ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ক্রিটিক্যাল ইস্যুজ ইন ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস, কালেক্টেড পেপারস অন ইকোনমিক ইস্যুজসহ অর্থনীতির ওপর রচিত তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। ‘গভর্নরের স্মৃতিকথা’ নামে তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য খাতে বাজেট কতটা ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে তিনি আজকের পত্রিকার মাসুদ রানার সঙ্গে কথা বলেছেন।
আজকের পত্রিকা: আপনার মতে এবারের বাজেট কেমন হলো?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: সার্বিকভাবে আমি বলব, এবারের বাজেটে অনেক আশ্বাস আছে, কিন্তু আশ্বাস অনুযায়ী সাধারণ মানুষের কোনো প্রত্যাশা নেই। বাজেট বড় না করে এর আকার ছোট করেছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মানুষের মধ্যে চাপ বাড়াব না। কিন্তু খরচের মাত্রা কমেনি। কর আদায়ের বড় টার্গেট নিয়েছে, কিন্তু কীভাবে তা আদায় হবে, তা নিয়ে কোনো কথা নেই।
অপ্রয়োজনীয় ১ হাজার ২৮৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতগুলো প্রকল্পের কোনো দরকারই ছিল না। সরকার এবারের বাজেটকে সাধারণ বললেও তা হয়নি। অর্থনীতিতে বর্তমানে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হার এবং জ্বালানি। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। আবার ঘাটতি বাজেটের পুরোটাই আসবে ব্যাংক ও বৈদেশিক উৎস থেকে।
এমনিতেই ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। আস্থাহীনতাসহ বিভিন্ন কারণে আমানতকারীদের অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখছে না। আবার ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এ রকম অবস্থায় সরকারের ব্যাংকঋণের নির্ভরতা বেসরকারি খাতকে বাধাগ্রস্ত করবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋণ পাবে না। ঘাটতি না রেখে এই সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় অর্ধেক করা দরকার ছিল।
যদিও অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি কমার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছেন। কিন্তু কীভাবে এটা কমবে, তার কোনো কথা নেই। এর জন্য সরবরাহ বাড়াতে হবে, মনিটরিং বাড়াতে হবে, ছোট-বড় শিল্পের পরিসর বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স না বাড়লে তো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়বে না। রিজার্ভ না বাড়লে আমরা বিদেশে কোনো কিছু আমদানি করতে পারব না। তাহলে বিনিয়োগ কীভাবে আসবে?
জ্বালানির দর বাড়ানো-কমানো হচ্ছে। গত ১০ বছরে জ্বালানি অনুসন্ধানে কিছু না করে কেবল দাম বাড়ানো হয়েছে। সামনে জ্বালানি সরবরাহের জন্য যে তেল আনা হবে, তার ডলার কোথায়?
মূল যে তিনটা চ্যালেঞ্জ, সেটা সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই। ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। ব্যাংক নিয়ে কী করবে, তা নিয়ে কোনো কথাবার্তা নেই। পুঁজিবাজারের অবস্থাও খারাপ। সেটা নিয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে কোনো কথা নেই। পুঁজিবাজার উন্নয়নে কিছু করা হয়নি। উল্টো প্রথমবারের মতো ব্যক্তি পর্যায়ে মূলধনি মুনাফার ওপর কর আরোপ করা হয়েছে।
কর্মসংস্থানে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। এখন এই খাত ঋণ না পেলে কর্মসংস্থান হবে কী করে? আর ব্যবসা-বাণিজ্য না হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর আদায় করবে কীভাবে? ব্যবসা করতে না পারলে মানুষ কর, ভ্যাট দেবে কোত্থেকে? এর মানে মূল্যস্ফীতি কমবে না, আবার কর্মসংস্থানও বাড়বে না।
অপ্রিয় সত্যি হলেও অর্থনৈতিক এই কঠিন সময়ে জনবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব নিয়ে যদি কঠিন পদক্ষেপ নিতেন, তাহলে ভালো হতো। আমি বলছি না এক বছরের মধ্যে সবকিছু বদলে ফেলতে হবে।
আমরা বাজেটের অনেক আগে থেকে নানা কথা বা প্রস্তাব দিয়েছি, কিন্তু সেসবের কিছু নেই।
আজকের পত্রিকা: আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে নতুন নতুন খাতে কর বসানো হয়েছে। সাধারণ মানুষ বাঁচবে কীভাবে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমি জানি না আইএমএফের শর্ত মানা ঠিক হবে কি না। তবে আয়কর বাড়ান এবং ১ কোটি লোকের টিন আছে, তার মধ্যে ৫০ লাখ লোককে আয়করের আওতায় আনেন। গ্রাম-শহর মিলে প্রচুর টাকাওয়ালা ব্যবসায়ী আছেন, উপজেলা পর্যায়ে অনেক দোকানদার আছেন—এ রকম আরও অনেক খাতের ব্যবসায়ী আছেন, তাঁদের কাছ থেকে আয়কর তো তুলতে হবে। কিন্তু তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
দেশে অনেক সামর্থ্যবান চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী আছেন। তাঁদের কাছ থেকে ট্যাক্স তুললে তো ভ্যাটের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপরে পড়ত না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের ওপর ভ্যাট নেই; কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্রয়কৃত জিনিসের ওপর ভ্যাট বসানো এবং বাড়ানো হচ্ছে। সাধারণ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। আবার ন্যাপথলিন, শুকনো মরিচ—এসবের ভ্যাট কমানো হয়েছে। এসবের কোনো মানে হয়! অনেক ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে না।
আপনি আয়কর বাড়ান, তাহলে তো সাধারণ মানুষের ওপর চাপ পড়ে না। এ ক্ষেত্রে এনবিআরকে আরও কর্মঠ ও সক্রিয় হতে হবে। যাঁদের ট্যাক্স দেওয়ার সামর্থ্য আছে, তাঁদের ট্যাক্সের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর ভ্যাটের বোঝা বাড়ানোর কোনো দরকার ছিল না। গরিবের রুটির ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে লাভ কী? বড়লোকের খাওয়ার জিনিসের ওপর ভ্যাট বাড়ালে কথা থাকত না। তাতে কোনো লাভ হলো না।
আজকের পত্রিকা: বাজেটে বড় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু কর ফাঁকিবাজদের ধরতে কোনো কৌশলের কথা নেই কেন বাজেটে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: সেখানেই তো কথা। এনবিআরকে চ্যালেঞ্জ দেওয়া উচিত ছিল—তোমাদের ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা তুলে দিতে হবে। তাহলে তারা নতুন করদাতা খুঁজে বের করত। যাঁরা আয়কর না দিয়ে ফাঁকিবাজি করেন, এনবিআর তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু করে না। তাঁরা আবার আয়কর না দিয়ে আপস করে দেনদরবার করেন। সেখানেও এনবিআরকে জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। আর কথা হলো, আয়কর না ওঠানোর কারণ, সমস্যা ও ঘাটতি কী, তা আমাদের জানাতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা, বিশেষ সুবিধা—এসব কী? কথা হলো, আয়কর ওঠানোর দায়িত্ব তোমাদের, তোমরা সেটা করবে।
আর একটা বিষয় হলো, কালোটাকা সাদা করার জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধরা হয়েছে। আর উপার্জিত অর্থ থেকে সর্বোচ্চ ট্যাক্স ধরা হয়েছে ৩০ শতাংশ। আর হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে শুধু ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে সাদা করতে পারবে। তাদের আসলে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। নতুবা তারা তো অবৈধভাবে কালোটাকা করতে উৎসাহিত হবে। নৈতিকতা ও আর্থিক বিবেচনায় এ কাজটা তো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।
আজকের পত্রিকা: অর্থমন্ত্রী বলেছেন ছয় মাস পর মূল্যস্ফীতি কমবে, আদৌ কি এর সম্ভাবনা আছে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০-এর কাছাকাছি। এটা কি আলাদিনের চেরাগ যে মূল্যস্ফীতি থাকবে না! খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ৪৬-৪৭ শতাংশ। এটা তো সারা দেশের ব্যাপার। হঠাৎ করে কি খাদ্যের দাম কমানো সম্ভব? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম তো আর কমবে না। মিলের মালিক, চালকল ও চাতালের মালিক, পাইকার ও মধ্যস্বত্বভোগী তো আছে। গুদামে পণ্য আছে, কিন্তু বাজারে নেই। তাহলে দাম কমবে কেমন করে? মানে, এখানে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে না। এ কারণে মজুতদারেরা উৎসাহিত হচ্ছেন অপকর্ম করতে।
যদি বলা হতো, জিনিসপত্র মজুত করলে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে। আবার অল্প কিছু মানুষকে চাল আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হলেও, বেশির ভাগ ব্যবসায়ীকে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এসব করলে তো মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না।
অন্যান্য ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্চ বাড়ানো হয়েছে। এতে বাসভাড়া বেড়ে যাবে, বাড়িভাড়া বেড়ে যাবে। তাহলে আপনি কীভাবে বলেন মূল্যস্ফীতি কমে যাবে? মূল্যস্ফীতি কমানোর কম্পোনেন্টগুলোর দাম বাড়ানো হয়েছে। এটা বাস্তবতাবিবর্জিত বক্তব্য হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু আশ্বাস পূরণ হবে না।
আজকের পত্রিকা: বাজেট পাসের পর কোন কোন বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: প্রথমত, বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রত্যেক কর্মকর্তা, কর্মজীবীর কর্মদক্ষতা বাড়াতে হবে। তারপর তাদের সততা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মনিষ্ঠা বাড়াতে হবে। শুধু সরকারি কর্মকর্তা রুটিনমাফিক চাকরি করবেন আর তাঁরা যা নির্দেশ দেবেন আমরা তা দিয়ে দেব, সেটা হলে হবে না। দুর্নীতি কমাতে হবে। মনিটরিংটা বাড়াতে হবে। তাঁরা কী কাজ করছেন? তাঁদের দক্ষতাও দেখতে হবে। তা না হলে এসব প্রশাসনের লোকজন রুটিন কাজই করে যাবেন।
দুঃখের বিষয় হলো, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের একটা বিরাট অংশের মানুষ চলে গেছেন প্রশাসনে। কিন্তু তাঁরা যদি যথার্থভাবে কাজই না করেন, তাঁদের দরকারটা কী? তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এতগুলো প্রকল্প গ্রহণের দরকার ছিল না। প্রকল্প হাতে নিয়ে দায়সারাভাবে কাজ করা হয়। তারপর দুই বছরের কাজ পাঁচ বছরে শেষ করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন কাজও করা হয় না। প্রকল্প গ্রহণ করে দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকদের দিয়ে কাজ করানো উচিত। এরপর কাজের মনিটরিং করাও দরকার। যাঁরা কাজে দক্ষতা দেখাবেন এবং ভালো করবেন, তাঁদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে সরকারি প্রকল্পগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হবে এবং সরকারের রাজস্বটা ঠিকভাবে আসবে। এ জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও দরকার।
একটা উদাহরণ দিই। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নৈরাজ্য বিরাজ করছে। দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম ঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় না। অনেক হাসপাতালে এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, কেমোথেরাপিসহ নানা ধরনের প্রয়োজনীয় মেশিন নষ্ট। আমি এক হাসপাতালের পরিচালককে জিজ্ঞেস করলাম, এসব মেশিন নষ্ট কেন? তিনি বললেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।’ শুনে বললাম, এটা তো অদ্ভুত ব্যাপার! আপনি তাহলে জরুরি কাজ কীভাবে করবেন? এগুলো তো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কোনো লক্ষণ নয়।
তাই যত দিন পর্যন্ত যথার্থভাবে মনিটরিং ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা না যাবে, তত দিন বাজেট বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। এ কারণে আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে বাজেটের বাস্তবায়ন হয় না। এটাই আমাদের দেশের একটা বড় দুর্বল দিক। কাগজে-কলমে অনেক সুন্দর ও ভালো কথা লেখা থাকলেও কাজের বেলায় কিছুই হয় না।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ক্রিটিক্যাল ইস্যুজ ইন ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস, কালেক্টেড পেপারস অন ইকোনমিক ইস্যুজসহ অর্থনীতির ওপর রচিত তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। ‘গভর্নরের স্মৃতিকথা’ নামে তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য খাতে বাজেট কতটা ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে তিনি আজকের পত্রিকার মাসুদ রানার সঙ্গে কথা বলেছেন।
আজকের পত্রিকা: আপনার মতে এবারের বাজেট কেমন হলো?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: সার্বিকভাবে আমি বলব, এবারের বাজেটে অনেক আশ্বাস আছে, কিন্তু আশ্বাস অনুযায়ী সাধারণ মানুষের কোনো প্রত্যাশা নেই। বাজেট বড় না করে এর আকার ছোট করেছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মানুষের মধ্যে চাপ বাড়াব না। কিন্তু খরচের মাত্রা কমেনি। কর আদায়ের বড় টার্গেট নিয়েছে, কিন্তু কীভাবে তা আদায় হবে, তা নিয়ে কোনো কথা নেই।
অপ্রয়োজনীয় ১ হাজার ২৮৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতগুলো প্রকল্পের কোনো দরকারই ছিল না। সরকার এবারের বাজেটকে সাধারণ বললেও তা হয়নি। অর্থনীতিতে বর্তমানে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হার এবং জ্বালানি। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। আবার ঘাটতি বাজেটের পুরোটাই আসবে ব্যাংক ও বৈদেশিক উৎস থেকে।
এমনিতেই ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। আস্থাহীনতাসহ বিভিন্ন কারণে আমানতকারীদের অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখছে না। আবার ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এ রকম অবস্থায় সরকারের ব্যাংকঋণের নির্ভরতা বেসরকারি খাতকে বাধাগ্রস্ত করবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋণ পাবে না। ঘাটতি না রেখে এই সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় অর্ধেক করা দরকার ছিল।
যদিও অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি কমার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছেন। কিন্তু কীভাবে এটা কমবে, তার কোনো কথা নেই। এর জন্য সরবরাহ বাড়াতে হবে, মনিটরিং বাড়াতে হবে, ছোট-বড় শিল্পের পরিসর বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স না বাড়লে তো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়বে না। রিজার্ভ না বাড়লে আমরা বিদেশে কোনো কিছু আমদানি করতে পারব না। তাহলে বিনিয়োগ কীভাবে আসবে?
জ্বালানির দর বাড়ানো-কমানো হচ্ছে। গত ১০ বছরে জ্বালানি অনুসন্ধানে কিছু না করে কেবল দাম বাড়ানো হয়েছে। সামনে জ্বালানি সরবরাহের জন্য যে তেল আনা হবে, তার ডলার কোথায়?
মূল যে তিনটা চ্যালেঞ্জ, সেটা সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই। ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। ব্যাংক নিয়ে কী করবে, তা নিয়ে কোনো কথাবার্তা নেই। পুঁজিবাজারের অবস্থাও খারাপ। সেটা নিয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে কোনো কথা নেই। পুঁজিবাজার উন্নয়নে কিছু করা হয়নি। উল্টো প্রথমবারের মতো ব্যক্তি পর্যায়ে মূলধনি মুনাফার ওপর কর আরোপ করা হয়েছে।
কর্মসংস্থানে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। এখন এই খাত ঋণ না পেলে কর্মসংস্থান হবে কী করে? আর ব্যবসা-বাণিজ্য না হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর আদায় করবে কীভাবে? ব্যবসা করতে না পারলে মানুষ কর, ভ্যাট দেবে কোত্থেকে? এর মানে মূল্যস্ফীতি কমবে না, আবার কর্মসংস্থানও বাড়বে না।
অপ্রিয় সত্যি হলেও অর্থনৈতিক এই কঠিন সময়ে জনবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব নিয়ে যদি কঠিন পদক্ষেপ নিতেন, তাহলে ভালো হতো। আমি বলছি না এক বছরের মধ্যে সবকিছু বদলে ফেলতে হবে।
আমরা বাজেটের অনেক আগে থেকে নানা কথা বা প্রস্তাব দিয়েছি, কিন্তু সেসবের কিছু নেই।
আজকের পত্রিকা: আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে নতুন নতুন খাতে কর বসানো হয়েছে। সাধারণ মানুষ বাঁচবে কীভাবে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমি জানি না আইএমএফের শর্ত মানা ঠিক হবে কি না। তবে আয়কর বাড়ান এবং ১ কোটি লোকের টিন আছে, তার মধ্যে ৫০ লাখ লোককে আয়করের আওতায় আনেন। গ্রাম-শহর মিলে প্রচুর টাকাওয়ালা ব্যবসায়ী আছেন, উপজেলা পর্যায়ে অনেক দোকানদার আছেন—এ রকম আরও অনেক খাতের ব্যবসায়ী আছেন, তাঁদের কাছ থেকে আয়কর তো তুলতে হবে। কিন্তু তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
দেশে অনেক সামর্থ্যবান চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী আছেন। তাঁদের কাছ থেকে ট্যাক্স তুললে তো ভ্যাটের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপরে পড়ত না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের ওপর ভ্যাট নেই; কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্রয়কৃত জিনিসের ওপর ভ্যাট বসানো এবং বাড়ানো হচ্ছে। সাধারণ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। আবার ন্যাপথলিন, শুকনো মরিচ—এসবের ভ্যাট কমানো হয়েছে। এসবের কোনো মানে হয়! অনেক ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে না।
আপনি আয়কর বাড়ান, তাহলে তো সাধারণ মানুষের ওপর চাপ পড়ে না। এ ক্ষেত্রে এনবিআরকে আরও কর্মঠ ও সক্রিয় হতে হবে। যাঁদের ট্যাক্স দেওয়ার সামর্থ্য আছে, তাঁদের ট্যাক্সের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর ভ্যাটের বোঝা বাড়ানোর কোনো দরকার ছিল না। গরিবের রুটির ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে লাভ কী? বড়লোকের খাওয়ার জিনিসের ওপর ভ্যাট বাড়ালে কথা থাকত না। তাতে কোনো লাভ হলো না।
আজকের পত্রিকা: বাজেটে বড় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু কর ফাঁকিবাজদের ধরতে কোনো কৌশলের কথা নেই কেন বাজেটে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: সেখানেই তো কথা। এনবিআরকে চ্যালেঞ্জ দেওয়া উচিত ছিল—তোমাদের ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা তুলে দিতে হবে। তাহলে তারা নতুন করদাতা খুঁজে বের করত। যাঁরা আয়কর না দিয়ে ফাঁকিবাজি করেন, এনবিআর তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু করে না। তাঁরা আবার আয়কর না দিয়ে আপস করে দেনদরবার করেন। সেখানেও এনবিআরকে জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। আর কথা হলো, আয়কর না ওঠানোর কারণ, সমস্যা ও ঘাটতি কী, তা আমাদের জানাতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা, বিশেষ সুবিধা—এসব কী? কথা হলো, আয়কর ওঠানোর দায়িত্ব তোমাদের, তোমরা সেটা করবে।
আর একটা বিষয় হলো, কালোটাকা সাদা করার জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধরা হয়েছে। আর উপার্জিত অর্থ থেকে সর্বোচ্চ ট্যাক্স ধরা হয়েছে ৩০ শতাংশ। আর হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে শুধু ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে সাদা করতে পারবে। তাদের আসলে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। নতুবা তারা তো অবৈধভাবে কালোটাকা করতে উৎসাহিত হবে। নৈতিকতা ও আর্থিক বিবেচনায় এ কাজটা তো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।
আজকের পত্রিকা: অর্থমন্ত্রী বলেছেন ছয় মাস পর মূল্যস্ফীতি কমবে, আদৌ কি এর সম্ভাবনা আছে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০-এর কাছাকাছি। এটা কি আলাদিনের চেরাগ যে মূল্যস্ফীতি থাকবে না! খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ৪৬-৪৭ শতাংশ। এটা তো সারা দেশের ব্যাপার। হঠাৎ করে কি খাদ্যের দাম কমানো সম্ভব? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম তো আর কমবে না। মিলের মালিক, চালকল ও চাতালের মালিক, পাইকার ও মধ্যস্বত্বভোগী তো আছে। গুদামে পণ্য আছে, কিন্তু বাজারে নেই। তাহলে দাম কমবে কেমন করে? মানে, এখানে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে না। এ কারণে মজুতদারেরা উৎসাহিত হচ্ছেন অপকর্ম করতে।
যদি বলা হতো, জিনিসপত্র মজুত করলে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে। আবার অল্প কিছু মানুষকে চাল আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হলেও, বেশির ভাগ ব্যবসায়ীকে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এসব করলে তো মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না।
অন্যান্য ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্চ বাড়ানো হয়েছে। এতে বাসভাড়া বেড়ে যাবে, বাড়িভাড়া বেড়ে যাবে। তাহলে আপনি কীভাবে বলেন মূল্যস্ফীতি কমে যাবে? মূল্যস্ফীতি কমানোর কম্পোনেন্টগুলোর দাম বাড়ানো হয়েছে। এটা বাস্তবতাবিবর্জিত বক্তব্য হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু আশ্বাস পূরণ হবে না।
আজকের পত্রিকা: বাজেট পাসের পর কোন কোন বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: প্রথমত, বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রত্যেক কর্মকর্তা, কর্মজীবীর কর্মদক্ষতা বাড়াতে হবে। তারপর তাদের সততা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মনিষ্ঠা বাড়াতে হবে। শুধু সরকারি কর্মকর্তা রুটিনমাফিক চাকরি করবেন আর তাঁরা যা নির্দেশ দেবেন আমরা তা দিয়ে দেব, সেটা হলে হবে না। দুর্নীতি কমাতে হবে। মনিটরিংটা বাড়াতে হবে। তাঁরা কী কাজ করছেন? তাঁদের দক্ষতাও দেখতে হবে। তা না হলে এসব প্রশাসনের লোকজন রুটিন কাজই করে যাবেন।
দুঃখের বিষয় হলো, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের একটা বিরাট অংশের মানুষ চলে গেছেন প্রশাসনে। কিন্তু তাঁরা যদি যথার্থভাবে কাজই না করেন, তাঁদের দরকারটা কী? তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এতগুলো প্রকল্প গ্রহণের দরকার ছিল না। প্রকল্প হাতে নিয়ে দায়সারাভাবে কাজ করা হয়। তারপর দুই বছরের কাজ পাঁচ বছরে শেষ করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন কাজও করা হয় না। প্রকল্প গ্রহণ করে দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকদের দিয়ে কাজ করানো উচিত। এরপর কাজের মনিটরিং করাও দরকার। যাঁরা কাজে দক্ষতা দেখাবেন এবং ভালো করবেন, তাঁদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে সরকারি প্রকল্পগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হবে এবং সরকারের রাজস্বটা ঠিকভাবে আসবে। এ জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও দরকার।
একটা উদাহরণ দিই। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নৈরাজ্য বিরাজ করছে। দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম ঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় না। অনেক হাসপাতালে এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, কেমোথেরাপিসহ নানা ধরনের প্রয়োজনীয় মেশিন নষ্ট। আমি এক হাসপাতালের পরিচালককে জিজ্ঞেস করলাম, এসব মেশিন নষ্ট কেন? তিনি বললেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।’ শুনে বললাম, এটা তো অদ্ভুত ব্যাপার! আপনি তাহলে জরুরি কাজ কীভাবে করবেন? এগুলো তো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কোনো লক্ষণ নয়।
তাই যত দিন পর্যন্ত যথার্থভাবে মনিটরিং ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা না যাবে, তত দিন বাজেট বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। এ কারণে আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে বাজেটের বাস্তবায়ন হয় না। এটাই আমাদের দেশের একটা বড় দুর্বল দিক। কাগজে-কলমে অনেক সুন্দর ও ভালো কথা লেখা থাকলেও কাজের বেলায় কিছুই হয় না।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে