ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখ। ভারতীয় সময় বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট। গভীর আগ্রহ নিয়ে ভারতের সংসদ অপেক্ষা করছে একটি সুসংবাদের আশায়। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! ভারতের লোকসভায় অতি ধীর পিনপতন নীরবতায় অত্যন্ত আবেগমথিত কিন্তু আনন্দ উচ্ছ্বাসে হাসিমাখা মুখে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ‘ঢাকা এখন মুক্ত দেশের মুক্ত রাজধানী।’
বিকেল ৪টার পর থেকেই ভারতের লোকসভার সদস্যরা ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করা হবে বলে আশা করছিলেন।
কিন্তু বিকেল ৪টার মধ্যে আত্মসমর্পণের খবর না আসায় সভা মুলতবি করা হয়। ঠিক হয় আবার সাড়ে ৫টায় অধিবেশন বসবে। সব জল্পনা-কল্পনা আর সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে সাড়ে ৫টায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘোষণা পড়ে শোনান। ভারতের সংসদ উল্লসিত হয়ে ওঠে, আনন্দে সংসদ সদস্যরা নাচতে থাকেন।
নতুন রাষ্ট্র সোনার বাংলার বাস্তবিক ও আইনমাফিক জন্মলাভে ভারতের সংসদ সদস্যরা আনন্দে দিশাহারা। মুহুর্মুহু হাততালি, টেবিল চাপড়ানো আনন্দ, হর্ষধ্বনি এবং নৃত্য উল্লাসে ভারতীয় লোকসভা নতুন দেশ বাংলাদেশের জন্মক্ষণের ঘোষণায় সরকারি এবং বিরোধী দল মিলেমিশে একাকার। এই আনন্দক্ষণের জন্য ২ মিনিট প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। এরপর তিনি তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের জনগণের এই বিজয়মুহূর্তে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানান। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম শুভক্ষণে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে লোকসভার সদস্যদের এই বলে সম্ভাষণ করলেন:
‘মাননীয় স্পিকার স্যার, আমার একটি ঘোষণা দেওয়ার আছে, যার জন্য হয়তো কিছুক্ষণ ধরে আপনারা অপেক্ষা করছেন। বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত রাজধানী। এই ঐতিহাসিক ঘটনায়, লোকসভা এবং সমগ্র জাতি আনন্দে ভাসছে। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের ক্ষণে আমরা বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাই। আমরা অভিনন্দন জানাই মুক্তিবাহিনীর সাহসী সদস্য ও তরুণদের—তাঁদের সাহস ও আত্মোৎসর্গ করার প্রবণতাকে। আমরা আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ সব প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য গর্ব অনুভব করছি। আমরা আশা ও বিশ্বাস করি, এই নতুন রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের মাঝে যথাযোগ্য স্থানে অধিষ্ঠিত হবেন এবং শান্তি, প্রগতি ও উন্নতির পথে বাংলাদেশকে চালিত করবেন। তাঁরা সবাই মিলে তাঁদের সোনার বাংলার উন্নতি এবং অর্থবহ ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পারেন। তাঁদের জন্য রয়েছে আমাদের শুভেচ্ছা।’
বাংলাদেশের বিজয়লগ্নে ভারতবাসীর আনন্দে যুক্ত হয়েছিল সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিবিদ সবাই। তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দ উচ্ছ্বাস হয়েছিল কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অবদান কলকাতাবাসীর এবং সেটা বহুমাত্রিকতার। শরণার্থীশিবির থেকে রণাঙ্গনে, কূটনৈতিক অঙ্গনে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক বাংলা আরেক বাংলার সাথি হয়ে মিলেমিশে সীমাহীন দুঃখ, আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। নয় মাস ধরে চলা এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয়েছে বা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছে—এ খবরের আকস্মিকতায় কলকাতা শহরবাসী স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে পড়ে। এই কারণে উৎসব পালনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি হয়েছিল হঠাৎ করেই। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে কলকাতা হয়ে ওঠে আনন্দ উৎসবের নগরী। কলকাতাবাসীর মাঝে আনন্দের বন্যা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ ঘিরে। রেডিও নিয়ে দলবদ্ধ মানুষ শুনছে একটি করে ঘোষণা। সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জনতার উল্লাস। বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়েছে। এ জয় শুধু মিত্র বাহিনীর জয় নয়, শুধু ভারতীয় বাহিনীর জয় নয়। এই জয় মুক্তিকামী দুনিয়ার মানুষের জয়। এই জয় বাংলাদেশের মানুষের জয়। অলিতে-গলিতে বেজে ওঠে শঙ্খ। আতশবাজির আলোয় আকাশ ঝলমল করতে থাকে। সেই সঙ্গে হাতবোমার কান ফাটানো শব্দে মাঝে মাঝে অনেকেই চমকে ওঠেন। ঘরে-বাইরে চলে মিষ্টি বিতরণ। স্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সোনার বাংলা গড়তে তাদের এক দিনের বেতনদানের সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশের বিজয়ে কলকাতায় আনন্দ উৎসব চলে বেশ কয়েক দিন ধরে। তবে ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর ছিল মুখ্য উৎসব; যা ওই বছরের শারদীয় উৎসবকেও হার মানিয়েছিল। সাধারণ মানুষের এই উৎসব কেমন ছিল, তার সচিত্র বিবরণ পাওয়া যায় কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায়। এতে উল্লেখ করা হয়: ‘...উৎসব-আনন্দ গতকাল [১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১] তারা করেছিল, তাতেও তাদের সাধ মেটেনি। আজ [১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১] তারা সেই সাধ মিটিয়েছে। সকাল থেকেই আজকের নগরী ছিল উৎসব নগরী। পথে মানুষের ভিড় শারদোৎসবকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। জয় বাংলা, জয় ভারত, জয় জওয়ান ও জয় কিষান ধ্বনিতে মুখরিত। আজ শুধু চারদিকে জয়, জয়, জয়।’
রাজনৈতিক দল, নেতা ও কর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি শুভকামনা জানিয়ে পশ্চিম বাংলার প্রতিটি রাজনৈতিক দলই বিজয় উৎসব করেছিল। পশ্চিম বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসের (শাসক) সভাপতি আবদুস সাত্তার এক বিবৃতি দেন। তিনি ভারতীয় বীর জওয়ান এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অপূর্ব রণকৌশলের কাছে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে হানাদার বাহিনীর প্রধান লে. জে. নিয়াজি বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করায় সবাইকে অভিনন্দন জানান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ আজ সম্পূর্ণ মুক্ত এবং স্বাধীন। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান কর্তব্য বলে বক্তব্য দেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি, সিপিএম নেতা জ্যোতি বসুসহ সবাই। জ্যোতি বসু সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ঢাকায় পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদের জন্য ভারতবর্ষের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। পার্টি এই সংবাদকে স্বাগত জানাচ্ছে।’ নবগঠিত বাংলাদেশের মঙ্গল কামনা করেন তৎকালীন রাজ্য পার্টির সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এবার সরিয়ে আনা দরকার বলে প্রায় সব দল থেকে এ বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল।
পশ্চিম বাংলার কংগ্রেসের উদ্যোগে কলকাতার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। পতাকার মধ্যে ছিল ভারতীয় জাতীয় পতাকা, কংগ্রেসের দলীয় পতাকা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আলোর মালা দিয়ে সেজেছিল নগরী। কংগ্রেসের বিজয় র্যালির বিস্তৃতি ছিল দেশবন্ধু পার্ক থেকে উত্তর কলকাতা, উত্তর শহরতলির বিভিন্ন পথ পরিক্রমার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিজয় র্যালিতে অংশ নেওয়া লরি, প্রাইভেট কার, জিপ এবং সাইকেলের বহরে শোভা পাচ্ছিল ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি।
বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নটি ভারতবাসীর কাছে ছিল গণতন্ত্রের এক আদর্শের লড়াই হিসেবে। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক ও মানবিক সমাধানই প্রতিটি ভারতবাসী চেয়েছিলেন। পৃথিবীতে আদর্শের জন্য অনেক লড়াই হয়েছে। যে লড়াইয়ের মোকাবিলা মিত্র ও মুক্তি বাহিনী করেছে, সেটিও ছিল আদর্শের। সেই আদর্শ স্বাধীনতার, গণতন্ত্রের এবং মানবতার—কোনো বৈষয়িক লাভের জন্য নয়। পররাজ্য গ্রাসের জন্যও এই লড়াই ছিল না। সে কারণে যুদ্ধে যেমন দুই দেশের জনগণ জীবন উৎসর্গ করেছে, আবার ঠিক বিজয়ের আনন্দকেও ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখ। ভারতীয় সময় বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট। গভীর আগ্রহ নিয়ে ভারতের সংসদ অপেক্ষা করছে একটি সুসংবাদের আশায়। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! ভারতের লোকসভায় অতি ধীর পিনপতন নীরবতায় অত্যন্ত আবেগমথিত কিন্তু আনন্দ উচ্ছ্বাসে হাসিমাখা মুখে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ‘ঢাকা এখন মুক্ত দেশের মুক্ত রাজধানী।’
বিকেল ৪টার পর থেকেই ভারতের লোকসভার সদস্যরা ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করা হবে বলে আশা করছিলেন।
কিন্তু বিকেল ৪টার মধ্যে আত্মসমর্পণের খবর না আসায় সভা মুলতবি করা হয়। ঠিক হয় আবার সাড়ে ৫টায় অধিবেশন বসবে। সব জল্পনা-কল্পনা আর সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে সাড়ে ৫টায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘোষণা পড়ে শোনান। ভারতের সংসদ উল্লসিত হয়ে ওঠে, আনন্দে সংসদ সদস্যরা নাচতে থাকেন।
নতুন রাষ্ট্র সোনার বাংলার বাস্তবিক ও আইনমাফিক জন্মলাভে ভারতের সংসদ সদস্যরা আনন্দে দিশাহারা। মুহুর্মুহু হাততালি, টেবিল চাপড়ানো আনন্দ, হর্ষধ্বনি এবং নৃত্য উল্লাসে ভারতীয় লোকসভা নতুন দেশ বাংলাদেশের জন্মক্ষণের ঘোষণায় সরকারি এবং বিরোধী দল মিলেমিশে একাকার। এই আনন্দক্ষণের জন্য ২ মিনিট প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। এরপর তিনি তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের জনগণের এই বিজয়মুহূর্তে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানান। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম শুভক্ষণে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে লোকসভার সদস্যদের এই বলে সম্ভাষণ করলেন:
‘মাননীয় স্পিকার স্যার, আমার একটি ঘোষণা দেওয়ার আছে, যার জন্য হয়তো কিছুক্ষণ ধরে আপনারা অপেক্ষা করছেন। বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত রাজধানী। এই ঐতিহাসিক ঘটনায়, লোকসভা এবং সমগ্র জাতি আনন্দে ভাসছে। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের ক্ষণে আমরা বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাই। আমরা অভিনন্দন জানাই মুক্তিবাহিনীর সাহসী সদস্য ও তরুণদের—তাঁদের সাহস ও আত্মোৎসর্গ করার প্রবণতাকে। আমরা আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ সব প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য গর্ব অনুভব করছি। আমরা আশা ও বিশ্বাস করি, এই নতুন রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের মাঝে যথাযোগ্য স্থানে অধিষ্ঠিত হবেন এবং শান্তি, প্রগতি ও উন্নতির পথে বাংলাদেশকে চালিত করবেন। তাঁরা সবাই মিলে তাঁদের সোনার বাংলার উন্নতি এবং অর্থবহ ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পারেন। তাঁদের জন্য রয়েছে আমাদের শুভেচ্ছা।’
বাংলাদেশের বিজয়লগ্নে ভারতবাসীর আনন্দে যুক্ত হয়েছিল সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিবিদ সবাই। তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দ উচ্ছ্বাস হয়েছিল কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অবদান কলকাতাবাসীর এবং সেটা বহুমাত্রিকতার। শরণার্থীশিবির থেকে রণাঙ্গনে, কূটনৈতিক অঙ্গনে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক বাংলা আরেক বাংলার সাথি হয়ে মিলেমিশে সীমাহীন দুঃখ, আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। নয় মাস ধরে চলা এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয়েছে বা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছে—এ খবরের আকস্মিকতায় কলকাতা শহরবাসী স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে পড়ে। এই কারণে উৎসব পালনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি হয়েছিল হঠাৎ করেই। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে কলকাতা হয়ে ওঠে আনন্দ উৎসবের নগরী। কলকাতাবাসীর মাঝে আনন্দের বন্যা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ ঘিরে। রেডিও নিয়ে দলবদ্ধ মানুষ শুনছে একটি করে ঘোষণা। সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জনতার উল্লাস। বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়েছে। এ জয় শুধু মিত্র বাহিনীর জয় নয়, শুধু ভারতীয় বাহিনীর জয় নয়। এই জয় মুক্তিকামী দুনিয়ার মানুষের জয়। এই জয় বাংলাদেশের মানুষের জয়। অলিতে-গলিতে বেজে ওঠে শঙ্খ। আতশবাজির আলোয় আকাশ ঝলমল করতে থাকে। সেই সঙ্গে হাতবোমার কান ফাটানো শব্দে মাঝে মাঝে অনেকেই চমকে ওঠেন। ঘরে-বাইরে চলে মিষ্টি বিতরণ। স্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সোনার বাংলা গড়তে তাদের এক দিনের বেতনদানের সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশের বিজয়ে কলকাতায় আনন্দ উৎসব চলে বেশ কয়েক দিন ধরে। তবে ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর ছিল মুখ্য উৎসব; যা ওই বছরের শারদীয় উৎসবকেও হার মানিয়েছিল। সাধারণ মানুষের এই উৎসব কেমন ছিল, তার সচিত্র বিবরণ পাওয়া যায় কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায়। এতে উল্লেখ করা হয়: ‘...উৎসব-আনন্দ গতকাল [১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১] তারা করেছিল, তাতেও তাদের সাধ মেটেনি। আজ [১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১] তারা সেই সাধ মিটিয়েছে। সকাল থেকেই আজকের নগরী ছিল উৎসব নগরী। পথে মানুষের ভিড় শারদোৎসবকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। জয় বাংলা, জয় ভারত, জয় জওয়ান ও জয় কিষান ধ্বনিতে মুখরিত। আজ শুধু চারদিকে জয়, জয়, জয়।’
রাজনৈতিক দল, নেতা ও কর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি শুভকামনা জানিয়ে পশ্চিম বাংলার প্রতিটি রাজনৈতিক দলই বিজয় উৎসব করেছিল। পশ্চিম বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসের (শাসক) সভাপতি আবদুস সাত্তার এক বিবৃতি দেন। তিনি ভারতীয় বীর জওয়ান এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অপূর্ব রণকৌশলের কাছে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে হানাদার বাহিনীর প্রধান লে. জে. নিয়াজি বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করায় সবাইকে অভিনন্দন জানান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ আজ সম্পূর্ণ মুক্ত এবং স্বাধীন। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান কর্তব্য বলে বক্তব্য দেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি, সিপিএম নেতা জ্যোতি বসুসহ সবাই। জ্যোতি বসু সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ঢাকায় পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদের জন্য ভারতবর্ষের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। পার্টি এই সংবাদকে স্বাগত জানাচ্ছে।’ নবগঠিত বাংলাদেশের মঙ্গল কামনা করেন তৎকালীন রাজ্য পার্টির সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এবার সরিয়ে আনা দরকার বলে প্রায় সব দল থেকে এ বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল।
পশ্চিম বাংলার কংগ্রেসের উদ্যোগে কলকাতার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। পতাকার মধ্যে ছিল ভারতীয় জাতীয় পতাকা, কংগ্রেসের দলীয় পতাকা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আলোর মালা দিয়ে সেজেছিল নগরী। কংগ্রেসের বিজয় র্যালির বিস্তৃতি ছিল দেশবন্ধু পার্ক থেকে উত্তর কলকাতা, উত্তর শহরতলির বিভিন্ন পথ পরিক্রমার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিজয় র্যালিতে অংশ নেওয়া লরি, প্রাইভেট কার, জিপ এবং সাইকেলের বহরে শোভা পাচ্ছিল ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি।
বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নটি ভারতবাসীর কাছে ছিল গণতন্ত্রের এক আদর্শের লড়াই হিসেবে। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক ও মানবিক সমাধানই প্রতিটি ভারতবাসী চেয়েছিলেন। পৃথিবীতে আদর্শের জন্য অনেক লড়াই হয়েছে। যে লড়াইয়ের মোকাবিলা মিত্র ও মুক্তি বাহিনী করেছে, সেটিও ছিল আদর্শের। সেই আদর্শ স্বাধীনতার, গণতন্ত্রের এবং মানবতার—কোনো বৈষয়িক লাভের জন্য নয়। পররাজ্য গ্রাসের জন্যও এই লড়াই ছিল না। সে কারণে যুদ্ধে যেমন দুই দেশের জনগণ জীবন উৎসর্গ করেছে, আবার ঠিক বিজয়ের আনন্দকেও ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে