শ্রমিকের মামলা ঝোলে বছরের পর বছর

অর্চি হক, ঢাকা
আপডেট : ০১ মে ২০২৩, ০৮: ৪৮
Thumbnail image

একটি তামাক কোম্পানিতে কাজ করতেন মোখলেছুর রহমান গাজী। চাকরির শর্ত অনুযায়ী স্থায়ীকরণ চেয়ে না পেয়ে ২০১৩ সালে শ্রম আদালতের দ্বারস্থ হন। এরপর কেটে যায় সাড়ে ৯ বছর। রায় না হওয়ায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মামলাটি প্রত্যাহার করে নেন তিনি। তাঁর আইনজীবী শারমিন সুলতানা মৌসুমী আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতিকার না পেয়ে মোখলেছুর হতাশ হয়ে পড়েন। লড়াই করার আগ্রহ হারিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে নেন।

নিজের অধিকার ও ন্যায্য পাওনা পেতে এবং অন্যায়ের প্রতিকারের আশায় মোখলেছুরের মতো অসংখ্য শ্রমিক মামলা করেন শ্রম আদালতে। আইনে ১৫০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির কথা থাকলেও বছরের পর বছর মামলা ঝুলতে থাকে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১০টি শ্রম আদালতে ২৫ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। শ্রমিক অধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, মামলার তুলনায় আদালতের সংখ্যা কম হওয়া, জনবল সংকট ও আইনের দুর্বলতার কারণে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। এতে বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।

মামলা করে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক নাজমুল শেখও। তিনি রাজধানীর মালিবাগের একটি সোয়েটার কারখানায় ২০০০ সাল থেকে চাকরি করতেন। ২০১৮ সালে পাওনা না মিটিয়ে বিনা নোটিশে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তিনি ঢাকার শ্রম আদালতে মামলা করেন। তবে এখনো ওই মামলার রায় হয়নি। চাকরি হারানোর পর তিন মাস বেকার থেকে চাকরি নেন ময়মনসিংহের একটি পোশাক কারখানায়। সেখানে শ্রমিকদের

বেতন-বোনাস নিয়ম অনুযায়ী দেওয়া হতো না। আজকের পত্রিকাকে নাজমুল বলেন, ‘১৮ বছর এক জায়গায় কাজ করার পরও চাকরি হারাইলাম। কোনো টাকা পাইলাম না। মামলা করলেও রায় হয় নাই। পরে যেখানে কাজ নিলাম, সেইখানেও অন্যায়। কিন্তু আর মামলায় যাই নাই। নিজের খরচই চালাইবার পারি না। মামলার খরচ চালামু কেমনে।’

শ্রমিক অধিকার কর্মীরা বলছেন, মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে শ্রমিকেরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। দেশে কোনো আইন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ছাড়া আইনে যতটুকু বলা আছে, সেটাও শ্রমিকেরা পাচ্ছেন না।

এমন বাস্তবতায় আজ ১ মে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রম অধিকার আদায়ের এ দিন মহান মে দিবস হিসেবেও পরিচিত।

শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আইনে ১৫০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির কথা বলা আছে। কিন্তু এ সময়ে মামলা নিষ্পত্তি না হলে কী হবে, সে ব্যাপারে কিছু বলা নেই। তাই বছরের পর বছর শ্রমিকদের আদালতে ঘুরতে হয়। এই সংকট কাটাতে দেশে শ্রম আদালতের সংখ্যা বাড়ানো, আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং নির্দিষ্ট সময়ে মামলা নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা থাকা প্রয়োজন।

মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণ হিসেবে লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শারমিন সুলতানা মৌসুমী বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাদী আসছেন, কিন্তু বিবাদীপক্ষ দিনের পর দিন অনুপস্থিত। শ্রম আদালতগুলোতে প্রসেস সার্ভেয়ারদের সংকট রয়েছে। সমন রেজিস্ট্রি ডাকযোগে বিবাদীপক্ষকে পাঠানো হয়। দেখা যায়, বহুদিন পর বিবাদীপক্ষ এসে বলেন তাঁরা সমন পাননি। তখন আবার নতুন করে সব শুরু হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্না বলেন, শ্রম আদালতে বিচারকদের বদলি করা হলে অনেকেই এটাকে শাস্তি (পানিশমেন্ট পোস্টিং) হিসেবে দেখেন। বিচারকেরা সম্ভবত এখানে কাজ করতে আগ্রহী হন না। সম্ভবত এটাও মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার একটা কারণ। তিনি মনে করেন, শ্রমিকসংশ্লিষ্ট সব আইন করা হয়েছে মালিকদের স্বার্থ বিবেচনায় রেখে। তিনি বলেন, শিল্প পুলিশও মালিকপক্ষের স্বার্থ রক্ষায় করা হয়েছে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত