অসাধারণ এক চলচ্চিত্রকার

জাহীদ রেজা নূর
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২২, ০৬: ৪১
আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০২২, ০৯: ৫১

একুশই সাহিত্যিক জহির রায়হানের জন্মদাতা। এ কথা জহির রায়হান নিজেও স্বীকার করতেন। ‘আরেক ফাল্গুন’ই একুশ নিয়ে তাঁর একমাত্র কাজ নয়। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। সেভাবে একটি চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়েছিল। জহির রায়হান সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন শিল্পী মুর্তজা বশীরকে। সমাজের চার শ্রেণির প্রতিনিধিত্বশীল চারটি পরিবারের ঘটনা ছিল সেই ছবিতে। যেখানে গুলি হয়েছিল বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি, সেখানেই এরা মিলিত হবে। চলবে গুলি। উড়ে যাবে একটি কাক। এ রকমই ছিল চিত্রনাট্যটি। কিন্তু এই ছবি নির্মাণের অনুমতি পাননি জহির রায়হান।

বামপন্থী রাজনীতির লোক ছিলেন জহির রায়হান। রাজনীতি, লেখালেখির পর চলচ্চিত্রে ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ ছবির সহকারী পরিচালক হয়ে এলেন যখন, তখনো তাঁর বয়স এমন কিছু নয়। বলা যায় ঝকঝকে তরুণ তিনি। শহীদ হয়েছিলেন মাত্র ৩৭ বছর বয়সে। ১৯৩৫ সালের এই দিনে তাঁর জন্ম। কিন্তু বাংলার সংস্কৃতিতে কত যে তাঁর অবদান, তা বলে শেষ করা যাবে না। আজ তাঁর চলচ্চিত্র নিয়েই কথা বলব আমরা।

একাত্তর সালে আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। সে বয়সে সিনেমা দেখে জাতীয় রাজনীতি বুঝে ফেলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আমরা পরিবারের সবাই দেখতে গিয়েছিলাম ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি। আনোয়ার হোসেন, রাজ্জাক, রোজি, সুচন্দা, শওকত আকবর, খান আতা, আর আমজাদ হোসেনের অভিনয় দেখেছি তন্ময় হয়ে। আর রওশন জামিল? হ্যাঁ, চাবি কার হাতে থাকবে, সেটা নিয়েই যে ঘটনার আবর্তন, তাতে রওশন জামিল নিজেকে চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর চরিত্রটিকে দর্শক-শ্রোতা যেন ঘৃণা করতে পারে, অভিনয়ে সেটা ছিল।

পরে যখন বড় হয়েছি, বারবার দেখেছি ছবিটা। তখন বোঝা গেছে, ‘জীবন থেকে নেয়া’র অর্থ। বোঝা গেছে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটির যত অসংগতি, তা থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে বিদ্রোহ, বিদ্রোহ থেকে আন্দোলন এবং শেষে জয়—এর সবটাই ধরা আছে ছবিতে। জহির রায়হানের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছে তখন। এখানে একটি তথ্য দিয়ে রাখি। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে যে মিছিলটিতে আনোয়ার হোসেন, রাজ্জাকেরা শুটিং করেছিলেন, সে মিছিলটি ছিল আমাদের চামেলীবাগের পাড়া থেকে বের হওয়া। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি যখন বাজছিল, তখন আমার দুই অগ্রজ নাসিম ও সেলিমকেও সেই মিছিলে দেখা যাচ্ছে। এভাবেই আমাদের পরিবার ছবিটির একটি অংশ হয়ে আছে।

‘কাচের দেয়াল’ ছবিটি তিনি করেছিলেন ১৯৬৩ সালে। ‘কখনও আসেনি’র দুই বছর পর। দুটি ছবির নির্মাণই অনবদ্য। যে জটিল কাহিনির ওপর নির্মিত ছবি দুটি, তা নিয়েও বিশদ আলোচনা হতে পারে। ‘কাঁচের দেয়াল’কে যদি নারীপ্রধান, আরও এগিয়ে নারীবাদী সিনেমা হিসেবে অভিহিত করা হয়, তাহলেও সত্য থেকে একচুলও সরে দাঁড়ানো হয় না।

পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সংগম’-এর নির্মাতা তিনি। প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি ‘বাহানা’ও তাঁর নির্মিত। তিনিই তো নির্মাণ করেন ‘বেহুলা’র মতো ছবি এবং ভিন্নধারার ‘আনোয়ারা’ও তাঁর তৈরি। যে বেহুলার কথা বলা হলো, তা দেখার জন্য দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ত সিনেমা হলে।

চলচ্চিত্রের এতগুলো দিক নিয়ে যিনি ভেবেছেন, যা এখন অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে। কারণ, আবার বলছি, তিনি শহীদ হয়েছেন মাত্র ৩৭ বছর বয়সে। এরই মধ্যে এতটা পরিপক্ব চলচ্চিত্রজীবন তাঁর।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর ‘স্টপ জেনোসাইড’ চলচ্চিত্রটিতে মুক্তিযুদ্ধকে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্ত দেশে ফিরে এলেন। এসেই শুনলেন অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের নিখোঁজ সংবাদ। ভীষণ ভালো বাসতেন শহীদুল্লা কায়সারকে। তাঁকে কেউ ফোন করে জানিয়েছিল, মিরপুরের নির্দিষ্ট এক জায়গায় গেলে ভাইকে ফেরত পাবেন। সেটি যে একটা ফাঁদ ছিল, সে কথা ভাবতেই পারেননি তিনি। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি একটি সার্চ পার্টির সঙ্গে মিরপুরে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই হানাদারদের অতর্কিত হামলায় নিহত হন জহির রায়হান।

‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ছবিটি শেষ করে যেতে পারেননি তিনি। যে আলোর সন্ধানে ছিলেন তিনি, সেই আলো আজও আমাদের আলোকিত করতে পারেনি।

জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত