যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮: ২৮
আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০২১, ১১: ২৫

যুক্তরাষ্ট্র যে অভিযোগে র‍্যাবের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা ঠিক নয় বলে দাবি করেছে সরকার। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে র‍্যাবের বিরুদ্ধে। তবে র‍্যাব বলছে, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছে। র‍্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সহজভাবে নেয়নি সরকার। এর ব্যাখ্যা শুনতে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর দমন, নিপীড়ন ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাবের বর্তমান ও সাবেক ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়। সেখানে র‍্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক মহাপরিচালক (বর্তমানে আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক তোফায়েল মুস্তাফা সারওয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খানের নাম রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় র‌্যাব-৭-এর সাবেক অধিনায়ক 

মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর সে দেশে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হককে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে সম্পৃক্ততার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

গতকাল কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার আল মঈন বলেন, জঙ্গি হামলা, মাদক অভিযানে, সন্ত্রাসী হামলায় র‍্যাব তখনই গুলি করেছে, যখন তাদের ওপর হামলা হয়। আত্মরক্ষার্থে ছাড়া কখনো গুলি চালায়নি র‍্যাব। র‍্যাবে চাকরি করে আইন ভঙ্গ করার সুযোগ নেই। যেকোনো বাহিনীর তুলনায় র‍্যাব নিজ বাহিনীর সদস্যদের আইনভঙ্গের বেশি শাস্তি দিয়েছে।

র‍্যাব কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার চিঠি আনুষ্ঠানিকভাবে পাওয়া যায়নি জানিয়ে কমান্ডার আল মঈন বলেন, চিঠি পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জবাব দেওয়া হবে। তিনি বলেন, মানবতা রক্ষায় র‍্যাবের আত্মত্যাগ অনেক বেশি। র‍্যাবের সাফল্যের কারণে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা সফলতা পেয়েছে, সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের সময় র‍্যাবের ২৮ জন মারা গেছেন, দুই হাজার সদস্য আহত হয়েছেন আর অঙ্গহানি হয়েছে এক হাজার জনের। 

ইচ্ছে করলেই গুলি করা যায় না যথাযথ কারণেই গুলির ঘটনা ঘটে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘আমাদের সিস্টেম সুন্দর, এই সিস্টেমে কেউ ইচ্ছে করলেই ক্রসফায়ার বা গুলি করতে পারে না।’ গতকাল ঢাকা ওয়াসা ভবনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘তারা কেন, কীভাবে এই নিষেধাজ্ঞাটা দিয়েছে আমাকে দেখতে হবে। আমি যতটুকু শুনেছি, তারা গুলি, ক্রসফায়ারের কথা বলেছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের জুডিশিয়ারি তদন্ত হয়।

ঘটনার পর তারা চেক করে যে দুর্ঘটনাটি হলো এর পেছনে কারও গাফিলতি আছে কি না। যদি কারও কোনো গাফিলতি থাকে, তার বিরুদ্ধে মামলা চালু হয়ে যায়।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এসব ঘটনা শুধু আমাদের দেশে না, পৃথিবীর সব দেশেই চলছে এবং চালু আছে। কুমিল্লায় কয়েকজন সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে যেভাবে গুলি করেছিল, কোনো নিরাপত্তা বাহিনী গিয়ে যদি বলে আপনারা আসেন, তারা কি আসবে? সে সময় এ ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসীরা যখন আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে তখন আমাদের নিরাপত্তারক্ষীরা আত্মরক্ষার্থে গুলি করে।’ 

এসব লোকদেখানো
র‍্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় ব্যাখ্যা চাইতে ঢাকার নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারকে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এ বিষয়ে বলেন, ‘পররাষ্ট্রসচিব তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছেন। উনি (মার্কিন রাষ্ট্রদূত) অনেকটা অবাক হয়েছেন।’

বাংলাদেশ ভূরাজনীতির শিকার কি না, এ প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘হতে পারে। কী হচ্ছে, আমরা একটু বিবেচনা করব।’ এই ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, সেই প্রশ্নে মোমেন বলেন, সম্পর্কে প্রভাব পড়বে কি না তা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করছে। যে দেশগুলো উন্নতি করে, যে দেশের সরকার ভালো কাজ করে, অনেক সময়ে তাদের ওপর আক্রমণ হয়। বিভিন্ন দেশের নাম বলতে পারব, অনেক দেশ অনেক ভালো কাজ করছিল, তাদের বিভিন্ন অজুহাতে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

কিছু এনজিও এবং মানবাধিকার সংস্থা র‍্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

এখানে মার্কিনিরাও কিছু পর্যবেক্ষণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ছয় লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়। কীভাবে এত মানুষ নিখোঁজ হয় তা মার্কিন সরকার জানে না।

আর প্রতিবছর মার্কিন পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালনের সময় হাজারখানেক মানুষ মেরে ফেলে। আর বাংলাদেশে নাকি র‍্যাব ১০ বছরে ৬০০ জনকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু কাকে মেরেছে, তার তথ্য আমাদের কাছে নেই। মার্কিন সরকারের আরও সঠিক তথ্যনির্ভর হওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এক ঢং শুরু হলো, প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা। এটি খুব দুঃখজনক এবং এগুলো লোকদেখানো। কারণ সব দেশেই কিছু মানুষ নিখোঁজ হয়।’ 

এটা অবশ্যম্ভাবী: ফখরুল
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, র‍্যাব কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। যদিও বিএনপি সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠার পর থেকে র‍্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে গতকাল এক আলোচনা সভায় ফখরুল বলেন, ‘আমি এটাকে চমক মনে করি না, এটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়, জনগণকে হত্যা করে, তাদের পরিণতি এমনই হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন, মানুষকে বেআইনিভাবে হত্যা ও গুম করায় যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাবের ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এর জবাব দিতেই হবে।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা এত দিন ধরে বলে আসছি মানবাধিকার হরণ করা হচ্ছে। এই সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে, প্রশাসনকে ব্যবহার করছে, পুলিশকে ব্যবহার করছে, মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করছে—সেটাই আজকে প্রমাণিত হয়েছে। গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে রাখা হয়নি, এতেও সেটা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা এখন দেখতে চাই, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নেয়।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত