অপার সৌন্দর্যের দেশ মালদ্বীপ

ড. মো. গোলাম রহমান
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২২, ০৭: ৩০
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২২, ১২: ১৮

সাগরঘেরা দ্বীপপুঞ্জ, বিশ্বের অন্যতম ভৌগোলিকভাবে ছড়িয়ে পড়া এবং ক্ষুদ্রতম সার্বভৌম রাষ্ট্র হচ্ছে মালদ্বীপ। মালদ্বীপের উচ্চতা বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে সর্বনিম্নে। শ্রীলঙ্কা ও ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এশিয়া মহাদেশের অন্যতম পর্যটক আকর্ষিত দেশ মালদ্বীপ। এশিয়া মহাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে এর অবস্থান প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার (৪০০ নটিক্যাল মাইল) দূরে। লোকজন মালদ্বীপকে সারা বছর এক ঋতুর দেশ বলে মানে। যদিও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবই প্রধান। গড় তাপমাত্রা ওপরে ৩১ আর নিচে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর প্রায় একই তাপমাত্রা। বেশ মজার। ঋতুর কারণে কাপড়চোপড়ের বৈচিত্র্য নেই তবে দ্বীপের অধিবাসীদের রং-চঙের পোশাক পরতে দেখা যায়।

বাংলাদেশ থেকে বেড়ানোর জন্য এমন আকর্ষণীয় দ্বীপমালার তুলনা নেই। বিশ্বের অনেক দেশের সমুদ্রসৈকত নানাবিধ কারণে পর্যটকদের টানে। আমাদের কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, ছেঁড়া দ্বীপ কিংবা কুয়াকাটা যথেষ্ট আকর্ষণীয় কিন্তু বিশ্ববাজারে আমরা তার মার্কেটিং করতে পারিনি। বাংলাদেশে যে বিদেশিরা কাজকর্মে আসেন, তাঁরা এই সমুদ্রসৈকতগুলো দেখতে আসেন। শুধু কক্সবাজার কিংবা ছেঁড়া দ্বীপ বেড়ানোর জন্য কজন আর আসেন?

ভারতের ত্রিবান্দ্রাম কোভালাম সি বিচ যথেষ্ট পর্যটক টানে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার সঙ্গে কেউ কেউ একে তুলনা করেন। কোভালাম মানে হচ্ছে নারকেলগাছের বাগান। সেই এলাকায় নারকেলগাছের আধিক্য তার পরিচয় বজায় রেখেছে। নব্বইয়ের দশকে কয়েক দিন থাকার সুযোগ হয়েছিল। এই বিচের দৈর্ঘ্য ১৭ কিলোমিটার কিন্তু পাথরের পাহাড় এটিকে তিন খণ্ড করে তিনটি পৃথক বিচ তৈরি করেছে। একটি লাইট হাউস, দ্বিতীয়টি হাওয়া বিচ আর তৃতীয়টি হলো সমুদ্র বিচ। শহরের অন্যতম ভিড় পরিলক্ষিত হয় এই বিচে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ভিড় জমায় সোনালি মোটা বালুর এই সৈকতে। গরমের সময় জনসমাগম কমে যায় ১৫-২০ হাজারে। ভারতের দক্ষিণ কেরালার কচি শহরের আদি নাম কোচিন। আরব সাগরের ফোর্ট কচি বিচ হচ্ছে শান্ত-সৌম্য নিরিবিলি। এই সি বিচকে ‘কুইন অব দ্য এরাবিয়ান সি’ বলা হয়। ইউরোপের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় পর্তুগিজ রাজত্ব চলেছিল। ১৪৯৮ সালে ভাস্কো-দা-গামা ভারতে পৌঁছেন কেরালার কালিকটে। সেখানে ফোর্ট এমানুয়েল (ফোর্ট কচিও বলা হয়) নির্মাণের অনুমতি লাভ করেন। পর্তুগিজদের এই নিদর্শন পর্যটকদের আকর্ষণ করে কোচি সি বিচও।

এদিকে চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচের সঙ্গে মুম্বাইয়ের জুহু সি বিচেরও কথা প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। ভিড় হয় জুহু বিচেও। যদিও জুহু খুব বিস্তৃত সৈকত নয়। শিলান্যাসের কারণে জুহু ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে, তবে মুম্বাইয়ের জনারণ্যের কারণে পর্যটকদের জন্য প্রশান্তির কোনো বার্তা দেয় না এই বিচ। থাইল্যান্ডের পাতায়া, ফি ফি আইল্যান্ড কিংবা দ্বীপ কোহ সামুই পর্যটকদের যথেষ্ট কোলাহলে ক্লান্ত। মালয়েশিয়ার লঙ্কাবি বিচও জনপ্রিয় দেখেছি।

ভারতের আরেকটি ছোট্ট প্রদেশ গোয়া, যেটি পর্তুগিজ আমলের অনেক নিদর্শন নিয়ে সমুদ্রবেষ্টিত হয়ে আকর্ষণ করছে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের। গোয়ার বিভিন্ন সোনালি ঝরঝরে বালুর সৈকত আর স্থানীয় পানাহারের আকর্ষণে প্রচুর পর্যটক যাওয়া-আসা করে। একইভাবে শ্রীলঙ্কার চারদিক ঘিরে থাকা অফুরন্ত সমুদ্রসৈকত নানা আয়োজনে, বিশেষ করে নারকেল ও নারকেল তেলের স্থানীয় রান্না করা খাবারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের বিদেশি খাবারের আয়োজনও স্থানীয় পানীয় পর্যটকদের হাতছানি দেয়। দেখেছি পাপুয়া নিউগিনিতে প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জল, নীল আকাশের প্রাকৃতিক পরিবেশে সমুদ্রসৈকতে নিরিবিলি জীবন উপভোগ করা। ইন্দোনেশিয়ার হাজারো দ্বীপমালার কত বৈচিত্র্যময় সাগরের লোনাজলে পায়ে-পায়ে হাঁটা। তা হোক বালিকাপাপান দ্বীপের শান্ত সৈকত কিংবা জনবহুল জাকার্তার অ্যাঙ্কল বিচ। যাঁরা সমুদ্র দেখতে চান, শত শত বিচের ইশারায় গিয়ে হাজির হন। বালি হলো আরেকটি পর্যটকসমৃদ্ধ বিচ, ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমপ্রধান সংস্কৃতি থেকে পুরো ভিন্ন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির উল্লেখযোগ্য বিচগুলো পর্যটকদের জন্য অনেক কার্যক্রম চালু করেছে। প্রাকৃতিকভাবেই এগুলো বৈচিত্র্যময়। লোকজনের ভিড় লেগেই আছে। ম্যানলি বিচ, বন্ডি বিচ কিংবা পামবিচ যথেষ্ট আকর্ষণীয়। অসংখ্য বিচের অনেকগুলোতেই পর্যটকেরা সার্ফিং, স্ট্রলিং, সুইমিং করে থাকেন।

ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছিল নরওয়ের অসলো শহরের অদূরেই এক বিচে। গ্রীষ্মকালের দুপুরে আমরা যারা গিয়েছিলাম, আমরা পুরো বিচ কস্টিউম নিয়ে যাইনি। ওই সব দেশের লোকেরা রোদ পোহাচ্ছে প্রকৃত অর্থেই। তাতে তাদের শরীরের ত্বক ট্যান হচ্ছে, কেউ কেউ সাঁতার কিংবা স্নান সেরে নিচ্ছে। গ্রীষ্মের উজ্জ্বল রোদ তাঁদের মনকে চাঙা করে দেহকে উষ্ণতায় ভরিয়ে তোলে।

আসা যাক আবার মালদ্বীপের কথায়। জানা যায়, ১ হাজার ১৯২টি প্রবালদ্বীপ নিয়ে গঠিত এবং দুই ডজনের বেশি প্রবাল প্রাচীর দিয়ে বিভক্ত। মালদ্বীপ ২১টি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত। আমরা জানি, বিশ্বের সর্বনিম্ন দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার গড় প্রাকৃতিক স্থলস্তর ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি ওপরে আর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এটি সর্বোচ্চ ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি ওপরে। বলা হয়ে থাকে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি ভূমি প্রবালদ্বীপ দ্বারা গঠিত হয়েছে, যা সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩ ফুটের কম ওপরে ওঠে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে মালদ্বীপ ডুবে যেতে পারে। এই সংকট ২১০০ সালের মধ্যে কার্যকর হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মতামত দিচ্ছেন।

অথচ সুন্দর রৌদ্রময় উজ্জ্বল এই দেশটি ১৯৭০ সালেও পর্যটকদের কাছে প্রায় অজানা ছিল। ১৯৭২ সাল থেকে পর্যটকদের যাতায়াত শুরু হয়। সরকারি হিসাবে দেখা যায়, মালদ্বীপের ৮৯টি রিসোর্ট ১৭ হাজারের মতো লোকের জন্য শয্যা সরবরাহ করতে সক্ষম। তারা ৬ লাখ পর্যটককে সেবা দিয়েছে ২০০৮ সালে। আর ২০১৯ সালে ট্যুরিস্ট এসেছিল ১৭ লাখ।

মালদ্বীপের যেকোনো জায়গায় যান, শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। সমুদ্রের নীল জল, আদিগন্ত নীল কিংবা সি ব্লু জলের ধারা। উজ্জ্বল রোদের কণা যেন ছড়িয়ে পড়েছে তিরতির করে বয়ে যাওয়া জলে। সৈকতে ধীরে ধীরে ধেয়ে আসে ঢেউয়ের রাশি। নগ্ন পা ভিজিয়ে দিয়ে চলে যায় আবার ফিরে ফিরে আসে। অনন্তকাল এই চলে যাওয়া আর অনুভূতি জাগিয়ে রেখে ফিরে আসে ঊর্মিমালা ভালোবাসায়। অন্য সমুদ্রসৈকতগুলোতে যে ভিড় আর মানুষের কোলাহল, তা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ আসে নীরব প্রশান্তি অনুভব করতে। জনবিচ্ছিন্ন রিসোর্টগুলো রাজধানী মালে থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে জলযান কিংবা সি-প্লেন পৌঁছে দেয় পর্যটকদের। প্রকৃতির এমন নীরবতায় মানুষ আত্ম উন্মোচন করে, আত্মজিজ্ঞাসায় উন্মুখ হয়। যান্ত্রিক যন্ত্রণা থেকে মানুষের আত্ম-আবিষ্কারের এই প্রচেষ্টা শুধুই সম্ভব এমন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আশ্রয় নিয়ে। সম্প্রতি চালু হয়েছে সরাসরি ফ্লাইট। খুলে গেছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার। মালদ্বীপের অসংখ্য হোটেল, অসংখ্য রিসোর্ট জীবনের অর্থ পাল্টে দিয়েছে। আমি দেখেছি, যিনি একবার মালদ্বীপে এসেছেন তিনিই আবার বেড়ানোর সুযোগ খুঁজছেন। মাত্র ৬ লাখ অধিবাসী, এই দেশে প্রায় সবাই মুসলমান এবং প্রধান পেশা মাছ শিকার। মালদ্বীপকে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের দেশ হিসেবে মনে করা যায়। বলা হয় ‘সাইলেন্স ইজ এক্সপেন্সিভ’। আমার কিন্তু তেমন ব্যয়বহুল মনে হয়নি। কারণ, এমন নিবিড় নীরবতায় ডুবে থাকার জন্য এটুকু ব্যয় করাই যায়।

ড. মো. গোলাম রহমান, সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত