Ajker Patrika

ছিঁড়ে যাওয়া সুতো...

জিন্নাত আরা ঋতু
ছিঁড়ে যাওয়া সুতো...

বৈবাহিক সম্পর্ক প্রকৃতির মতো। ওতপ্রোতভাবে রয়েছে মিল। যত্ন পেলে মুক্ত হাতে বিলিয়ে দেয় সৌন্দর্য, শুদ্ধতার ডালপালা মেলে। ঠিক তেমনি অযত্নে হিতে বিপরীত হয়। বৃত্ত থেকে ছন্দপতনে বেঁকে যায় রেখা। শুকিয়ে আসে আবেগ। কখনো জট পাকিয়ে যায়, কখনোবা সুতো ছিঁড়ে যায়। এই ছিঁড়ে যাওয়া সুতোয় সন্তান নামের যে ফুলটাকে গেঁথে রাখা হয়, সে কেবল ‘অস্তিত্বসংকট’।

আমরা বলি, যুগ বদলেছে। বদলেছে সমাজ। মানুষ এখন মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী। তবে কতটুকু বদলেছে? মুক্তভাবে ভাবা হয় কি? কেন এখনো পারিবারিক অবস্থান দিয়ে একজন মানুষকে মানদণ্ডে ফেলা হয়? কেনইবা ধরে নেওয়া হয় মা-বাবা একসঙ্গে নয় মানেই পরিবারটি ভালো নয়? ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তানেরা শিকড়হীন। মাথার ওপর পরিবারের ছায়া না থাকায় ছন্নছাড়া, তাদের তদারক করার কেউ নেই, জবাবদিহির জায়গা নেই, তাদের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, সঠিক নির্দেশিকার অভাবে থাকে তারা। 
আসলেই কি তাই? এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে একজন মানুষ প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে তার পরিবার, সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা থেকে; পরবর্তী ধাপগুলো আমাদের সবারই জানা। কিন্তু বিচ্ছেদ-পরিবারের সন্তান মানেই ভঙ্গুর মানসিকতার, এটা বলার কিংবা বাকি আর কয়েকটা মানুষের থেকে তাদের আলাদা চোখে দেখারও সুযোগ নেই। এটি ন্যায়সংগত কি? যখনই তাদের আলাদা ভাবা হবে, অযাচিত প্রশ্ন করে বিব্রত করা হবে, তারা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগবে। লজ্জাবোধ কাজ করবে। হীনম্মন্যতা, জড়তা তৈরি হবে। টিকে থাকার লড়াইটা কঠিন হয়ে পড়বে।

মূলত মা-বাবার বিচ্ছেদের পুরো প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। পারিবারিক ভাঙন সহ্য করা অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়ে’ আখ্যা অন্যদের চেয়ে তাদের আলাদা করে দেয়। সমাজ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। তারা নীড়হীন পাখি ভাবতে থাকে নিজেদের। কখনো কখনো লোকমুখের কটু কথায় অভিভাবকত্ব 
নিয়ে সংকট তৈরি হয়। বন্ধুমহলে তারা হেয়প্রতিপন্ন হয়। বিচ্ছেদকালীন এবং পরবর্তী সময়ে নিন্দা ও কটূক্তি শুনতে হয়। সেটা সবার আগে দুই পরিবারের পক্ষ থেকেই আসে। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ফলে তারা অনেক সময় পড়াশোনা বা দাপ্তরিক কাজে অমনোযোগী হয়ে ওঠে, জীবন নিয়ে হতাশা ও উদ্বিগ্নতায় ভোগে, হয়ে পড়ে লক্ষ্যচ্যুত। পরিবারকে পাশে না পাওয়ার ব্যথা নাড়া দেয়। বেলা শেষে ঘরে ফিরতে না পারা কিংবা ফিরে এলেও একাত্মতা না পাওয়া ভাবিয়ে তোলে।

আর মা-বাবা যদি অন্যত্র সংসার পেতে ফেলেন, তাহলে তো কথাই নেই। নিন্দা বেড়ে যায় বহুগুণে। একে তো মা কিংবা বাবার স্থানে অন্য কাউকে বসানো কষ্টকর, সেখানে যদি আশপাশ থেকে প্রতিনিয়ত তাদের ঘিরে প্রশ্ন আসতে থাকে, তা হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। পাশে থাকা বন্ধু এমনকি সহকর্মীদের পরিবারের গল্প আফসোস বাড়িয়ে দেয়। একটা সময়ে মনে হয়—এমন না হলেও পারত; একটু মানিয়ে নিয়ে এক ছাদের নিচে থাকতে পারতেন মা-বাবা। কেননা, লোকে মা-বাবাকে একসঙ্গে দেখতে পছন্দ করে, দাম্পত্য কলহ থাক বা না থাক।

সমাজের একটুখানি স্বাভাবিকতা তাদের জড়তা কাটাতে সাহায্য করবে, টিকে থাকা সহজ করবে। নয়তো তারা নিজেদের আর পাঁচটা মানুষের থেকে আলাদা ভাবতে শুরু করবে, অস্বস্তিতে ভুগবে, একপর্যায়ে নিজেদের আড়াল করবে। পারিবারিক অবস্থান জানতে চাইলে স্বাচ্ছন্দ্যে জবাব দিতে পারাটা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

বৈবাহিক সম্পর্ক চিরস্থায়ী না-ও হতে পারে; চিড় ধরতে পারে কিংবা একটি বিন্দুতে এসে থমকে যেতে পারে। এর প্রভাব সন্তানের গায়ে পড়তে দেওয়া যাবে না। এর দায় কেবল সেই পরিবার, আশপাশের মানুষ ও সমাজকেই নিতে হবে। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। ‘বিচ্ছেদ’ জীবনের অংশ, স্বাভাবিক বিষয়। বরং এটিকে সহজভাবে না নেওয়াটাই অস্বাভাবিকতা। বিচ্ছেদ-পরিবারের সন্তান মানেই অস্তিত্বহীন কিংবা ভালো-খারাপের দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায় না। প্রত্যেক মানুষের মতো তাদেরও রয়েছে বলয়, রয়েছে আত্মনির্ভরশীলতা। পারিবারিক অবস্থান যা-ই হোক, প্রত্যেক মানুষই স্বাভাবিক। তারা যেন নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারে, সেই সুযোগ সমাজকে দিতে হবে। তবেই তারা নিজের পরিচয়ে বাঁচতে পারবে, নিজেকে পোক্ত করতে পারবে।

লেখক: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত