সেই ঈদ এই ঈদ

সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮: ৪০
আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৩: ১৩

অলস সময়ে আগে আমরা বই পড়তাম, টিভি দেখতাম, রেডিও শুনতাম, বাড়ির ছাদে কিংবা ফটকে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। আর এখন আমরা ‘ফেসবুকিং’ করি! ‘জেনারেশন জেড’ বা ‘জেন জি’ নামে যারা পরিচিত, তারা আবার ফেসবুক-টেসবুক বেশি চালায় না। বেশি চালায় ইনস্টাগ্রাম, সংক্ষেপে তারা বলে ‘ইনস্ট’। যাকগে, সবই তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। নাহ্, ফেসবুক-ইনস্টর কথা বলব না, সামনে ঈদ তো, ঈদের কথা বলাই বরং শ্রেয়। তবে ভূমিকায় এসবের কথা বলার কারণ আছে পরের কথায়। 

২. সেদিন অনর্থক ফোন গুঁতোগুঁতি করছিলাম। এই ফেসবুকিং আরকি! হঠাৎ সামনে এল একটা আবেগঘন ভিডিও। ছোট একটা বাচ্চা ছেলে রাস্তায় হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে। তার বাবা ঘরছাড়া, তাদের খেয়াল রাখে না। তার মায়ের বিয়ে হয়েছে অন্য কোথাও। সে থাকতে পারে না মায়ের কাছেও। যে দাদির কাছে থাকত, সেই দাদিও মারা গেছে। দাদির জন্য সে কুলখানি করবে। তাই কামাই রোজগারে নেমেছে। কাজ নিয়েছে হাওয়াই মিঠাই বিক্রির। মহাজনের বাড়িতেই আপাতত আশ্রয় হয়েছে তার। খানাপিনার বন্দোবস্ত সে বাড়িতেই। ভিডিও ধারণকারী তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তার ঈদের জামা কেনা হয়েছে কি না। তার জবাব ছিল, শুধু দাদির কুলখানির জন্যই সে টাকা জমাচ্ছে, ঈদের কাপড় কেনা হয়নি। তার কাছে তো এত টাকা নেই। সেই ভিডিওর মন্তব্যগুলো পড়ে বোঝা গেল অনেকেই ছেলেটাকে সাহায্য করতে চাইছে। হয়তো এর মধ্যে করেও ফেলেছেন কেউ কেউ। মানুষের এমন আচরণে মন ভালো হয়ে যায়।

৩. অথচ পরদিনই পড়লাম একটা মন খারাপ করা খবর। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে তাকে ‘মার্কেট’ থেকে ঈদের জামা না কিনে দেওয়ায়। বাড়িতে আসা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে মা ঈদের কাপড় কিনে দেওয়ায় অভিমান করেছে মেয়েটি। হয়তো তার মায়ের ওইটুকুই সামর্থ্য। আহা, সে যদি জানত আরেকটি শিশুকে ঈদের কাপড় কিনে দেওয়ার মতো আপন বলে কেউ নেই, সে হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে দাদির কুলখানির জন্য, নিজের প্রয়োজন মেটানো তার কাছে মুখ্য নয়! 

৪. আরও একটা সংবাদ ক্লিপ দেখলাম। উঁহু, টিভিতে নয়, ফেসবুকে! মার্কেটের উপচে পড়া ভিড়ে কার কত বাজেট আছে কেনাকাটায়, সেই প্রশ্ন জনে জনে করছেন সাংবাদিক। ৫০০ থেকে শুরু করে লাখ টাকার বেশি বাজেটধারীদের পাওয়া গেল ঈদের বাজারে। তালিকায় আছেন একটা কাপড় কেনার সামর্থ্যবান, একাধিক কাপড় কেনার সামর্থ্যবান লোকজন। একজন বললেন, ‘ইচ্ছা আছে আরেকটা জামা কেনার, আম্মু যদি দেয়...।’ 

৫. এসব দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা। ঈদের বাজার বলতে কী বোঝায় তা জানা ছিল না। আমি নিশ্চিত, আপনারা অনেকেই আমার দলভুক্ত। মনে পড়ে, মা-বাবা একটি জামা আর এক জোড়া জুতা কিনে আনতেন। ‘মার্কেট’ জিনিসটার সঙ্গে পরিচিত হতে বহু সময় লেগেছে। কখনোই মা-বাবার দেওয়া জামাকাপড় অপছন্দ হয়নি। ঈদের নতুন জামা মানেই সে কী আনন্দ! কখনো কখনো রোজার ঈদের জামা-জুতা দিয়েই কোরবানির ঈদ পার করে দিতাম আমরা। এক দিন পরলেই কি সেই জামা-জুতা পুরোনো হয়ে যায়? মোটেই না। জুতা জোড়া তো না ছেঁড়া অবধি নতুন জোড়া বাড়িতে ঢুকতই না। অথচ এসবই আমাদের আনন্দ ছিল—শুধু ঈদের নয়, সারা বছরের। 

৬. প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলত ঈদের কাপড় লুকিয়ে রাখার। ঈদের দিন নতুন জামা পরা হলে তো সবাই দেখবে। এর আগে কিছুতেই কাউকে সে জামা দেখানো যাবে না। জুতার বেলায়ও একই নিয়ম। সবাই ঠাট্টা করে বলত, ঈদের জামা দেখে ফেললে নাকি পুরোনো হয়ে যায়। কিন্তু কোরবানির ঈদেও যে সেই ‘পুরোনো’ জামা-জুতা পরতে হবে, সে কথা তত দিনে ভুলে যেতাম আমরা।তখন হতো কোরবানির পশু দেখার হুলুস্থুল। আর কার ঈদের জামা-জুতা দামি, কারটা কম দামি, কারটা সুন্দর, কারটা অসুন্দর—এসব প্রশ্ন আমাদের শিশুমনে জায়গা পেত না। ঈদের আগ পর্যন্ত সব কেনাকাটার জিনিসপত্তর লুকিয়ে রাখা আর ঈদের দিন দেখানোতেই ছিল নির্মল আনন্দ। 

৭. ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের যুগে বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোরেরাও এত বেশি ‘অপশন’ খুঁজে পাচ্ছে যে তাদের অনেক কিছুই ‘চাই, চাই-ই চাই’। না পেলে অভিমান আর মন খারাপের খাতা খুলে বসে। শিশুরা তো বটেই, বড়রাও বাদ যান না। পোশাক ও অনুষঙ্গ কেনার জন্য ঈদ, পূজা, বড়দিন, বসন্ত, বৈশাখের উৎসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলোও—মাতৃভাষা দিবস, ভালোবাসা দিবস, বিজয় দিবস—আর কিছু বাদ গেল কি?

৮. ছোট-বড় সবাই এখন সব উৎসব-পার্বণে পোশাক আর রেস্তোরাঁয় খাওয়ার পেছনে সময় ব্যয় করে। আর আমরা সারা বছর উৎসব করতাম একটু ঠাকুরমার ঝুলি কিংবা তিন গোয়েন্দা পড়ে, একটু ক্যাসেটের ফিতা টেনে লতা মঙ্গেশকরের গান শুনে, একটু রেডিওর বোতাম ঘুরিয়ে, একটু টেলিভিশনের অ্যানটেনা ঘুরিয়ে, একটু ‘মুভি অব দ্য উইক’ দেখে, একটু সিন্দাবাদ, হারকিউলিস, রবিন হুড, ম্যাকগাইভার, আলিফ লায়লা, এক্স ফাইলস, ইত্যাদি, মীনা, টম অ্যান্ড জেরি, পাপাই, হ‌ুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখে। এখনকার মতো ফেসবুক-টেসবুক দেখতাম নাকি? ছিলই তো না এসব! এখনো তাজা সেই সব স্মৃতি—চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোনেরা যখন ঈদের ছুটিতে দাদাবাড়ির উঠানটা কাঁপিয়ে বেড়াতাম। অথচ সেই সব আনন্দ আজও ছাপিয়ে যেতে পারেনি এখনকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। ভাইবোনদের মেসেঞ্জার গ্রুপ হয়, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ হয়। সেই সব গ্রুপে কাজের ফাঁকে ছোট একটা বার্তা ‘ঈদ মোবারক’ লিখেই যেন ঈদ হয়ে যায়। দাদাবাড়ির উঠান কাঁপানো হয় না। তবে শৈশবের ঈদের ছুটিগুলোর কথা মনে করে আমরা প্রত্যেকেই নস্টালজিয়ায় ভুগি। ভুগি না? কারণ সেই সব ঈদ আনন্দই ছিল সত্যিকারের, আর সেরা। 

৯. ঘুরেফিরে কমলগঞ্জের ওই কিশোরীর কথা মনে পড়ে যায়। তার মায়ের যে এবার ঈদ হবে না, তা তো নিশ্চিত। এমন যেন আর কোনো পরিবারে না হয়, তাই সতর্ক থাকতে হবে শিশু-কিশোরদের লালন-পালনে। বুঝতে হবে ওদের মন। বোঝাতে হবে ওদের। পরিবার থেকে যদি শিশুদের বোঝানো যায় যে বড়দের কেমন সামর্থ্য আছে, শিশুরা নিশ্চয়ই সে অনুযায়ীই আবদার করবে, অভিমান করবে না। আর অভিমান থেকে কোনো অঘটনও ঘটবে না। এই হালটা আমাদের বড়দেরই তো ধরতে হবে, নাকি? এটুকু পরামর্শ দিতে নিশ্চয়ই কোনো মনোবিজ্ঞানী হওয়া লাগে না।

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত