বিভুরঞ্জন সরকার
পাকিস্তান ছিল একটি অদ্ভুত রাষ্ট্র। পূর্ব ও পশ্চিম—দুই ভাগে বিভক্ত এই রাষ্ট্রের মধ্যে কেবল ভৌগোলিক দূরত্ব নয়, ছিল ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্যগত প্রভেদ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য।
শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস যে একটি রাষ্ট্রের ঐক্য রক্ষার প্রধান ভিত্তি হতে পারে না, তা স্পষ্ট হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যে, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি ঘিরে। বাঙালি ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। অথচ বাংলাকে উপেক্ষা করে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করায় ১৯৪৮ সালেই শুরু হয় ভাষা-বিক্ষোভ। আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন। এই সময়ে আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি যে বিস্ফোরণ ঘটে, তাতে জ্বালানি জুগিয়েছেন অনেক প্রতিবাদী ছাত্র-যুব, নেতা-কর্মী। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম।
তবে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের আগে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের বিষয়টি সেভাবে সামনে আসেনি বা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়নি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু নিজেই ভাষা আন্দোলনের ঘটনাক্রম ও তাঁর ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন।
শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন শুরু থেকে। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সংবিধান সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু কেবল উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে চায় মুসলিম লীগ সরকার। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৯১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করল।’
সংগ্রাম পরিষদ গঠন হলে শেখ মুজিবসহ নেতা-কর্মীরা কাজে নেমে পড়েন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম।’
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানে প্রথম সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। ওই দিন শেখ মুজিবসহ ৭০-৭৫ জনকে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু তাতে আন্দোলন দমানো যায়নি। ১৫ মার্চ তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সাধারণ ছাত্রসভায় শেখ মুজিব সভাপতিত্ব করেন।
১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েও শেখ মুজিব দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজিউল হক তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনকারী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।’
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১৯৬ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী নেতাদেরও খবর দিয়েছি।...আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে।...খবর পেয়েছি আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি।’
১৯৭ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।’
সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের দিন ধার্য করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল জনগণও এগিয়ে আসবে ভাষা আন্দোলনে। কারণ, তারা জানে রাষ্ট্রভাষা না হলে আবার দাসত্বের শিকল পরতে হবে। শেখ মুজিব জেলে থাকলেও আন্দোলনে সম্পৃক্ত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হতো নিয়মিত, সলাপরামর্শ হতো। এর মধ্যে তাঁকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ২০৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না”, “শেখ মুজিবের মুক্তি চাই”, “রাজবন্দীদের মুক্তি চাই”, আরও অনেক স্লোগান।’
ভাষার মিছিলে গুলিতে শহীদ হওয়া নিয়ে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল।...আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে, তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে।’
অনশনের কারণে শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। অসুস্থ শেখ মুজিব গ্রামের বাড়িতে চলে যান। জেল থেকে বের হয়ে তিনি জেনেছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি হওয়ার খবর গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে গেছে। ছোট ছোট হাট-বাজারেও হরতাল হয়েছে। দেশের জনগণ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা ছাড়া উপায় নেই। কেবল তা-ই নয়, যারা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বলেছে, তারাও ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেছে। জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শোষকেরাও ভয় পায়।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিবৃতি দিলে মুসলিম লীগের পত্রিকায় বিকৃতি করে ছাপা হয়। শেখ মুজিব তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ২১২ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘এদিকে মুসলিম লীগের কাগজগুলি শহীদ সাহেবের বিবৃতি এমনভাবে বিকৃত করে ছাপিয়েছে যে মনে হয় তিনিও উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হোক এটাই চান। আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে এবং যাঁরা ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলাম। সরকার যে বলেছে, বিদেশী কোন রাষ্ট্রের উসকানিতে এই আন্দোলন হয়েছে, তার প্রমাণ চাইলাম।’
পাকিস্তান সরকার আগাগোড়া ভাষা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা ঢাকায় এসে পায়জামা পরে ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে। শেখ মুজিব একাধিক প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে।
ভাষা আন্দোলনের প্রভাব শেখ মুজিবের ওপর ব্যাপকভাবেই পড়েছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরের বছরগুলোতে রাজনৈতিক আন্দোলনে সাহসী ও দৃঢ় ভূমিকা পালন করে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সত্তরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ পেল অভূতপূর্ব বিজয়। জনগণের রায় পেয়ে তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার বদ মতলব ব্যর্থ করতে আর দ্বিধায় ভোগেননি।
শেখ মুজিব জানতেন শিগগিরই জনগণকে লড়তে হবে। তাই মানুষকে বারবার বলেছেন প্রস্তুত থাকতে। তিনি ছিলেন দূরদর্শী নেতা। শেখ মুজিব একাত্তরের শহীদ দিবসে বলেন, ‘আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। শহীদ দিবসে আপনারা এখানে এসেছেন, ১২টা ১ মিনিটের সময় আমি মাজারে গিয়েছি, সেখান থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি। বাঙালিরা বহু রক্ত দিয়েছে। ১৯৫২ সালে যে রক্ত দেওয়া শুরু হয়েছে সে রক্ত আজও শেষ হয় নাই, কবে হবে তা জানি না। আজ শহীদ দিবসে শপথ নিতে হবে, যে পর্যন্ত না ৭ কোটি মানুষ তার অধিকার আদায় করতে না পারবে, সে পর্যন্ত বাংলার মা-বোনেরা, বাংলার ভাইয়েরা আর শহীদ হবে না, গাজী হবে।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আজকে শহীদ দিবসে আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, ঘরে ঘরে আপনারা দুর্গ গড়ে তোলেন। আমরা সকলের সহানুভূতি, ভালোবাসা চাই।’
এই বক্তব্যের মাসখানেক পরেই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালালে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে লাখো প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা হয়তো তিনি ছিলেন না, কিন্তু ওই আন্দোলনে তিনি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই রোপিত হয়েছিল বাঙালির স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের বীজ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পাকিস্তান ছিল একটি অদ্ভুত রাষ্ট্র। পূর্ব ও পশ্চিম—দুই ভাগে বিভক্ত এই রাষ্ট্রের মধ্যে কেবল ভৌগোলিক দূরত্ব নয়, ছিল ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্যগত প্রভেদ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য।
শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস যে একটি রাষ্ট্রের ঐক্য রক্ষার প্রধান ভিত্তি হতে পারে না, তা স্পষ্ট হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যে, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি ঘিরে। বাঙালি ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। অথচ বাংলাকে উপেক্ষা করে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করায় ১৯৪৮ সালেই শুরু হয় ভাষা-বিক্ষোভ। আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন। এই সময়ে আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি যে বিস্ফোরণ ঘটে, তাতে জ্বালানি জুগিয়েছেন অনেক প্রতিবাদী ছাত্র-যুব, নেতা-কর্মী। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম।
তবে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের আগে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের বিষয়টি সেভাবে সামনে আসেনি বা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়নি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু নিজেই ভাষা আন্দোলনের ঘটনাক্রম ও তাঁর ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন।
শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন শুরু থেকে। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সংবিধান সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু কেবল উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে চায় মুসলিম লীগ সরকার। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৯১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করল।’
সংগ্রাম পরিষদ গঠন হলে শেখ মুজিবসহ নেতা-কর্মীরা কাজে নেমে পড়েন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম।’
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানে প্রথম সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। ওই দিন শেখ মুজিবসহ ৭০-৭৫ জনকে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু তাতে আন্দোলন দমানো যায়নি। ১৫ মার্চ তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সাধারণ ছাত্রসভায় শেখ মুজিব সভাপতিত্ব করেন।
১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েও শেখ মুজিব দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজিউল হক তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনকারী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।’
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১৯৬ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী নেতাদেরও খবর দিয়েছি।...আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে।...খবর পেয়েছি আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি।’
১৯৭ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।’
সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের দিন ধার্য করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল জনগণও এগিয়ে আসবে ভাষা আন্দোলনে। কারণ, তারা জানে রাষ্ট্রভাষা না হলে আবার দাসত্বের শিকল পরতে হবে। শেখ মুজিব জেলে থাকলেও আন্দোলনে সম্পৃক্ত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হতো নিয়মিত, সলাপরামর্শ হতো। এর মধ্যে তাঁকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ২০৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না”, “শেখ মুজিবের মুক্তি চাই”, “রাজবন্দীদের মুক্তি চাই”, আরও অনেক স্লোগান।’
ভাষার মিছিলে গুলিতে শহীদ হওয়া নিয়ে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল।...আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে, তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে।’
অনশনের কারণে শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। অসুস্থ শেখ মুজিব গ্রামের বাড়িতে চলে যান। জেল থেকে বের হয়ে তিনি জেনেছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি হওয়ার খবর গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে গেছে। ছোট ছোট হাট-বাজারেও হরতাল হয়েছে। দেশের জনগণ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা ছাড়া উপায় নেই। কেবল তা-ই নয়, যারা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বলেছে, তারাও ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেছে। জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শোষকেরাও ভয় পায়।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিবৃতি দিলে মুসলিম লীগের পত্রিকায় বিকৃতি করে ছাপা হয়। শেখ মুজিব তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ২১২ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘এদিকে মুসলিম লীগের কাগজগুলি শহীদ সাহেবের বিবৃতি এমনভাবে বিকৃত করে ছাপিয়েছে যে মনে হয় তিনিও উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হোক এটাই চান। আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে এবং যাঁরা ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলাম। সরকার যে বলেছে, বিদেশী কোন রাষ্ট্রের উসকানিতে এই আন্দোলন হয়েছে, তার প্রমাণ চাইলাম।’
পাকিস্তান সরকার আগাগোড়া ভাষা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা ঢাকায় এসে পায়জামা পরে ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে। শেখ মুজিব একাধিক প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে।
ভাষা আন্দোলনের প্রভাব শেখ মুজিবের ওপর ব্যাপকভাবেই পড়েছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরের বছরগুলোতে রাজনৈতিক আন্দোলনে সাহসী ও দৃঢ় ভূমিকা পালন করে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সত্তরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ পেল অভূতপূর্ব বিজয়। জনগণের রায় পেয়ে তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার বদ মতলব ব্যর্থ করতে আর দ্বিধায় ভোগেননি।
শেখ মুজিব জানতেন শিগগিরই জনগণকে লড়তে হবে। তাই মানুষকে বারবার বলেছেন প্রস্তুত থাকতে। তিনি ছিলেন দূরদর্শী নেতা। শেখ মুজিব একাত্তরের শহীদ দিবসে বলেন, ‘আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। শহীদ দিবসে আপনারা এখানে এসেছেন, ১২টা ১ মিনিটের সময় আমি মাজারে গিয়েছি, সেখান থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি। বাঙালিরা বহু রক্ত দিয়েছে। ১৯৫২ সালে যে রক্ত দেওয়া শুরু হয়েছে সে রক্ত আজও শেষ হয় নাই, কবে হবে তা জানি না। আজ শহীদ দিবসে শপথ নিতে হবে, যে পর্যন্ত না ৭ কোটি মানুষ তার অধিকার আদায় করতে না পারবে, সে পর্যন্ত বাংলার মা-বোনেরা, বাংলার ভাইয়েরা আর শহীদ হবে না, গাজী হবে।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আজকে শহীদ দিবসে আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, ঘরে ঘরে আপনারা দুর্গ গড়ে তোলেন। আমরা সকলের সহানুভূতি, ভালোবাসা চাই।’
এই বক্তব্যের মাসখানেক পরেই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালালে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে লাখো প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা হয়তো তিনি ছিলেন না, কিন্তু ওই আন্দোলনে তিনি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই রোপিত হয়েছিল বাঙালির স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের বীজ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে