তোমার জন্মদিনে

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০: ৪০

আজ তোমার জন্মদিন। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বাসী মানুষজন শুধু বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবেই নয়, ৪২ বছর বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যও আজ তোমাকে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু ও ফজিলাতুন নেছা দম্পতির প্রথম সন্তান হিসেবে তুমি জন্ম নিয়েছিলে। এই ভূখণ্ডে তখন এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। ইতিহাসে এটিকে দেশভাগের সময় বলা হয়।

তোমার পিতা কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে থাকলেন। এই বাংলায় তাঁর বড্ড বেশি প্রয়োজন ছিল। সে কারণেই ঢাকার পাকিস্তান আন্দোলনকারী ছাত্রনেতারা কলকাতা থেকে তাঁকে চলে আসার তাগিদ দিচ্ছিলেন। তিনি সাড়াও দিয়েছিলেন। তবে সেখানেই সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে তাঁরা শপথ নিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা উপলব্ধি থেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে এক পরাধীনতা থেকে পূর্ব বাংলা আরেক পরাধীনতায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছিল। সেটি থেকে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করতে হবে। সিরাজউদ্দৌলা হোটেলের ওই বৈঠকে এ ছিল তোমার পিতার প্রতিজ্ঞা।

ঢাকায় এসে তিনি তাই করতে শুরু করেন। তাতে তোমার এবং সংসারের প্রতি তাঁর মনোযোগ দেওয়ার সময় ছিল না। তারপরও মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতে গোপালগঞ্জে ছুটে যেতেন। আবার এসে রাজনীতি, দল গঠন, আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল। এভাবেই তোমাদের পিতা হয়ে উঠলেন পূর্ব বাংলার শোষিত-বঞ্চিত মানুষের দৃঢ়চেতা নেতারূপে। গোপালগঞ্জে তুমি মা, দাদা-দাদি, আত্মীয়স্বজন নিয়ে শিশুকাল অতিক্রম করেছিলে। খেলাধুলা, গ্রামের নৈসর্গিক পরিবেশ, মধুমতী নদীর ঢেউ—এসবই তখন তোমার দেখা। একসময় ঢাকায় এসেছ, স্কুলে ভর্তিও হয়েছিলে। কিন্তু কখনো কখনো গোপালগঞ্জে আবার ফিরে যেতে হয়েছিল।

কারণ বাবার রাজনীতি বড়ই কঠিন ছিল। জেলে যাওয়া এবং সারা দেশ চষে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে যিনি প্রতিদিন প্রদেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত, করাচিসহ পশ্চিম পাকিস্তানেরও বিভিন্ন জায়গায় সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত থাকতেন, পরিবারকে দেখার তাঁর সময় কোথায়? তবে তোমার মা পিতার অনুপস্থিতির অনেক কিছুই পূরণ করতে ত্রুটি করতেন না। দাদা-দাদি, আত্মীয়স্বজনেরাও তোমার এবং ভাইবোনদের প্রতি যত্নবান ছিলেন। যখনই পিতা আসতেন, ভরিয়ে দিতেন তোমাদের আদর-স্নেহে। তোমরা ভুলে যেতে পিতাকে সব সময় না পাওয়ার অনুপস্থিতি। তিনি তোমাদের নিয়ে ভাবতেন। মা সেটি পূরণ করতেন।

যখন আইয়ুব খান রাজনীতি নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন, তখন তিনি তোমাদের নিয়ে ১৯৬১ সালের ১ থেকে ৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম, কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলেন। সে কথা তুমি নিজেও লিখেছ। বলে রাখি, তোমার পিতা তোমার মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, হিমছড়ি, মহেশখালী, কাপ্তাই একান্তে বেড়িয়েছিলেন ১৯৬৩ সালের ২৬ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত। রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ইত্যাদি গুণে বড় হওয়ার শিক্ষা তোমাদের পরিবারে দাদা-দাদি, বাবা-মা, নিকটাত্মীয়জনদের কাছ থেকেই তোমরা পেয়েছিলে। বুঝেছিলে পিতা দেশকে উজাড় করে দিচ্ছেন। তাই তোমাদের পাওয়ার কিছু ঘাটতি থাকলেও সেটাই তোমরা মেনে নিয়েছিলে।

ছোটকাল থেকেই তোমরা অসংখ্য বড় বড় মানুষকে দেখে, শিখেই বড় হয়েছ। তোমাদের পিতা লেখাপড়ার পাশাপাশি তোমার পারিবারিক জীবনটিও যাতে সুন্দর হয়, সেভাবেই তোমার জন্য সবকিছু ব্যবস্থা করেছিলেন। এমন রাজনৈতিক পরিবেশের স্বাভাবিক নিয়মে চলা জীবনে কোনো দিন ছেদ পড়বে—এটা হয়তো তোমরা কোনো দিন ভাবনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তুমি তোমার মায়ের কাছে বন্দী ছিলে আর পিতা ছিলেন পাকিস্তানিদের জেলে কারারুদ্ধ।

সেই বন্দিজীবনেই তোমার সন্তান জয়ের জন্ম। সে নামটিও আগে রেখে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জয় যেন মুক্তিযুদ্ধেরও বিজয়ের বার্তা নিয়ে তোমার কোলে এসেছিল। স্বাধীন দেশে তুমি লেখাপড়া, স্বামী-সংসারে জয় ও পুতুলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বঙ্গবন্ধু এবং তোমার মায়ের স্নেহের পরশ সারাক্ষণই তোমাদের ঘিরে ছিল। বঙ্গবন্ধু কখনো ভাবেননি তোমরা তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখবে।

কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা গোটা পরিবারই শুধু নয়, নিকটাত্মীয়দেরও পৈশাচিকভাবে হত্যা করেছে। ছোট বোন, দুই সন্তান নিয়ে জার্মানিতে থাকার কারণে মৃত্যুর হাত থেকে তুমি রক্ষা পেয়েছ। অবধারিত মৃত্যু থেকে তুমি নতুনভাবে জন্ম নিয়েছ। সেই জন্ম নেওয়া শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দলেরই শুধু হাল ধরোনি, গোটা বাঙালি জাতি এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃজাতিগোষ্ঠীর মানুষ—যারা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর কাঁদতে পারেনি, তারা ১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রাণ খুলে স্লোগান দিয়েছে, স্বপ্ন দেখেছে তোমাকে ঘিরে। বঙ্গবন্ধুর পরশ তোমার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল।

তুমি সেই পরশে ধীরে ধীরে জ্বলে উঠতে শুরু করেছ। আন্দোলন-সংগ্রাম, অভিজ্ঞতা, রাজনীতিকে নতুনভাবে চেনা-জানা, বোঝা, ঘাত-প্রতিঘাতকে অতিক্রম করে রাজপথে তুমি আরেক বঙ্গবন্ধুতে যেন আবির্ভূত হলে। সে কারণে ঘাতকেরা তোমাকে হত্যা করতে কয়েকবারই গুলি ছুড়েছে। বেঁচে গেছ, কিন্তু থেমে যাওনি। আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে প্রতিকূলতাকে একের পর এক অতিক্রম করে ১৯৯৬ সালে তুমি সেই আসনে বসেছিলে, যে আসনে জাতির পিতা বসেছিলেন দেশটাকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী ও শোষণহীন অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থা উপহার দিতে। পাঁচ বছরে তুমি এত দিনকার অনেকেরই অপপ্রচার, বিভ্রান্তি ভাঙিয়ে দিলে তোমার কাজ দিয়ে। গঙ্গার পানিচুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, ইনডেমনিটির কালাকানুন থেকে জাতিকে মুক্তি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা।

তোমার নেওয়া সব উদ্যোগই থেমে গেল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তোমাকে প্রায় হত্যাই করে ফেলা হয়েছিল। ফিনিক্স পাখির মতো তুমি আবারও জন্ম নিলে। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নিয়ে দিনবদলের সনদ আর রূপকল্প একে একে বাস্তবায়ন করতে থাকলে। স্বল্পোন্নত দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নয়নশীল দেশ ইত্যাদি আসনে উন্নীত করেছ দেশটাকে। শিক্ষা, খাদ্য, বিদ্যুৎ, শিল্প, ডিজিটালাইজেশন, আশ্রয়হীনদের আশ্রয়দান, কোটি কোটি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার নানা খাতে মানুষকে রাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রদান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও তুমি করলে।

দেশটাকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বদলে দিতে তুমিই পারলে। তোমার আগে কোনো সরকারই এই কৃতিত্ব পাওয়ার মতো কাজ করেনি। এখন তোমাকে ঘিরেই জাতির অনেক অনেক প্রত্যাশা। রাষ্ট্রটাকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত করার অসমাপ্ত কাজ তোমাকেই করতে হবে। শিক্ষা, সুশাসন, টেকসই উন্নয়ন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণ, মেধা, দেশপ্রেম এবং সৎ নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতির নেতা-কর্মী ও গোটা সমাজব্যবস্থাকে আধুনিক চরিত্রে রূপায়িত করার কাজটি জানি অনেক কঠিন এবং দীর্ঘ সময়ের। সে কাজটিতে তুমি কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাত দিয়েছ। কিন্তু তোমার কাজ যেন যথার্থ উত্তরাধিকারেই সমর্পিত হয়।

এই বিশাল কর্মযজ্ঞ—এবার ৭৭তম জন্মতিথিতে তোমার কাছেই আমাদের প্রত্যাশা। জানি অনেকেই আছে তোমাকে সরিয়ে বাংলাদেশটাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের জন্য পশ্চাদপসরণ—এটি নিকট অতীতেরই অভিজ্ঞতা। তুমি তোমার শাসনকালের ২০ বছরে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছ। বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়; বরং দেশটার সম্ভাবনা দেখেই তাবৎ শক্তি বাংলাদেশকে নিয়ে এখন টানাটানি করছে। তুমি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতিতে অটল থাকার চেষ্টা করছ।

আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের এবং অসাম্প্রদায়িক উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশী, তারা তোমার পাশেই আছি। তুমি দীর্ঘজীবী হলে আমাদের স্বপ্ন সফল হবে, বাংলাদেশ আরও উন্নত হবে, অসমাপ্ত বাংলাদেশ সমাপ্তির ইতিহাস রচনা করতে পারবে। তুমি হাল ধরেছিলে বলেই আজ তোমার জন্মদিনে এত অর্জন এবং নতুন নতুন প্রত্যাশা নিয়ে শুভেচ্ছাকামনা।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত