মোনায়েম সরকার
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি, জামায়াতসহ ডানপন্থী ও বামপন্থী কিছু দল নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ডাক দিয়েছে। বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলন যে ব্যাপক জনসমর্থন পাচ্ছে না এবং এসব অবরোধ-হরতাল করে যে নির্বাচন না হওয়ার মতো পরিস্থিতি দেশে তৈরি করতে পারবে না, সেটা বলা যায়।
মানুষের সমর্থন আছে—এমন সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত। তবে কোনো দল যদি দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচন থেকে দূরে থাকে, তাহলে অন্যদের কী করার থাকে? একসময় আমাদের দেশের অর্থনীতি ছিল বিদেশনির্ভর। বাজেট পেশের আগে আমাদের অর্থমন্ত্রীরা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিদেশে ছুটতেন। এখন অর্থনীতি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, রাজনীতি হয়েছে বিদেশনির্ভর।
আর সে জন্যই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে ভূরাজনীতিতেও একটি নতুন সমীকরণ তৈরি হওয়ার অবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা, অন্যদিকে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সুস্পষ্ট অবস্থান বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে যে বলয় তৈরি করছে, তা প্রত্যাশিত না হলেও বাস্তব সত্য। নির্বাচন বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এ দেশের জনগণের, এটা জানার পরও অন্যদের খবরদারি আপত্তিকর। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়াদৌড়ি তো রীতিমতো বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গলদ নেই তা নয়। আমাদের রাজনীতিতে অগ্রগতি, পশ্চাদ্গতি দুটিই আছে। এটা সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। আমেরিকা বা ব্রিটেনও বলতে পারবে না যে তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা শতভাগ ত্রুটিমুক্ত। আমেরিকার গত নির্বাচনের পর সেখানে নজিরবিহীন হামলা হয়েছিল ক্যাপিটল হিলে। পরাজিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো ওই নির্বাচন মেনে নেননি। রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে একসময়কার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কম ভোট পাননি। বলা হয়ে থাকে, ট্রাম্প মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। এক বিব্রতকর মামলায় ফেঁসে যাওয়ার পরও তিনি কম জনপ্রিয় নন। পরবর্তী নির্বাচনের দৌড়েও তিনি এগিয়ে আছেন। জরিপ বলছে, তিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। প্রশ্ন হলো, আমরা কি তাদের প্রার্থীর মান, এমনকি ভোটারদের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলি? তাহলে তারা কেন আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে এত কথা বলে? গণতন্ত্রের জন্য প্রত্যাশা এক জিনিস, আর চাপ সৃষ্টির জন্য নানা তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া আরেক বস্তু। আমেরিকা ও তার মিত্র বলে পরিচিত কিছু দেশের কূটনীতিক ও কর্মকর্তার বাংলাদেশ ঘিরে তৎপরতায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও ক্ষোভ প্রকাশ করে কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমারা বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকে। গবেষণা প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে দেখে থাকে। তা ছাড়া, এসব প্রতিবেদন তারা তৈরি করে সাধারণত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বক্তব্য অনুসরণ করে, একপেশেভাবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমন একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তাদের দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনও যে সুষ্ঠু হয়নি—এ কথা বললে সেটা কি একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে? গণতন্ত্রে আমেরিকার অর্জনকে আমরা অস্বীকার করি না।
‘অভিবাসীদের দেশ’ বলে বর্ণনা করা হয় আমেরিকাকে। আমাদের দেশ থেকেও বহু মানুষ গিয়ে সেখানকার বাসিন্দা হয়েছেন। দেশটির সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কও গভীর। এটা কারও দান নয়; আমাদের অর্জন। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যত সীমাবদ্ধতাই থাকুক, অর্থনীতিতে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, এটা পশ্চিমা দেশগুলোও অস্বীকার করতে পারে না। তারা যে প্রতিবেদনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলেছে, তাতেই আবার অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করেছে। আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি পশ্চিমাদের কাছেও বিস্ময়। তারা তো জানে, বিশ্বব্যাংক ও তার সমমানের সাহায্যদাতা সংস্থাগুলো সরে গেলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ভূমিকায় প্রমত্তা পদ্মার বুকে গড়ে উঠেছে সেতু। তারা এটাও জানে, রাশিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে, যা এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এটির বাস্তবায়ন বিঘ্নিত করতেও নানা তৎপরতা চলছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার বেশ কিছু জাহাজের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমেরিকা। তেমন একটি জাহাজে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল আনা হচ্ছিল। সেটা যাতে বাংলাদেশের বন্দরে না ভিড়তে পারে, তা নিশ্চিত করতে কী না করেছে আমেরিকা? জাহাজটি ভারতের কোনো বন্দরেও যাতে ভিড়তে না পারে, সে জন্য তারা তৎপর ছিল। এটা নজিরবিহীন। ইউক্রেনে রাশিয়া অভিযান পরিচালনা করছে—এ কথা ঠিক। কিন্তু এই যুদ্ধের পেছনে কি আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের হাত নেই? এর ফলে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ায় নিত্যপণ্যের বাজার কত অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে, সেটাও বলা বাহুল্য। পশ্চিমারাও কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। রাশিয়াকে কাবু করার জন্য দেওয়া নিষেধাজ্ঞা তাদের ওপরই গিয়ে আঘাত হানছে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের একটি নির্দোষ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ কেন এ জন্য বিঘ্নিত হবে? এ-ই তাহলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার মার্কিনদের ভূমিকা!
২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে আমরাও গর্ব করি না। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়েও কিছু প্রশ্ন আছে। কিন্তু এর দায় একতরফাভাবে শেখ হাসিনা সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। বাংলাদেশে নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটানো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আদালতের রায়েই বাতিল হয়েছে। এটা আর ফেরত আনার দাবি অযৌক্তিক ও অন্যায্য। নির্বাচনব্যবস্থাকে কীভাবে বিতর্কমুক্ত করা যায়, সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। কিন্তু অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে রাজনৈতিক সরকার গঠনের দাবি করা তো আহাম্মকি। আমেরিকাসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবে হবে। এই বাস্তবতা মানতে না পারা বিএনপি ২০১৪-এর নির্বাচন বানচাল করতে আন্দোলনের নামে কত অপরাধ করেছে, সেটা কি পশ্চিমারা জানে না? তাদের কাছে তো অনেক ছোটখাটো বিষয়েরও খবর থাকে, যা বিভিন্ন ঘটনায় আমরা বুঝতে পারি। গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতাদের হত্যার অপচেষ্টার কথা কি তাদের জানা নেই? তখন কারা ক্ষমতায় ছিল এবং কাদের পরিকল্পনায় হামলা হয়েছিল, তারা নিশ্চয়ই জানে। বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াও গ্রেনেড হামলায় নির্মমভাবে মারা যান বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে। তার পরও তাদের সঙ্গে সংলাপে বসতে হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে, এটাও নির্মম বাস্তবতা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা কিন্তু এসেছিলেন নির্বাচন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ করে। কিন্তু নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে তারা এমনভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়, যাতে এটি বিতর্কিত হয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, তারা নির্বাচনে এসেছিল এটিকে বিতর্কিত করতে।
সেটা করতে তারা একপ্রকার সফলও হয়েছে বলা যায়। অন্তত আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের তারা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে ২০১৮-এর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। আমরা বলব, সেটি মানসম্মত নির্বাচন হয়তো হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ওই নির্বাচনের ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হয়েছে এবং সেই সরকার সফলভাবে দেশ পরিচালনা করে আরেকটি নির্বাচনের সামনে এসে উপনীত হয়েছে।
বাংলাদেশে ভবিষ্যতে যে নির্বাচন হবে, সেটা ২০১৮-এর মতো হবে না—এ কথা সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী এই নিশ্চয়তা দিয়েছেন। কিন্তু মাঠের বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে অনড় এবং দেখা যাচ্ছে, আমেরিকাসহ পশ্চিমা গোষ্ঠী তাদের বাতাস দিচ্ছে। বাক্স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ইস্যু সামনে এনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টাও কম হচ্ছে না। বাংলাদেশ পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। ক্রসফায়ারের ঘটনা অনেক আগে থেকে ঘটে এলেও বর্তমান সরকারের আমলেই বিষয়টিকে ইস্যু করেছে আমেরিকা। র্যাব সাধারণ মানুষের কাছে একপ্রকার জনপ্রিয় হলেও একে বিতর্কিত করার প্রয়াস তারা পেয়েছে কী কারণে, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। নিজেদের দেশে তারা কি ঘন ঘন বন্দুক হামলা থেকে রক্ষা করতে পারছে নিরীহ মানুষকে? তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ কম নয়।
ক্ষমতা মদমত্ত হয়েই যে আমেরিকা আমাদের মতো দেশগুলোর ওপর খবরদারি করছে এবং সেটা তাদের হীন স্বার্থে, এটি কারও বুঝতে বাকি নেই। তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। নিজেদের কাছে অবাধ্য বলে বিবেচিত সরকারকে বাধ্য করতেও তারা এসব করে থাকে। আমেরিকা ইতিমধ্যে অনেক দেশে অনেক অন্যায় হস্তক্ষেপ করেছে। যুদ্ধও চাপিয়ে দিয়েছে অজুহাত খাড়া করে। গণহত্যার আয়োজন করেছে। তাদের মুখে শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বুলি বেমানান। তাদের এটাও বুঝতে হবে, বিশ্ব আর এককেন্দ্রিক নেই। চীনের নব উত্থান হয়েছে এবং রুশ-চীন সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছে ক্রমে। আঞ্চলিক শক্তিগুলোরও উত্থান হচ্ছে। যেমন—ভারত। ভারত-আমেরিকার মৈত্রীও আগের জায়গায় নেই। সৌদি আরবের সঙ্গেও আমেরিকার সম্পর্ক পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ঘটছে নানা পরিবর্তন। এ অবস্থায় মার্কিন খবরদারির সুযোগও সীমিত হয়ে আসছে। আর বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মানুষ যাতে অবাধে ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করে আমেরিকা ও তার সহযোগী বা মিত্রদের সাফ জানিয়ে দিতে হবে, আমাদের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সমস্যার সমাধান আমরাই করব।
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি, জামায়াতসহ ডানপন্থী ও বামপন্থী কিছু দল নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ডাক দিয়েছে। বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলন যে ব্যাপক জনসমর্থন পাচ্ছে না এবং এসব অবরোধ-হরতাল করে যে নির্বাচন না হওয়ার মতো পরিস্থিতি দেশে তৈরি করতে পারবে না, সেটা বলা যায়।
মানুষের সমর্থন আছে—এমন সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত। তবে কোনো দল যদি দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচন থেকে দূরে থাকে, তাহলে অন্যদের কী করার থাকে? একসময় আমাদের দেশের অর্থনীতি ছিল বিদেশনির্ভর। বাজেট পেশের আগে আমাদের অর্থমন্ত্রীরা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিদেশে ছুটতেন। এখন অর্থনীতি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, রাজনীতি হয়েছে বিদেশনির্ভর।
আর সে জন্যই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে ভূরাজনীতিতেও একটি নতুন সমীকরণ তৈরি হওয়ার অবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা, অন্যদিকে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সুস্পষ্ট অবস্থান বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে যে বলয় তৈরি করছে, তা প্রত্যাশিত না হলেও বাস্তব সত্য। নির্বাচন বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এ দেশের জনগণের, এটা জানার পরও অন্যদের খবরদারি আপত্তিকর। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়াদৌড়ি তো রীতিমতো বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গলদ নেই তা নয়। আমাদের রাজনীতিতে অগ্রগতি, পশ্চাদ্গতি দুটিই আছে। এটা সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। আমেরিকা বা ব্রিটেনও বলতে পারবে না যে তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা শতভাগ ত্রুটিমুক্ত। আমেরিকার গত নির্বাচনের পর সেখানে নজিরবিহীন হামলা হয়েছিল ক্যাপিটল হিলে। পরাজিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো ওই নির্বাচন মেনে নেননি। রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে একসময়কার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কম ভোট পাননি। বলা হয়ে থাকে, ট্রাম্প মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। এক বিব্রতকর মামলায় ফেঁসে যাওয়ার পরও তিনি কম জনপ্রিয় নন। পরবর্তী নির্বাচনের দৌড়েও তিনি এগিয়ে আছেন। জরিপ বলছে, তিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। প্রশ্ন হলো, আমরা কি তাদের প্রার্থীর মান, এমনকি ভোটারদের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলি? তাহলে তারা কেন আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে এত কথা বলে? গণতন্ত্রের জন্য প্রত্যাশা এক জিনিস, আর চাপ সৃষ্টির জন্য নানা তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া আরেক বস্তু। আমেরিকা ও তার মিত্র বলে পরিচিত কিছু দেশের কূটনীতিক ও কর্মকর্তার বাংলাদেশ ঘিরে তৎপরতায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও ক্ষোভ প্রকাশ করে কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমারা বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকে। গবেষণা প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে দেখে থাকে। তা ছাড়া, এসব প্রতিবেদন তারা তৈরি করে সাধারণত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বক্তব্য অনুসরণ করে, একপেশেভাবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমন একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তাদের দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনও যে সুষ্ঠু হয়নি—এ কথা বললে সেটা কি একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে? গণতন্ত্রে আমেরিকার অর্জনকে আমরা অস্বীকার করি না।
‘অভিবাসীদের দেশ’ বলে বর্ণনা করা হয় আমেরিকাকে। আমাদের দেশ থেকেও বহু মানুষ গিয়ে সেখানকার বাসিন্দা হয়েছেন। দেশটির সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কও গভীর। এটা কারও দান নয়; আমাদের অর্জন। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যত সীমাবদ্ধতাই থাকুক, অর্থনীতিতে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, এটা পশ্চিমা দেশগুলোও অস্বীকার করতে পারে না। তারা যে প্রতিবেদনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলেছে, তাতেই আবার অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করেছে। আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি পশ্চিমাদের কাছেও বিস্ময়। তারা তো জানে, বিশ্বব্যাংক ও তার সমমানের সাহায্যদাতা সংস্থাগুলো সরে গেলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ভূমিকায় প্রমত্তা পদ্মার বুকে গড়ে উঠেছে সেতু। তারা এটাও জানে, রাশিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে, যা এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এটির বাস্তবায়ন বিঘ্নিত করতেও নানা তৎপরতা চলছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার বেশ কিছু জাহাজের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমেরিকা। তেমন একটি জাহাজে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল আনা হচ্ছিল। সেটা যাতে বাংলাদেশের বন্দরে না ভিড়তে পারে, তা নিশ্চিত করতে কী না করেছে আমেরিকা? জাহাজটি ভারতের কোনো বন্দরেও যাতে ভিড়তে না পারে, সে জন্য তারা তৎপর ছিল। এটা নজিরবিহীন। ইউক্রেনে রাশিয়া অভিযান পরিচালনা করছে—এ কথা ঠিক। কিন্তু এই যুদ্ধের পেছনে কি আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের হাত নেই? এর ফলে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ায় নিত্যপণ্যের বাজার কত অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে, সেটাও বলা বাহুল্য। পশ্চিমারাও কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। রাশিয়াকে কাবু করার জন্য দেওয়া নিষেধাজ্ঞা তাদের ওপরই গিয়ে আঘাত হানছে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের একটি নির্দোষ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ কেন এ জন্য বিঘ্নিত হবে? এ-ই তাহলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার মার্কিনদের ভূমিকা!
২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে আমরাও গর্ব করি না। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়েও কিছু প্রশ্ন আছে। কিন্তু এর দায় একতরফাভাবে শেখ হাসিনা সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। বাংলাদেশে নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটানো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আদালতের রায়েই বাতিল হয়েছে। এটা আর ফেরত আনার দাবি অযৌক্তিক ও অন্যায্য। নির্বাচনব্যবস্থাকে কীভাবে বিতর্কমুক্ত করা যায়, সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। কিন্তু অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে রাজনৈতিক সরকার গঠনের দাবি করা তো আহাম্মকি। আমেরিকাসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবে হবে। এই বাস্তবতা মানতে না পারা বিএনপি ২০১৪-এর নির্বাচন বানচাল করতে আন্দোলনের নামে কত অপরাধ করেছে, সেটা কি পশ্চিমারা জানে না? তাদের কাছে তো অনেক ছোটখাটো বিষয়েরও খবর থাকে, যা বিভিন্ন ঘটনায় আমরা বুঝতে পারি। গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতাদের হত্যার অপচেষ্টার কথা কি তাদের জানা নেই? তখন কারা ক্ষমতায় ছিল এবং কাদের পরিকল্পনায় হামলা হয়েছিল, তারা নিশ্চয়ই জানে। বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াও গ্রেনেড হামলায় নির্মমভাবে মারা যান বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে। তার পরও তাদের সঙ্গে সংলাপে বসতে হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে, এটাও নির্মম বাস্তবতা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা কিন্তু এসেছিলেন নির্বাচন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ করে। কিন্তু নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে তারা এমনভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়, যাতে এটি বিতর্কিত হয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, তারা নির্বাচনে এসেছিল এটিকে বিতর্কিত করতে।
সেটা করতে তারা একপ্রকার সফলও হয়েছে বলা যায়। অন্তত আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের তারা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে ২০১৮-এর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। আমরা বলব, সেটি মানসম্মত নির্বাচন হয়তো হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ওই নির্বাচনের ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হয়েছে এবং সেই সরকার সফলভাবে দেশ পরিচালনা করে আরেকটি নির্বাচনের সামনে এসে উপনীত হয়েছে।
বাংলাদেশে ভবিষ্যতে যে নির্বাচন হবে, সেটা ২০১৮-এর মতো হবে না—এ কথা সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী এই নিশ্চয়তা দিয়েছেন। কিন্তু মাঠের বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে অনড় এবং দেখা যাচ্ছে, আমেরিকাসহ পশ্চিমা গোষ্ঠী তাদের বাতাস দিচ্ছে। বাক্স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ইস্যু সামনে এনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টাও কম হচ্ছে না। বাংলাদেশ পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। ক্রসফায়ারের ঘটনা অনেক আগে থেকে ঘটে এলেও বর্তমান সরকারের আমলেই বিষয়টিকে ইস্যু করেছে আমেরিকা। র্যাব সাধারণ মানুষের কাছে একপ্রকার জনপ্রিয় হলেও একে বিতর্কিত করার প্রয়াস তারা পেয়েছে কী কারণে, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। নিজেদের দেশে তারা কি ঘন ঘন বন্দুক হামলা থেকে রক্ষা করতে পারছে নিরীহ মানুষকে? তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ কম নয়।
ক্ষমতা মদমত্ত হয়েই যে আমেরিকা আমাদের মতো দেশগুলোর ওপর খবরদারি করছে এবং সেটা তাদের হীন স্বার্থে, এটি কারও বুঝতে বাকি নেই। তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। নিজেদের কাছে অবাধ্য বলে বিবেচিত সরকারকে বাধ্য করতেও তারা এসব করে থাকে। আমেরিকা ইতিমধ্যে অনেক দেশে অনেক অন্যায় হস্তক্ষেপ করেছে। যুদ্ধও চাপিয়ে দিয়েছে অজুহাত খাড়া করে। গণহত্যার আয়োজন করেছে। তাদের মুখে শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বুলি বেমানান। তাদের এটাও বুঝতে হবে, বিশ্ব আর এককেন্দ্রিক নেই। চীনের নব উত্থান হয়েছে এবং রুশ-চীন সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছে ক্রমে। আঞ্চলিক শক্তিগুলোরও উত্থান হচ্ছে। যেমন—ভারত। ভারত-আমেরিকার মৈত্রীও আগের জায়গায় নেই। সৌদি আরবের সঙ্গেও আমেরিকার সম্পর্ক পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ঘটছে নানা পরিবর্তন। এ অবস্থায় মার্কিন খবরদারির সুযোগও সীমিত হয়ে আসছে। আর বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মানুষ যাতে অবাধে ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করে আমেরিকা ও তার সহযোগী বা মিত্রদের সাফ জানিয়ে দিতে হবে, আমাদের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সমস্যার সমাধান আমরাই করব।
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে