হাতির করিডর রক্ষার সুপারিশ

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০৫: ১৩
আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪: ৪৪

কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পে হাতির করিডর রক্ষায় বিশেষজ্ঞদের নির্দেশনা উপেক্ষার অভিযোগ উঠেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁরা বিশদ নিরীক্ষা চালিয়েই এই প্রকল্পের কাজ করছেন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই রেলপথ চালু হলে হাতির চলাচল পথ অনিরাপদ হয়ে পড়বে।

এই প্রকল্পে হাতির চলাচলের সাতটি স্থায়ী পথের পাশাপাশি ৮টি অস্থায়ী পথে আন্ডারপাস, ওভারপাস নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে ২০১৪ সালে জাপানি একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইইউসিএনকে দিয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। ‘এলিফ্যান্ট রুট আইডেন্টিফিকেশন স্টাডি ফর কনস্ট্রাকশন অব সিঙ্গেল লাইন মিটারগেজ রেলওয়ে ট্র্যাক দোহাজারি টু রামু কক্সবাজার’ শিরোনামে পরিচালিত ওই সমীক্ষার প্রতিবেদনে নির্মাণাধীন রেললাইনের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারে রামু পর্যন্ত অংশে হাতি চলাচলের ৭টি স্থায়ী এবং ৮টি অস্থায়ী বা মৌসুমি রুট চিহ্নিত করা হয়। এ সব পথ দিয়ে হাতির চলাচল নির্বিঘ্ন করতে আন্ডারপাস অথবা ওভারপাস তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়।

আইইউসিএনের এই সমীক্ষা রেললাইন প্রকল্পের অধীনে করা হলেও তাঁদের নির্দেশনা পুরোপুরি মানছে না রেলওয়ে। এই সমীক্ষার পরিবর্তে ২০১৭ সালে নিজেদের উদ্যোগে আরেকটি নিরীক্ষা চালায় রেলওয়ে। এর আলোকে মাত্র চারটি আন্ডারপাস এবং একটি ওভারপাস নির্মাণ করছে তারা। বাকি ২টি স্থায়ী ও ৮ অস্থায়ী হাতির চলাচল পথ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি রেলওয়ে।

অন্যদিকে যে পাঁচটি আন্ডারপাস, ওভারপাস করা হচ্ছে সেগুলোও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন হাতি গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘চুনতি রেঞ্জ অফিসের কাছে যে আন্ডারপাসটি নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি আমি দেখেছি। এটি বৈজ্ঞানিক নিয়ম মেনে করা হয়নি। আন্ডারপাসটি উচ্চতা তুলনামূলক কম, তাই এশিয়ান হাতি এই আন্ডারপাস দিয়ে যেতে পারবে না। আইইউসিএন তাদের স্টাডিতে চুনতি অভয়ারণ্য এলাকায় পরিবেশগত ইকোলজি বজায় রেখে আন্ডারপাস অথবা ওভারপাস করার কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে মনে হচ্ছে সেটি মানা হচ্ছে না। তাই হাতির কনজারভেশন পয়েন্ট অব ভিউ থেকে যে রিকয়ারমেন্ট ছিল, সেটি এখানে সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।’

মনিরুল হাসান খান আরও বলেন, ‘আইইউসিএন স্টাডি করে যে সব পয়েন্টে হাতি চলাচলের রুট পেয়েছে, সেগুলোতে আন্ডারপাস অথবা ওভারপাস করার জন্য পরামর্শ দেয়। এখন এটি ঠিকমতো করা না হওয়ার মানে হলো, হাতি সংরক্ষণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মানে কনজারভেশনকে সার্ভ করার জন্য যে সার্ভিসটা পাওয়ার কথা ছিল সেটি পাওয়া যাবে না। আইইউসিএন ২০১৪ সালে স্টাডি করেছে, একটি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান স্টাডি করার পর রেলওয়ের পুনরায় একই ইস্যু নিয়ে কাজ করার দরকার ছিল না। তারা হাতি চলাচলের রুট চিহ্নিত করেছেন।’ তাই রেলওয়ের এগুলোর প্রত্যেকটিতে হাতি চলাচল নিরাপদ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।

সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফের ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রেলওয়ে। ২০১০ সালের ৬ জুলাই প্রকল্পটি একনেক বৈঠকে অনুমোদন দেওয়ার পর ২০১৩ সালে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে মাঠপর্যায়ে কাজ শেষ হওয়ার পর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি কাজ শেষও হয়েছে।

প্রকল্প প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে ১০০ দশমিক ৮৩১ কিলোমিটার রেলপথ। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণ করা হবে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭২৫ কিলোমিটার রেলপথ। দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ১০ কিলোমিটার রেললাইন সংরক্ষিত বন চুনতি অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। রেললাইনের এই অংশে হাতি চলাচলের বেশ কয়েকটি রুট থাকায়, সেগুলো নিরাপদ না রাখলে ভবিষ্যতে ট্রেনের সঙ্গে হাতির সংঘর্ষ হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন তাঁরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে রেলওয়ের হয়েই ২০১৪ সালে আইইউসিএন সমীক্ষা চালায়। এই সমীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল, হাতির চলাচল পথগুলো চিহ্নিত করে, এগুলো নিরাপদ রাখতে মিটিগেশন পদক্ষেপগুলো তুলে ধরা। সমীক্ষায় চুনতি অভয়ারণ্যে তিনটি হাতি চলাচলের স্থায়ী রুট, চারটি মৌসুমি চলাচল পথ, ফাঁসিয়াখালীতে দুটি স্থায়ী রুট এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্ক এলাকায় দুটি মৌসুমি চলাচল পথ চিহ্নিত করা হয়। এর বাইরে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত আরও দুটি স্থায়ী এবং দুটি মৌসুমি রুট চিহ্নিত করা হয়।

জানতে চাইলে আইইউসিএনের বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ মো. রাকিবুল আমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা স্টাডিতে কী কী মিটিগেশনস পদক্ষেপ নিতে পারে সেখানে দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম। কোথায় কোথায় আন্ডারপাস, ওভারপাস দিতে হতে পারে। সেখানে আমরা দেখিয়েছি, রেললাইনের কারণে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ৭টি স্থায়ী করিডর রেললাইনের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া হাতির ৮টি অস্থায়ী চলাচল পথ রেললাইনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই ১৫টি চলাচল ৭টি স্থায়ী পথে আন্ডারপাস অথবা ওভারপাস করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। জায়গাটির অবস্থানগত দিক বিবেচনায় যদি এসব স্থানে ওভারপাস করা উচিত তাহলে ওভারপাস করতে হবে। আর যদি আন্ডারপাস করা দরকার হয়, তাহলে সেখানে আন্ডারপাস করবে। তবে সাতটি স্থায়ী চলাচল পথে আন্ডারপাস অথবা ওভারপাস করতেই হবে।’

আইইউসিএনের স্টাডিটি কেন বাস্তবায়ন করা হয়নি জানতে চাইলে কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আইইউসিএনের স্টাডিটি হাতির পায়ের চিহ্ন, মল—এসব বিষয় নির্ধারণের মাধ্যমে করা হয়। তাই আমরা আরও বিশদ নিরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিই। আমরা ওই সব এলাকায় দুই বছর ক্যামেরা ফিট করে দেখেছি হাতি কোন কোন রুট দিয়ে যায়। পর্যবেক্ষণে আমরা দেখেছি, চুনতির রেঞ্জ অফিসের পাশের করিডর দিয়েই হাতি বেশি চলাচল করে। ওই এলাকায় আমরা তিনটি স্থায়ী হাতি চলাচলের পথ পেয়েছি। ওই তিনটি রুটের দুটি আন্ডারপাস ও একটি ওভারপাস করছি। আরও দুটি আন্ডারপাসের একটি ফাঁসিয়াখালীতে, অন্যটি মেধাকচ্ছপিয়া এলাকায়। আন্ডারপাসগুলো ইতিমধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।’

আন্ডারপাসগুলোর উচ্চতা কম এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা কাজ করতে গেলে অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করে। আমাদের কনসালট্যান্ট আমেরিকান, যাঁরা এগুলো নিয়ে খুব বেশি সচেতন। তাঁরা হাতি, জীববৈচিত্র্য নিয়েই কাজ করে। তাঁরা তিন মাস পর পর এসে পর্যবেক্ষণ করে যান। তাঁরা এগুলো নিয়ে কোনো আপত্তি জানাননি।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত