অগ্নিনিরাপত্তা অভিযানে কঠোর বার্তা

বিশেষ প্রতিনিধি ও নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪, ০৮: ২৪

ঘটনা ভয়াবহ, রাজধানীতে এক আগুনে একসঙ্গে ৪৬ জনের মৃত্যু। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা ভয়ানক অনিয়ম-অবহেলার ফল এটা। সমাজ-রাষ্ট্রে বড় ঝাঁকুনি দিয়েছে এ ঘটনা। তাই বেশ নড়েচড়ে বসেছে কর্তৃপক্ষ। একসঙ্গে জোরালো অভিযানে নেমেছে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবগুলো সংস্থা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অভিযানের মধ্য দিয়ে অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে কঠোর বার্তা দিচ্ছে সরকার। অভিযান চলবে অনেক দিন। ভবন ব্যবহারে শৃঙ্খলা ফিরে না আসা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। যদিও হঠাৎ করে এমন অভিযানে কিছুটা আতঙ্কিত রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা।

আসন্ন রমজানের মধ্যেও এ অভিযান চলবে বলে জানালেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মুখপাত্র ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম। তবে ব্যবসায়ীদের অযথা শঙ্কিত না হওয়ার আহ্বানও জানাচ্ছেন তিনি।

ব্যবসা করতে গিয়ে জনসাধারণের জানমালের ক্ষতি হবে—এমন আশঙ্কা থাকলে রেস্তোরাঁ চালাতে দেওয়া হবে না জানিয়ে আশরাফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আদালত প্রথমে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা চিহ্নিত করবেন। পরে ঝুঁকির পরিমাণের মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কোনো ব্যবসায়ী যাতে অযাচিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেদিকেও আমরা খেয়াল রাখব।’

রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের একটি ভবনে গত বৃহস্পতিবার রাতে আগুন লাগে। ওই এক ভবনে চলছিল ১৭টি রেস্তোরাঁ। রাতে খেতে যাওয়া মানুষসহ ৪৬ জনের প্রাণ গেছে ভয়াবহ সেই আগুনে।

আগুনের সেই ভয়াবহ ঘটনার পর গত দুই দিনে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) নগরীর মোট ৪৫৫টি হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে। মামলা হয়েছে পাঁচটি। ডিএমপি রেস্তোরাঁগুলোয় অভিযান অব্যাহত রাখবে বলে জানিয়েছে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মহানগরীর যেখানেই নাগরিকদের জন্য কোনো জায়গা, ভবন বা এলাকা অনিরাপদ মনে হবে, সেখানে পুলিশ অভিযান চালাবে।’

তবে মহিদ উদ্দিন একথাও বলেন, ‘আমরা কোনো রেস্তোরাঁ বা ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান করছি না। যেখানে অনিরাপদ বস্তু ও দাহ্য পদার্থ অনিরাপদভাবে রাখা হয়েছে, সেখানেই আমাদের অভিযান হবে।’

একইভাবে অভিযানে নেমেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও (ডিএসসিসি)। তাদের অভিযান অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘অসাধু রেস্তোরাঁমালিকেরা সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত অভিযান থামবে না।’

আগেই খবর পাচ্ছেন রেস্তোরাঁমালিকেরা
গতকাল মঙ্গলবার খিলগাঁও এলাকায় অভিযান চালায় ডিএসসিসি। তবে অভিযানকারী দল খিলগাঁও এলাকায় পৌঁছানোর আগেই সেখানের সব রেস্তোরাঁ বন্ধ করে ফেলা হয়। রেস্তোরাঁর সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সাময়িক বন্ধের নোটিশ। সেসব নোটিশে ‘রেস্টুরেন্টের উন্নয়নকাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটি সাময়িক বন্ধ, আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ’ লেখা ছিল।

তালতলার শহীদ বাকি সড়কে নাইটিঙ্গেল স্কাই ভিউ টাওয়ারে অভিযান চালানোর সময় শুধু শর্মা হাউস রেস্তোরাঁ পরিদর্শন করতে পারেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া এই ভবনের বাকি পাঁচটি রেস্তোরাঁ বন্ধ পাওয়া যায়। তবে বেসমেন্ট রেস্টুরেন্ট, অপ্রশস্ত সিঁড়ি এবং পুরো ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকায় ভবনটি সাময়িক সিলগালা করা হয়। গত সোমবারও ধানমন্ডিতে অভিযানের সময় একই অবস্থা দেখা গেছে।

ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘রেস্টুরেন্টের মালিকেরা আগেই খবর পেয়ে সব বন্ধ করে পালিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো কোনোভাবে তাঁরা আগেই খবর পেয়ে যাচ্ছেন। এটা আমরা সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। আমরা ভিন্ন কোনো কৌশলের কথা ভাবব।’

এ ছাড়া বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজসংলগ্ন বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায় রাজউক। অভিযানে নবাবী ভোজ ও সুলতান’স ডাইন নামে দুটি রেস্তোরাঁ সিলগালা করা হয়েছে।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম জানা, রোববার থেকে ডিএনসিসির সব অঞ্চলেই অভিযান চালানো হচ্ছে। দুটি রেস্তোরাঁ সিলগালা করা হয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৫-৬ লাখ টাকা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনায় নোটিশ দিয়ে আসা হয়েছে।

মামলা সিআইডিতে
আগুনে ৪৬ জন নিহতের ঘটনায় পুলিশের করা মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সিআইডির ঢাকা মেট্রোপলিটন দক্ষিণের বিশেষ পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, মামলাটি আদালত সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সিআইডি মামলাটি নির্দেশ অনুযায়ী তদন্ত করবে। তবে গতকাল পর্যন্ত সিআইডি মামলাটির ডকেট পায়নি। ডকেট পাওয়ার পর কাজ শুরু হবে।

এদিকে এই ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। প্রয়োজন হলে সিআইডি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ফের রিমান্ড আবেদন করবে।

সচেতনতায় সক্রিয় তিন সংগঠন
জাতীয় প্রেসক্লাবে গতকাল ‘ভবনে বিপজ্জনকভাবে আচ্ছন্ন নগরী: প্রেক্ষিতে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে তিন সংগঠন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) যৌথভাবে এ আয়োজন করে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সারা দেশে গত ৯ বছরে প্রায় ২ লাখ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১ হাজার ৫১ জন নিহত এবং আহত হয়েছে ৩ হাজার ৬০৬ জন। এসব অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ হচ্ছে অননুমোদিত অবৈধ ভবন, অবৈধ ভূমি ব্যবহার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদারকির অভাব।

এ সময় বাসযোগ্য নিরাপদ নগরায়ণ গড়ে তুলতে তিনটি সংগঠন ১১ দফা দাবির কথা জানায়।

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ পড়েন বাপার সহসভাপতি ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘এখনো আমরা একটি নিরাপদ এবং অভিঘাত-সহনশীল নগরী গড়ে তুলতে পারিনি। নগরে সংঘটিত অগ্নিদুর্যোগ আজ বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে।’

বিআইপির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রেস্তোরাঁগুলোতে অভিযান চালিয়ে যেসব সাধারণ কর্মী আছেন, শুধু তাঁদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

ভিডিও কলে যুক্ত থেকে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ঢাকায় নতুন নতুন ভবন হবে আর এই ভবনগুলো একেকটা আগুনের গোলায় পরিণত হবে। সরকারকে মানুষের জীবনের দাম দিতে হবে।

বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনার পর অগ্নিঝুঁকিতে থাকা বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলোয় জোরালো অভিযান চালাচ্ছে রাজউক ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কোথাও কোথাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নিজ উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট-ভবন বন্ধ করে দিয়েছেন। গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডে। ছবি: আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত