গাজীপুরের আয়না ও আওয়ামী লীগের ভাবনা

বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩, ১০: ১৯

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী আয়নায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা ও জনমতের যে প্রতিফলন দেখা গেল, তা নিয়ে দলটির মধ্যে কোনো ভাবনার উদয় হয়েছে কি না, জানি না। তবে দলটির যে নতুন করে অনেক কিছু না হলেও কিছু বিষয় অন্তত ভাবা উচিত, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। দলটি যদি মনে করে ‘সবকিছু ঠিক আছে, কোথাও কোনো সমস্যা নেই’, তাহলে শেষ হাসি হয়তো অন্য কেউ হাসবে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত আজমত উল্লা খান পরাজিত হবেন, এটা বোধ হয় দলের কারও ভাবনায় ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগকে বধ করার জন্য আওয়ামী লীগেই যে ‘জাহাঙ্গীর আলমেরা’ বেড়ে উঠছেন, সেটা তো একেবারে অজানা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগের দিন এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতারা যে ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরি করেছেন, তাঁরাই এখন আওয়ামী লীগকে খাচ্ছেন।’

জাহাঙ্গীর আলমও যে তেমনই একজন ফ্রাংকেনস্টাইন এবং গাজীপুরের আওয়ামী লীগকে খেয়ে ফেলেছেন, সে খবর দলটির হাইকমান্ডের তো না জানার কথা নয়। পত্রিকায় এমন খবর ছাপা হয়েছে যে গাজীপুরের আওয়ামী লীগের কোনো কোনো কর্মী বলেছেন, ‘আমরা তৃণমূলের কামলারা নৌকা নৌকা করি, আর কেন্দ্রের সর্বোচ্চ নেতাদের কেউ কেউ টাকা টাকা করে।’ এমন জনশ্রুতি আছে যে জাহাঙ্গীর কেন্দ্রের কোনো কোনো নেতাকে বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে বশ করে রেখেছেন।

টাকার জোরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ ছাড়া আরও অনেককেই হাতে রেখেছেন জাহাঙ্গীর। ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতা থাক শূন্য’—এই নীতি অনেকেই অনুসরণ করেছেন।

জাহাঙ্গীর আলম নিজে প্রার্থী হলেও নাহয় সান্ত্বনা পাওয়া যেত কিন্তু তাঁর মা, যিনি জীবনে কোনো দিন ঘরের বাইরে বের হয়ে কোনো সভা-সমাবেশে যোগ দিয়েছেন বলে শোনা যায়নি, তিনিই কিনা ছেলের কেয়ারঅফে একটি সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়ে গেলেন! এটাকে যেভাবে গণতন্ত্রের মহিমা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে, তা-ও কি কম বিস্ময়ের।

রামের পায়ের খড়ম নিয়ে লক্ষ্মণ রাজকার্য চালিয়েছেন বলে এত দিন পৌরাণিক কাহিনিতে শোনা গেলেও এবার বাংলাদেশে ছেলেকে পাশে নিয়ে নগর চালানোর আধুনিক গণতন্ত্র আমরা প্রত্যক্ষ করব।

মার্কিন ভিসা নীতি এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য ভয়ের কারণ কি না, তা নিয়ে যেমন আলোচনা করা যেতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে এটাও আলোচনায় আসতে পারে যে আওয়ামী লীগ ও সরকার তাদের ভুল শোধরাতে চাইবে কি না। গাজীপুরে জায়েদা খাতুনের মতো একজন একেবারে অনালোচিত প্রার্থীর কাছে আওয়ামী লীগ মনোনীত পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ আজমত উল্লা খানের পরাজয় বিভিন্ন প্রশ্নই সামনে আনছে; বিশেষ করে ভোটের মাঠে যখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ বিএনপি অনুপস্থিত, তখন তো ভোট হওয়ার কথা একতরফা, আওয়ামী লীগ ও নৌকা মার্কার প্রার্থীর জেতার কথা হেসেখেলে।

কিন্তু গাজীপুরে তা হলো না। গাজীপুর প্রমাণ করল, বিএনপি ভোটের মাঠে না থাকলেও আওয়ামী লীগ আর ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারবে না। জায়েদা খাতুনের মতো পচা শামুকেও পা কাটার ভয় এখন আওয়ামী লীগকে তাড়া করতে থাকবে। চলার পথে হোঁচট খেলে সতর্ক হওয়ার তাগিদ তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের তা হবে কি?

নির্বাচনে জয়-পরাজয় স্বাভাবিক ঘটনা। জয়ের লক্ষ্য নিয়ে অনেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, কিন্তু জয়লাভ করেন একজনই। গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বরাবরই আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে, তা নয়। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান কিন্তু বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে হেরেছিলেন। এরপর ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির হাসানউদ্দিন সরকারকে বিপুল ভোটে হারিয়ে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। ২০১৩ সালের নির্বাচনেও জাহাঙ্গীর আলম দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন এবং ভোটের কয়েক দিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়েছিলেন বলেই হয়তো আজমত উল্লার পরাজয় হয়েছিল। জাহাঙ্গীর আলম অনেক অর্থবিত্তের মালিক। বলা হয়, তাঁর জনপ্রিয়তার বড় কারণ টাকা। তিনি কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন? আওয়ামী লীগকে তিনি ক্ষমতা ও সম্পদ বৃদ্ধির মেশিন হিসেবে সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। দলীয় নীতি-আদর্শের কারণে যতটা না মানুষের কাছে পরিচিত, তার চেয়ে তাঁর বেশি পরিচিতি দান-দক্ষিণা করার কারণে।

জাহাঙ্গীর ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। একই সময় আওয়ামী লীগ থেকেও তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি একসময় গাজীপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের গত জাতীয় সম্মেলনের আগে দল থেকে বহিষ্কৃত অনেককেই সাধারণ ক্ষমা করা হয়। এই সুযোগ জাহাঙ্গীর আলমও পেয়েছিলেন। ক্ষমা পেয়েই তিনি আবার দলের নেতৃত্ব পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। মেয়র পদেও নৌকার মনোনয়ন চান। কিন্তু বঞ্চিত হয়ে আবারও বিদ্রোহী প্রার্থী হন। ঋণখেলাপির কারণে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়। এমন যে হতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই তিনি সম্ভবত মা জায়েদা খাতুনকেও প্রার্থী করেছিলেন। দলীয় প্রার্থী আজমত খানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে না নেমে জাহাঙ্গীর মা জায়েদা খাতুনকে নিয়ে মাঠে থাকায় এবার আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কৃত হন। কিন্তু এই সবকিছুকে তোয়াক্কা না করে জায়েদা খাতুনকে নিয়ে জাহাঙ্গীর প্রচারণা চালান। মা কাগজে-কলমে প্রার্থী হলেও বাস্তবে ভোটে লড়েছেন ছেলে। ফলে জায়েদা খাতুনের জয়কে জাহাঙ্গীরের বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বলা হচ্ছে, গাজীপুরে আওয়ামী লীগের চেয়ে জাহাঙ্গীর আলম বেশি জনপ্রিয়। আসলে কি তাই? দলের চেয়ে ব্যক্তি কি বড় হয়ে উঠতে পারে? অতীতে যাঁরা আওয়ামী লীগ ছেড়েছেন কিংবা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাঁরা কেউ কি আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হতে পেরেছেন? না, তেমন দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে না। তাহলে জাহাঙ্গীর আলম কীভাবে দলকে চ্যালেঞ্জ করেও নিজেকে দলের লোক হিসেবে দাবি করতে পারছেন? কুকুরে লেজ নাড়ে, নাকি লেজই কুকুর নাড়ে?

জুন মাসে চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে। এরপর চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষ অথবা আগামী বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গাজীপুরের ভোটের ফলাফল কি আগামী নির্বাচনগুলোতে কোনো প্রভাব ফেলবে?

গত ১৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় এমপিদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে সবার আমলনামা আছে। আমলনামা দেখেই আগামীতে দলীয় মনোনয়ন দেব। জনগণের সঙ্গে যাঁদের সুসম্পর্ক আছে, সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরাই নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। আর যাঁরা জনবিচ্ছিন্ন, নির্বাচিত হয়ে ঢাকা আর বিদেশে পড়ে ছিলেন, এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, জনবিচ্ছিন্ন, দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন, যেসব এমপি গ্রুপিং সৃষ্টি করতে গিয়ে নিজ দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন, তাঁদের মনোনয়ন দেব না, এটা সাফ কথা।’
যাঁদের কারণে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও সরকারপ্রধানের কঠোর মনোভাবের কথা প্রায়ই শোনা যায়। এমনও বলা হয় যে তিনি কাউকেই ছাড় দিতে নারাজ। কিন্তু বাস্তবে এই কঠোরতা কি দেখা যায়? কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা আমলে নেওয়া হয় না। কয়েকজন মন্ত্রীর পারফরম্যান্স নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা থাকলেও কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। অথচ মন্ত্রিসভায় রদবদল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি সাধারণ নিয়ম।  

নানা ঘটনা থেকেই এটা স্পষ্ট যে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের চেয়েও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হবে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা কিছু দেশ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সরকারকে চাপের মধ্যে রেখেছে। আমেরিকার মতিগতি বোঝা ভার। প্রধানমন্ত্রী নিজেই আমেরিকা নিয়ে তাঁর আশঙ্কার কথা বলেছেন। আমেরিকার ভিসা নীতি বিরোধী দলের চেয়ে সরকারের জন্যই বেশি অস্বস্তিকর হওয়ার কথা।

বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে নির্বাচনে অংশ নিলে বা না নিলেও তারা যে সরকারের পথে বড় কাঁটা হয়ে থাকবে, সেটা স্পষ্ট। ভোটারদের একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তাদের আছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি যতটা মজবুত থাকা দরকার তা নেই। এটা অনেকেই বলেন যে আওয়ামী লীগের বড় শত্রু আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কমান্ড না মানার প্রবণতা প্রায় সর্বত্র। দলীয় বিরোধের কারণে বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও গাজীপুরের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি হয় কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।  

তবে এটা ঠিক, বহুদিন পর গাজীপুরের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠেনি। এই ধারাই অব্যাহত থাক–এটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু সেটা হবে কি?

গাজীপুরের ফলাফল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। তৃণমূলের প্রকৃত তথ্য ও চিত্র কেন্দ্রে নেই। যেসব জরিপ করা হচ্ছে, সেগুলো বস্তুনিষ্ঠ তা কি বলা যাবে? ৫ সিটিতে যাচাই-বাছাই করেই মনোনয়ন দেওয়ার পরও গাজীপুরের হিসাব কেন মিলল না? দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারীদের প্রতি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশ সহানুভূতি দেখালে দলের ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় কি? জাহাঙ্গীর আলম ও তাঁর মাকে যদি এখন আবার আওয়ামী লীগে জায়গা করে দেওয়া হয়, তাহলে আদর্শনিষ্ঠ নেতা-কর্মীদের গালে কি চপেটাঘাত করা হবে না?

বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক,আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত