ছয় বছরেও দেখেনি আলোর মুখ

রাহুল শর্মা, ঢাকা
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০০: ১৮

বরগুনায় একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত সামিরা। থাকত বরগুনা শহরের ভাড়া বাসায়। বাসার মালিকের ছেলে জামাল হোসেন তাকে বিভিন্ন সময় উত্ত্যক্ত করতেন।

বিষয়টি সামিরা জামালের মা ও স্ত্রীকে জানায়। এর পর থেকে ওই কিশোরীকে দেখলে জামালের আপত্তিকর কথাবার্তা আরও বেড়ে যায়। পরিচিতজনের মাধ্যমে জামাল কিশোরীর সম্পর্কে অপবাদ ছড়াতে থাকেন। উত্ত্যক্ত ও অপমান করা সইতে না পেরে ২০২১ সালের ৫ জুলাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সে। আত্মহত্যার আগে মায়ের কাছে একটি চিরকুটে লিখে যায় এসব ঘটনা।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল (অক্টোবর) পর্যন্ত প্রায় চার বছরে বখাটের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন সামিরার মতো অন্তত ৫১ জন তরুণী।

সামিরার মতো তরুণীদের শারীরিক-মানসিক শক্তি-সক্ষমতা বৃদ্ধি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ার মানসিক শক্তি বিকাশের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে উদ্যোগ নেয় সরকার। নেওয়া হয় নারী শিক্ষার স্বপ্নভূমি স্থাপন নামের একটি প্রকল্প। কিন্তু এখনো আলোর মুখ দেখেনি বহুল আলোচিত প্রকল্পটি। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় ছয় বছর।

২০১৭ সালে ‘নারী শিক্ষার স্বপ্নভূমি স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। পরে তা পাঠানো হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬০০ কোটি টাকা, যা বাস্তবায়নের কথা ছিল জানুয়ারি ২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার অদক্ষতা আর উদাসীনতার কারণেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাউশির একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, দাপ্তরিক কাজ ফেলে পরিকল্পনা শাখার কর্মকর্তারা সভা-সেমিনার ও কর্মশালা নিয়ে ব্যস্ত। কোনো প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করার পর তা নিয়মিত দেখভাল করতে হয়। এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা করেনি পরিকল্পনা শাখা।

তাঁরা আরও জানান, পরিকল্পনা শাখায় এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কারণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. এ কিউ এম শফিউল আজম প্রায়ই এ শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে নানা অসদাচরণ করেন।

জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. এ কিউ এম শফিউল আজম বলেন, ‘ছয় বছর আগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাননি। কিছুদিন আগে বিষয়টি আমরা জানতে পারি। আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে নতুন করে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করব।’

নারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসদাচরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আপনার মুখ থেকেই বিষয়টি শুনলাম। কারও সঙ্গে আমার এ রকম সম্পর্ক না। এর বাইরে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ অক্টোবর জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ৭১ বিধি অনুসারে এ প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দা রুবিনা আক্তার মিরা। এর বিপরীতে মাউশি থেকে গত ১৪ নভেম্বর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সহকারী পরিচালক সাবিনা বেগমের সই করা চিঠিতে জানানো হয়, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের নারী শিক্ষার স্বপ্নভূমি স্থাপন বিষয়ে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। এ বিষয়ে পরিকল্পিত/স্বাক্ষরিত কোনো ধারণাপত্র অত্র অধিদপ্তর হতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাউশি বিভাগে প্রেরণ করা হয়নি।’

প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, বেগম রোকেয়া, শেখ ফজিলাতুন নেছা, সুফিয়া কামাল, প্রীতিলতা, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী এবং সারদা সুন্দরী–এই ছয় মহীয়সী নারীর নামে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোকে নারী শিক্ষার আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে। একই সঙ্গে সেখানে নারীবান্ধব শিক্ষা কমপ্লেক্স তৈরি, লাইফ স্কিল ট্রেনিং বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের পরামর্শকের সাহায্যে প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি, দক্ষ মানবশক্তি, ডিজিটাল লাইব্রেরি ও মহীয়সী নারীদের স্মৃতি সংরক্ষণ কর্নার, ল্যাঙ্গুয়েজ ও আইসিটি ল্যাব, কাউন্সেলিং কর্নার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, ইনডোর গেমস ও রিক্রিয়েশন রুম, যাতায়াতের সুবিধাসহ গবেষণা কেন্দ্র প্রভৃতি স্থাপন ও নির্মাণ নিশ্চিত করা হবে।

জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিষয়টি করণিক ভুল। ২০১৭ সালে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছিল। যারা আগে দায়িত্বে ছিল, তারা বিষয়টি নিয়ে এগোয়নি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত