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা আসে, ‘ভয় নাই। আমরা মুক্তিবাহিনী। আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি।’ মুহূর্তেই আমরাও মুক্তিবাহিনীর অংশ হয়ে যাই। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। বুকের বল অসীম, অপরিমেয় বলে মনে হয়।
মাইকের ঘোষণা শুনে শরণার্থীর দল আবার রাস্তায় উঠে আসতে শুরু করে। আর লুটেরার দল কী ভেবে যেন সেই মুক্তিবাহিনীর দলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এগিয়ে আসে ঢাল-সড়কি নিয়ে। মুক্তিবাহিনী তখন আরও কয়েকটি গুলি ছোড়ে এবং ধাওয়া করে সরদারসহ লুটেরাদের কয়েকজনকে ধরে ফেলে। তাদের হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে আসা হয়। সেই বাঁধা অবস্থায়ই শিরশ্ছেদ করার ভঙ্গিতে লুটেরাদের বসানো হয় স্কুলের মাঠে। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের সামনে। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। আমাদেরও সেখান থেকে চলে যেতে বলা হয়।
পরদিন আমাদের জানানো হয়, আমরা চলে যাওয়ার পর সেখানে আদালত বসিয়ে লুটেরাদের বিচার করা হয়। বিচারে তাদের গণশত্রু হিসেবে অভিযুক্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। রাতেই সেই দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। গলা কেটে হত্যা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর আমাদের চেনাজানা তখনকার খুব ছোট্ট পরিসরে সেই প্রথম শত্রু নিধন। ওই ঘটনা আমাদের আরও উদ্দীপিত করে। আমরা আরও সাহসী হয়ে উঠি। শত্রুর সঙ্গে আমাদের করণীয় ঠিকঠাক বুঝে নিই।
ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনী এলাকার সর্বস্তরের মানুষের ভরসাস্থল হয়ে ওঠে। তাদের প্রতি মানুষের সম্মান ভালোবাসা বেড়ে যায়। এলাকায় প্রশান্তির ছায়া নেমে আসে। কিন্তু এর কয়েক দিন পরেই পরিস্থিতির উল্টো যাত্রা শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী ঝালকাঠিতে স্থায়ী ক্যাম্প বসায়। সেই ক্যাম্পে যোগাযোগ করতে শুরু করে নানা শ্রেণির অপরাধী ও দালালের দল। খবর পেয়ে গোবিন্দধবলের লুটেরাদের কয়েকজনও সেখানে গিয়ে সেদিনের ঘটনা জানায় সরাসরি মেজরের কাছে। কীর্তিপাশা ও এর আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি গাড়ার খবরও তারা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করে। শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর কীর্তিপাশা অপারেশনের প্রস্তুতি।
মুক্তিবাহিনীর কাছেও এ খবর চলে আসে। সিদ্ধান্ত হয় কীর্তিপাশার ক্যাম্প তিন কিলোমিটার উত্তরে পেয়ারাবাগান এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার। তাৎক্ষণিকভাবে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। আমাদের কয়েকজনকে করণীয় সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়ে সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর দল কীর্তিপাশা ছেড়ে উত্তরে যাত্রা করে। আশপাশের আরও কয়েকটি এলাকা থেকেও সশস্ত্র যোদ্ধারা জড়ো হতে থাকে পেয়ারাবাগানে।
প্রাথমিকভাবে তারা পেয়ারাবাগান ঘেরা ভীমরুলী ও শতদশকাঠিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারপরই পেয়ারবাগানকে ঢাল (হাইড) হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করে। আসলে পেয়ারাবাগানকে ঘিরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এই দলের যুদ্ধ করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়। ওই এলাকায় গিয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশল ও খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করা হয়।
শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বহুল আলোচিত পেয়ারাবাগানের যুদ্ধের প্রস্তুতি। তার কেন্দ্রস্থলে ছিল সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর একটি দল। আর তাদের ঘিরে তথ্য ও রসদ সরবরাহের জন্য ছিলাম আমরা অনেকে।
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে