Ajker Patrika

উচ্চশিক্ষার ব্যয় বেড়েই চলেছে

রবিউল আলম, ঢাকা
আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২২, ০৮: ৪৯
উচ্চশিক্ষার ব্যয়  বেড়েই চলেছে

সাতক্ষীরার দরিদ্র মৎস্যজীবী আজিত বিশ্বাসের তিন মেয়ের মধ্যে বড় মারুফা খাতুন এবার সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। তবে তাঁর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থসংকট।

একই সমস্যায় পড়েছিলেন ভ্যানে করে গাছ বিক্রির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের তাজগীর হোসেন। তিনি এবার খুলনা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।

এই দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁদের খবর সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানা গেছে, তাঁদের স্বপ্নপূরণের সারথি হতে কেউ কেউ এগিয়ে এসেছেন। আর যাঁদের হয়নি তাঁরা ধারদেনা করে কোনোমতে ভর্তি হয়েছেন। তবে ব্যয়বহুল এই উচ্চশিক্ষায় টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় প্রতিমুহূর্তে তাঁদের ওপর ভর করে আশঙ্কা।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল বা প্রকৌশল ছাড়াও সাধারণ বিষয়ে পড়াশোনার খরচ বাড়ছে। ফলে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী কাজী ইয়াসমিন আরা বীথি আজকের পত্রিকাকে বলেন, বছরের পর বছর বিভিন্ন ফি বৃদ্ধি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের পথে বড় একটি বাধা।

সবকিছুর দাম বাড়ছে, এ অজুহাত দিয়ে উচ্চশিক্ষার খরচ বাড়ানো অযৌক্তিক। কারণ, শিক্ষা তো বাজারের অন্য দশটা পণ্যের মতো নয়।

আয় বাড়াতে হবে

খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আয় বাড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্রের পরামর্শ অনুযায়ী, দেশে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে সন্ধ্যা কোর্স চালু হয়েছে। সন্ধ্যা কোর্সের অধীনে এমবিএসহ নানা ডিগ্রি নিতে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা করে খরচ হচ্ছে।

শিক্ষাবিস্তারে এই সন্ধ্যা কোর্স চালু বলা হলেও কোর্সগুলোর এত বিপুল অর্থ নেওয়ার প্রক্রিয়াকে সনদ বিক্রি করে টাকা আয়ের পন্থা হিসেবে দেখছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, শুধু সন্ধ্যা কোর্স নয়, ইউজিসির কৌশলপত্রের পর গত ১৫ বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ছোট থেকে শুরু করে মাঝারি ও বড় আয়োজনের অধিকাংশেই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম ও লোগো ব্যবহার কয়েক গুণ বেড়েছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপও এর একটি অংশ। তবে এখনো উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি।

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ছিল কমপক্ষে ৭২ হাজার ৮৯২ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ভেদে এ ব্যয় ৩ থেকে ৪ গুণ বা এরও বেশি। কোর্স ফি, ল্যাব ফি, ভর্তি ফি, অন্যান্য খরচসহ ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রনিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের একজন শিক্ষার্থীর এক বছরের প্রাতিষ্ঠানিক খরচ প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

অন্যদিকে জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া একই সময়ে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় ছিল ১ হাজার ৭৮৬ টাকা। এই ব্যয়ের বাইরেও প্রতিবছর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়। গত কয়েক বছর এই খরচ ক্রমেই বাড়ছে।

Captureগত কয়েক বছর উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন বর্ষে ভর্তি ফি, হলের বিভিন্ন ফিসহ নানা রকমের ফি কয়েক গুণ বেড়েছে। ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে হল স্থাপনা চাঁদাসহ মোট খরচ ছিল ১ হাজার ৩৭০ টাকা। অথচ ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১০০ টাকায়।

এ ছাড়া এই সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয়ও বেড়েছে কয়েক গুণ। ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় ছিল সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। আর ২০২০ সালে এই আয়ের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৬৪ কোটি ৫২ লাখ টাকায়। অর্থাৎ এই ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টির অভ্যন্তরীণ আয় বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। স্বাভাবিকভাবেই অভ্যন্তরীণ এই আয়ের প্রায় সবটুকুই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ফি বাবদ আদায় করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।

প্রাথমিকেও বাড়ছে খরচ

শুধু উচ্চশিক্ষা নয় প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও পড়াশোনার খরচ বৃদ্ধিও কোনো অংশে কম নয়। বরং সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয় অনেক বেশি করতে হয় অভিভাবকদের।

বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন পুরান ঢাকার রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘আমার দুই সন্তানের একজন নবম এবং আরেকজন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। দুই সন্তানের টিউশনি বাবদ ৮ হাজার টাকাসহ পড়াশোনার খরচ মেটাতেই আয়ের এক-তৃতীয়াংশ চলে যায়। তার ওপর রয়েছে বাসাভাড়া আর অন্য খরচ। ফলে এত টাকা আয় করেও মাস শেষে কিছুই থাকে না।

`বাংলাদেশ টিউটর প্রোভাইডারস’ অ্যাসোসিয়েশনের মতে, গত ৫ বছরে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, বাড়িভাড়া বৃদ্ধিসহ কয়েকটি কারণে টিউশন ফি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এ ছাড়া ইউনেসকোর ২০২১-২২ গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টে বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ৭ শতাংশ পরিবারকে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ঋণ নিতে হয়।

মন্ত্রীর বক্তব্য ও বিতর্ক

এদিকে কয়েক বছর ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছে সরকার। সম্প্রতি সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিনা মূল্যে পড়ার সংস্কৃতি থেকে সরে আসা দরকার। ঠিক তেমনি যাঁদের দেওয়ার ক্ষমতা আছে, শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা আছে, তাঁরা সেই ব্যয়ভার বহন করেই শিক্ষা গ্রহণ করবেন।

শিক্ষামন্ত্রীর এমন বক্তব্যের প্রতিবাদও করেছে কয়েকটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠন। তারা বলছে, ইউজিসির কৌশলপত্রে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণকে উৎসাহিত করছে। শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য তারই প্রতিফলন।

তবে শিক্ষায় আরও বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন। তিনি বলেন, শিক্ষা একপ্রকার বিনিয়োগ। তাই অন্য জিনিসের সঙ্গে এর তুলনা হওয়া সমীচীন নয়। নাগরিকের জন্য শিক্ষায় এই বিনিয়োগের মূল দায়িত্ব সরকারের। উল্টো সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অভ্যন্তরীণ আয় আরও বাড়াতে চাপ দিচ্ছে।

উচ্চশিক্ষা সবার জন্য না

সার্বিক বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান (দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত ফির চাপ নয়, বরং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গবেষণা করার জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উৎসাহিত করি। গবেষণা করলে বিদেশ থেকে তহবিল আসবে। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব আয় বাড়বে।’ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কার্যকর সংযোগ প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, এটা হলে শিক্ষকেরা শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করবেন। এর বিনিময়ে তাঁরা ভালো তহবিল পাবেন। এটা করতে পারলে আয় বাড়ানো কঠিন কাজ না। তবে এটাও মনে রাখা দরকার উচ্চশিক্ষা একেবারে সবার জন্য না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান হওয়া ইরানি নারী এখন পানামার জঙ্গলে

বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা হলেই মেয়াদ শেষ নতুন পরিচালনা কমিটির

ঢাবি ছাত্রীকে যৌন হেনস্তাকারীর পক্ষে নামা ‘তৌহিদী জনতার’ আড়ালে এরা কারা

এনসিপিকে চাঁদা দিচ্ছেন ধনীরা, ক্রাউডফান্ডিং করেও অর্থ সংগ্রহ করা হবে: নাহিদ ইসলাম

ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান, সন্তানসহ ছিটকে পড়তেই তরুণীর গালে ছুরিকাঘাত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত