মসিহউদ্দিন শাকের
শিক্ষাবর্ষে এক বছরের ছোট-বড় হলেও মেয়েটি-ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ক্লাসে পড়তেন। ছেলেটির প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েটি। এর শোধ নিতে মেয়েটির জীবন বিষিয়ে তোলেন ছেলেটি। দু-চার দিন নয়, ছয় বছর ধরে চলছিল এই অত্যাচার।
ক্লাসে-ক্যাম্পাসে সব জায়গায় একা হয়ে পড়েন মেয়েটি। নিরুপায় হয়ে তিনি দ্বারস্থ হন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। কিন্তু নিরাপত্তা-সহানুভূতির বদলে সেখানে তাঁর কপালে জোটে আরেক দফায় ‘হেনস্তা-নির্যাতন’। একে-একে ‘সাতবার’ নিজ কার্যালয়ে ডেকে তাঁকে ‘বকাঝকা আর গালাগাল’ করেন সহকারী প্রক্টর।
এত কিছু নিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত অসহায় আত্মসমর্পণ করেন মেয়েটি। বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। তবে আত্মহত্যা নয়, তিনি নিজেই বলে গেছেন, ‘এটা টেকনিক্যালি মার্ডার’।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা গত শুক্রবার রাতে কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় আটক করা হয়েছে তাঁর সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে।
অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনমের অভিযোগ, ক্যাম্পাসে বছরের পর বছর হেনস্তা ও বুলিংয়ের শিকার হয়ে তাঁর মেয়ে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সহকারী প্রক্টর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো অবন্তিকাকে ডেকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। আম্মানের পক্ষ নেন। এতে আম্মান আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আপত্তিকর মন্তব্য করতেন, হুমকি দিতেন। এসব ঘটনার বিচার না পেয়ে অবন্তিকা আত্মহত্যা করেছেন।
অবন্তিকাও মৃত্যুর আগে ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে বলে গেছেন, অভিযোগ দেওয়ার পর সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম তাঁকে সাতবার নিজ কার্যালয়ে ডেকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন ও মারধরের হুমকি দেন।
অবন্তিকার মা গতকাল শনিবার রাতে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। এতে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও ছাত্র আম্মান ছাড়াও অবন্তিকার সহপাঠী লাকি আক্তার লাকি ও রাফিসহ আরও কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে।
প্রক্টরের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাদেকা হালিম বলেন, ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তদন্তে যা উঠে আসবে, তার ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে কুমিল্লা সরকারি কলেজ মাঠে অবন্তিকার জানাজা হয়। পরে নগরীর বাগিচাগাঁও ফায়ার সার্ভিসসংলগ্ন এলাকায় বাবার কবরের পাশেই দাফন করা হয় তাঁকে।
সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় তিনি মাস্টারদা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ২০২১ সালে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব পান।
অভিযুক্ত ছাত্র আম্মানের বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায়। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফারাজির অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া রেডিও প্রাইম নামে একটি এফএম রেডিওর জকি হিসেবে কাজ করেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটির কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন।
ক্যাম্পাসে-কুমিল্লায় বিক্ষোভ
অবন্তিকার এ পরিণতির পর জন্য যাঁদের দিকে আঙুল তুলেছেন, তাঁদের বিচারের আওতায় আনার দাবিতে গত শুক্রবার রাতেই বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। রাত প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
এরপর গতকাল আবার শুরু হয় বিক্ষোভ। ক্যাম্পাসজুড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিক্ষোভ থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও স্থায়ী বহিষ্কারসহ ছয় দফা দাবি জানিয়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা।
একপর্যায়ে অভিযুক্ত ছাত্র রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে সাময়িক বহিষ্কার ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিকেলে দুজনকে লালবাগ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সন্ধ্যায় জানানো হয়, তাঁদের আটক করা হয়েছে।
অবন্তিকার মৃত্যুকে ‘হত্যা’ দাবি করে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে কুমিল্লার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জোট। গতকাল নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ের পূবালী চত্বরে ঘণ্টাব্যাপী এ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় বক্তারা দ্বীন ইসলাম ও শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীসহ অবন্তিকার মৃত্যুর নেপথ্যে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
প্রেমের প্রত্যাখ্যানে ঘটনার শুরু
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৩ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী অবন্তিকার শিক্ষাবর্ষ ছিল ২০১৭-১৮। শুরুতে এক বছর পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে পরের বছর ১৪ তম ব্যাচের সঙ্গে ক্লাস শুরু করেন। সেই ব্যাচের ছাত্র আম্মান। প্রথম বর্ষেই অবন্তিকাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন আম্মান। প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকে আম্মান তাঁকে ক্যাম্পাসে হেনস্তা ও মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করেন।
অবন্তিকার পরিবারের দাবি, দুই বছর আগে অবন্তিকার সঙ্গে তাঁরই কয়েকজন সহপাঠীর বিরোধ শুরু হয় ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নিয়ে। এ নিয়ে থানায় অবন্তিকার বিরুদ্ধে একটি জিডি করা হয়। পরে উভয় পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে বিষয়টি মিটমাট হয়ে যায়। যদিও এরপর জিডিটি আর তুলে নেওয়া হয়নি এবং এ নিয়ে অবন্তিকার মা-বাবাও কয়েকবার এসে প্রক্টর অফিসে অনুরোধ করলেও কাজ হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অবন্তিকার ঘনিষ্ঠ অনেকে ফেসবুকে লিখেছেন, ওই ঘটনার পর থেকে ব্যাপকভাবে মানসিক উৎপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন অবন্তিকা। আইন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কয়েকজন জানান, সহপাঠীরা অনেকে অবন্তিকার সঙ্গে ক্লাসে বসতেন না, কথা বলতেন না। তাঁদের দ্বারা নানাভাবে বুলিংয়ের শিকার হয়ে আসছিলেন তিনি। একপর্যায়ে হল ছেড়ে আরেক ছাত্রীর সঙ্গে মেসে থাকতে বাধ্য হন তিনি।
গত নভেম্বরে তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামালের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন অবন্তিকা। তিনি অভিযোগ করেন, প্রথম বর্ষে তাঁকে প্রেমের প্রস্তাব দেন আম্মান। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর থেকেই ক্যাম্পাসের ক্লাসে, করিডরে এবং বিভিন্ন স্থানে আম্মান তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। এমনকি কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল মন্তব্য করেন। এসবের প্রতিবাদ করায় আম্মান তাঁকে হুমকি দেন, একদিন এমন অবস্থা করবেন বা এমনভাবে ফাঁসাবেন, যাতে তিনি মেয়ে হয়ে সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন।
সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অবন্তিকা একটা লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল। তারপর তাকে দেখা করার জন্য ডেকেছিলাম; কিন্তু সে আর দেখা করতে আসেনি।’
অবন্তিকার মা ও বন্ধু যা বললেন
অবন্তিকার বাবা মো. জামাল উদ্দিন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ ও কুমিল্লা সরকারি কলেজে এক সময় শিক্ষকতা করতেন। ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা শহরতলির শাসনগাছা মহাজনবাড়ি এলাকায়। অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম কুমিল্লা পুলিশ লাইনস উচ্চবিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মা তাহমিনা বলেন, শুক্রবার ইফতারের পর মেয়েকে বিষণ্ন দেখেছিলেন তিনি। তখন মন খারাপ কেন জানতে চাইলে অবন্তিকা শুধু বলেছিলেন, এমনিই। তবে মেয়ে যে আত্মহত্যা করবে, তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তিনি।
তাহমিনা বলেন, ‘রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমাকে পানি দিয়ে গেল এক গ্লাস। এর কিছুক্ষণ পর ওর রুমে ফ্যানের শব্দ না পেয়ে ডাকাডাকি করি। কোনো সাড়া মেলেনি। পরে আমার ছেলে দারোয়ানকে নিয়ে মই দিয়ে পূর্ব পাশের জানালা খুলে ফ্যানের সঙ্গে অবন্তিকাকে ঝুলে থাকতে দেখে।’
মা তাহমিনা আরও বলেন, ‘আমার মেয়ের কী অপরাধ ছিল? আমার মেয়ে ভালো ছাত্রী ছিল, মেধাবী ছিল, আমার মেয়ে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ছিল, এটাই কী তার অপরাধ।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘এ বিষয়টি আমি চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি, প্রক্টরকে জানিয়েছি, কোনো প্রতিকার পাইনি।’
অবন্তিকার ছোটবেলার বন্ধু নাশিয়া জাহিন রোদেলা। তিনি ফেসবুক ভিডিওতে (অ্যাস্থেটিক বাই রোদেলা নামের আইডি) বলেন, ‘আমার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলত অবন্তিকা। সে বলত, ভার্সিটিতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। ওরই কিছু সহপাঠী পুরো ব্যাচকে ওর বিরুদ্ধে উসকায়া দিসে। দিনের পর দিন পুরো ক্লাসের মানুষ ওর সাথে বসত না, কথা বলত না। ওরা চাইছিল অবন্তী যেন আর কন্টিনিউ করতে না পারে। এরপরও মেয়েটা মনকে শক্ত করে ক্লাসে যেত। ওকে দেখলে লিটারেলি ওর সামনে বুলিং করত, হ্যারাস করত। পুরোটা ক্লাস।’
এই সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
শিক্ষাবর্ষে এক বছরের ছোট-বড় হলেও মেয়েটি-ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ক্লাসে পড়তেন। ছেলেটির প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েটি। এর শোধ নিতে মেয়েটির জীবন বিষিয়ে তোলেন ছেলেটি। দু-চার দিন নয়, ছয় বছর ধরে চলছিল এই অত্যাচার।
ক্লাসে-ক্যাম্পাসে সব জায়গায় একা হয়ে পড়েন মেয়েটি। নিরুপায় হয়ে তিনি দ্বারস্থ হন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। কিন্তু নিরাপত্তা-সহানুভূতির বদলে সেখানে তাঁর কপালে জোটে আরেক দফায় ‘হেনস্তা-নির্যাতন’। একে-একে ‘সাতবার’ নিজ কার্যালয়ে ডেকে তাঁকে ‘বকাঝকা আর গালাগাল’ করেন সহকারী প্রক্টর।
এত কিছু নিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত অসহায় আত্মসমর্পণ করেন মেয়েটি। বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। তবে আত্মহত্যা নয়, তিনি নিজেই বলে গেছেন, ‘এটা টেকনিক্যালি মার্ডার’।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা গত শুক্রবার রাতে কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় আটক করা হয়েছে তাঁর সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে।
অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনমের অভিযোগ, ক্যাম্পাসে বছরের পর বছর হেনস্তা ও বুলিংয়ের শিকার হয়ে তাঁর মেয়ে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সহকারী প্রক্টর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো অবন্তিকাকে ডেকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। আম্মানের পক্ষ নেন। এতে আম্মান আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আপত্তিকর মন্তব্য করতেন, হুমকি দিতেন। এসব ঘটনার বিচার না পেয়ে অবন্তিকা আত্মহত্যা করেছেন।
অবন্তিকাও মৃত্যুর আগে ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে বলে গেছেন, অভিযোগ দেওয়ার পর সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম তাঁকে সাতবার নিজ কার্যালয়ে ডেকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন ও মারধরের হুমকি দেন।
অবন্তিকার মা গতকাল শনিবার রাতে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। এতে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও ছাত্র আম্মান ছাড়াও অবন্তিকার সহপাঠী লাকি আক্তার লাকি ও রাফিসহ আরও কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে।
প্রক্টরের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাদেকা হালিম বলেন, ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তদন্তে যা উঠে আসবে, তার ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে কুমিল্লা সরকারি কলেজ মাঠে অবন্তিকার জানাজা হয়। পরে নগরীর বাগিচাগাঁও ফায়ার সার্ভিসসংলগ্ন এলাকায় বাবার কবরের পাশেই দাফন করা হয় তাঁকে।
সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় তিনি মাস্টারদা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ২০২১ সালে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব পান।
অভিযুক্ত ছাত্র আম্মানের বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায়। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফারাজির অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া রেডিও প্রাইম নামে একটি এফএম রেডিওর জকি হিসেবে কাজ করেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটির কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন।
ক্যাম্পাসে-কুমিল্লায় বিক্ষোভ
অবন্তিকার এ পরিণতির পর জন্য যাঁদের দিকে আঙুল তুলেছেন, তাঁদের বিচারের আওতায় আনার দাবিতে গত শুক্রবার রাতেই বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। রাত প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
এরপর গতকাল আবার শুরু হয় বিক্ষোভ। ক্যাম্পাসজুড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিক্ষোভ থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও স্থায়ী বহিষ্কারসহ ছয় দফা দাবি জানিয়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা।
একপর্যায়ে অভিযুক্ত ছাত্র রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে সাময়িক বহিষ্কার ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিকেলে দুজনকে লালবাগ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সন্ধ্যায় জানানো হয়, তাঁদের আটক করা হয়েছে।
অবন্তিকার মৃত্যুকে ‘হত্যা’ দাবি করে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে কুমিল্লার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জোট। গতকাল নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ের পূবালী চত্বরে ঘণ্টাব্যাপী এ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় বক্তারা দ্বীন ইসলাম ও শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীসহ অবন্তিকার মৃত্যুর নেপথ্যে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
প্রেমের প্রত্যাখ্যানে ঘটনার শুরু
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৩ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী অবন্তিকার শিক্ষাবর্ষ ছিল ২০১৭-১৮। শুরুতে এক বছর পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে পরের বছর ১৪ তম ব্যাচের সঙ্গে ক্লাস শুরু করেন। সেই ব্যাচের ছাত্র আম্মান। প্রথম বর্ষেই অবন্তিকাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন আম্মান। প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকে আম্মান তাঁকে ক্যাম্পাসে হেনস্তা ও মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করেন।
অবন্তিকার পরিবারের দাবি, দুই বছর আগে অবন্তিকার সঙ্গে তাঁরই কয়েকজন সহপাঠীর বিরোধ শুরু হয় ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নিয়ে। এ নিয়ে থানায় অবন্তিকার বিরুদ্ধে একটি জিডি করা হয়। পরে উভয় পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে বিষয়টি মিটমাট হয়ে যায়। যদিও এরপর জিডিটি আর তুলে নেওয়া হয়নি এবং এ নিয়ে অবন্তিকার মা-বাবাও কয়েকবার এসে প্রক্টর অফিসে অনুরোধ করলেও কাজ হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অবন্তিকার ঘনিষ্ঠ অনেকে ফেসবুকে লিখেছেন, ওই ঘটনার পর থেকে ব্যাপকভাবে মানসিক উৎপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন অবন্তিকা। আইন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কয়েকজন জানান, সহপাঠীরা অনেকে অবন্তিকার সঙ্গে ক্লাসে বসতেন না, কথা বলতেন না। তাঁদের দ্বারা নানাভাবে বুলিংয়ের শিকার হয়ে আসছিলেন তিনি। একপর্যায়ে হল ছেড়ে আরেক ছাত্রীর সঙ্গে মেসে থাকতে বাধ্য হন তিনি।
গত নভেম্বরে তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামালের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন অবন্তিকা। তিনি অভিযোগ করেন, প্রথম বর্ষে তাঁকে প্রেমের প্রস্তাব দেন আম্মান। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর থেকেই ক্যাম্পাসের ক্লাসে, করিডরে এবং বিভিন্ন স্থানে আম্মান তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। এমনকি কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল মন্তব্য করেন। এসবের প্রতিবাদ করায় আম্মান তাঁকে হুমকি দেন, একদিন এমন অবস্থা করবেন বা এমনভাবে ফাঁসাবেন, যাতে তিনি মেয়ে হয়ে সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন।
সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অবন্তিকা একটা লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল। তারপর তাকে দেখা করার জন্য ডেকেছিলাম; কিন্তু সে আর দেখা করতে আসেনি।’
অবন্তিকার মা ও বন্ধু যা বললেন
অবন্তিকার বাবা মো. জামাল উদ্দিন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ ও কুমিল্লা সরকারি কলেজে এক সময় শিক্ষকতা করতেন। ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা শহরতলির শাসনগাছা মহাজনবাড়ি এলাকায়। অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম কুমিল্লা পুলিশ লাইনস উচ্চবিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মা তাহমিনা বলেন, শুক্রবার ইফতারের পর মেয়েকে বিষণ্ন দেখেছিলেন তিনি। তখন মন খারাপ কেন জানতে চাইলে অবন্তিকা শুধু বলেছিলেন, এমনিই। তবে মেয়ে যে আত্মহত্যা করবে, তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তিনি।
তাহমিনা বলেন, ‘রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমাকে পানি দিয়ে গেল এক গ্লাস। এর কিছুক্ষণ পর ওর রুমে ফ্যানের শব্দ না পেয়ে ডাকাডাকি করি। কোনো সাড়া মেলেনি। পরে আমার ছেলে দারোয়ানকে নিয়ে মই দিয়ে পূর্ব পাশের জানালা খুলে ফ্যানের সঙ্গে অবন্তিকাকে ঝুলে থাকতে দেখে।’
মা তাহমিনা আরও বলেন, ‘আমার মেয়ের কী অপরাধ ছিল? আমার মেয়ে ভালো ছাত্রী ছিল, মেধাবী ছিল, আমার মেয়ে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ছিল, এটাই কী তার অপরাধ।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘এ বিষয়টি আমি চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি, প্রক্টরকে জানিয়েছি, কোনো প্রতিকার পাইনি।’
অবন্তিকার ছোটবেলার বন্ধু নাশিয়া জাহিন রোদেলা। তিনি ফেসবুক ভিডিওতে (অ্যাস্থেটিক বাই রোদেলা নামের আইডি) বলেন, ‘আমার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলত অবন্তিকা। সে বলত, ভার্সিটিতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। ওরই কিছু সহপাঠী পুরো ব্যাচকে ওর বিরুদ্ধে উসকায়া দিসে। দিনের পর দিন পুরো ক্লাসের মানুষ ওর সাথে বসত না, কথা বলত না। ওরা চাইছিল অবন্তী যেন আর কন্টিনিউ করতে না পারে। এরপরও মেয়েটা মনকে শক্ত করে ক্লাসে যেত। ওকে দেখলে লিটারেলি ওর সামনে বুলিং করত, হ্যারাস করত। পুরোটা ক্লাস।’
এই সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে