বরুণের রাজসিক সৌন্দর্য

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৩, ০৮: ৪৮
আপডেট : ০৩ মে ২০২৩, ০৮: ২৬

গাঁয়ের নাম গাংডুবী। ঘিওর উপজেলার কেল্লাই বাজার থেকে মেঠো পথ ধরে কিছু দূর এগোতেই দুপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেত। এর পরেই ক্ষীণধারার ক্ষিরাই নদ। মানিকগঞ্জের নিচু অঞ্চলের এই এলাকায় আছে ৮ থেকে ১০টি গ্রাম। গাঁয়ের প্রবেশমুখে খেতের আলে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে সবুজ পাতার আচ্ছাদনে গাছভর্তি থোকা থোকা সাদা পাপড়ির অজস্র ফুল। এই ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত না হয়ে উপায় নেই। অথচ কেউ যত্ন করে রোপণ করেনি এগুলো। অনাদরে ফুটে থাকা এই ফুলের নাম বরুণ। দেখলেই একটু ছুঁয়ে আদর করে দিতে ইচ্ছা করবে।

বহুবর্ষজীবী এ উদ্ভিদ গ্রামে সাধারণ জ্বালানি কাঠ ছাড়া আর কোনো কিছুতেই ব্যবহার করা হয় না। তাই গাছটি রোপণে মানুষের আগ্রহ নেই বললেই চলে। ঘিওর উপজেলাসহ মানিকগঞ্জের বিভিন্ন জলাভূমি, ঝোপঝাড় কিংবা ডোবা-নালার পাশে আপনা-আপনি জন্ম ও বেড়ে ওঠা বরুণগাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। মানিকগঞ্জে বরুণগাছ সাধারণত বইন্যাগাছ নামে পরিচিত। তবে অঞ্চলভেদে এ গাছকে বর্ণা ও বিদাসি নামেও ডাকা হয়। সাধারণত বরুণকে গ্রীষ্ম ঋতুর ফুল ধরা হয়। মূলত বসন্তের মাঝামাঝি সময় থেকে বরুণের পুষ্পোচ্ছ্বাস নজর কাড়ে। বৈশাখ পর্যন্ত গাছে গাছে ফুলের সমারোহ থাকে।

ঘিওর, বানিয়াজুরী, নালী, সিংজুরী, পয়লা, বালিয়াখোড়া, বড়টিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত মেঠো পথ, নিচু ছায়াযুক্ত জলাধার ও ঝোপে একসময় এ গাছের অনেক দেখা মিলত। কিন্তু গত এক দশকে বরুণগাছের সংখ্যা কমে এসেছে দুই-তৃতীয়াংশে। স্থানীয় লোকজন জানান, কতবেলের মতো দেখতে বরুণের গোলাকার ফল শক্ত ও শাঁসালো হয়। অতীতে বিভিন্ন ধরনের ফল পাকাতে বরুণগাছের পাতা ব্যবহার করা হতো। চোখ ওঠার ভয়ে শিশু-কিশোরদের এ গাছ থেকে দূরে থাকতে বলতেন অভিভাবকেরা।  

কাউটিয়া প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক দেলোয়ার জাহান জানান, গাছটি সারা বছর সবার দৃষ্টির অগোচরে থাকলেও গ্রীষ্মের শুরুতে ফুল ফুটিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। সাদা পাপড়ির মাঝে লালচে রঙের কেশরযুক্ত থোকা থোকা বরুণ ফুল বেশ দৃষ্টিনন্দন। বৃক্ষপ্রেমী শিক্ষক মতিন দেওয়ান জানান, গাছভরা বরুণ ফুল প্রকৃতিকে অনাবিল উচ্ছ্বাস দেয়। তবে সাধারণ মানুষের অনাগ্রহের কারণে এটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা চিত্রা সরকার।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক উত্তম কুমার পালিত জানিয়েছেন, প্রাচীনকাল থেকে বরুণ ভেষজ গাছ হিসেবে পরিচিত। এর পাতা চর্মরোগ, ব্যথা, বাত নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। শিকড়ের বাকলের নির্যাস গ্যাস্ট্রিক রোগে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাহবুবা সুলতানা জানান, বরুণ বাংলাদেশের সব জেলায় কমবেশি দেখা যায়। ঢাকার পাশের জেলা মানিকগঞ্জে এটি বেশি দেখা যায়।

বরুণের বৈজ্ঞানিক নাম সার্টিভা রিলিজিওসা জি. ফরস্ট। এর ইংরেজি নাম স্যাকরেট গার্লিক পিয়ার, ট্রি-লিভড ক্রেপার এবং টেম্পল প্ল্যান্ট। আঞ্চলিক নাম বইন্যাগাছ, বইন্যাগোটা, লাটিমগোটা, ম্যাড্ডাগোটা ইত্যাদি। বরুণগাছ ১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। শাখা-প্রশাখা লেন্টিসেলযুক্ত, বাকল ধূসর-বাদামি ও মসৃণ। পাতা তিন ফলকযুক্ত। পুষ্পবিন্যাস করিম্ব, ফুলের পাপড়ি সাদা, পুংকেশর ২০টির বেশি। ফুল হালকা সুগন্ধযুক্ত। ফল গোলাকার বা ডিম্বাকার, শক্ত, হলদে ধূসর। বরুণের কাঁচা ফল সবজি হিসেবে খাওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত