প্রিয় কবি রুদ্র

রুশা চৌধুরী
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ০৭: ৪৪

তখন স্কুলে পড়ি। নতুন নতুন লেখক, কবিদের চিনতে শুরু করছি। হঠাৎ অদ্ভুত সুন্দর চোখের এক কবির কবিতা পড়লাম, যা নাড়া দিয়ে গেল ভেতরটাকে!

‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়, বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।’ 

জানলাম, মাত্র ৩৪ বছরেই বিদায় নিয়েছেন।

অনেক প্রচার, অপপ্রচার, রটনা, খুব ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মাতামাতি দিয়ে কবি রুদ্রকে ঢেকে রাখার নানা চেষ্টা দেখতাম। একসময় সেই দেখাটা একদম পারিবারিক গণ্ডিতে চলে এল যখন বৈবাহিক সূত্রে তাঁর পরিবারের অংশ হয়ে গেলাম।

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর পরিবারটি ছিল একদম মাটির কাছাকাছি। বাবা মোংলা পোর্টের ডাক্তার ছিলেন, আর মা ছিলেন সেই অঞ্চলের জমিদারের একমাত্র কন্যা। সেই সময়ে কন্যাকে পুত্রের সমতুল্য ভাবার মানসিকতা ছিল সেই পরিবারের। মায়ের বাড়ি মিঠেখালি ছিল তাঁর বেড়ে ওঠার এবং জীবনের অনেকটা সময় কাটানোর স্থান।

কবি ছিলেন ১০ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। একদম গল্প, উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা আদর্শ বড় ভাই যেমন হয়। ভাইবোনদের নখ-চুল কাটা থেকে পড়াশোনা, সুন্দর করে কথা বলা, হাতের লেখা, স্কুলের বাইরের বই পড়া, টেবিল ম্যানার্স—সব দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল।

বাবা ছিলেন ডাক্তার আর অত্যন্ত ধার্মিক। বাবার কড়া শাসনের সবটুকুই প্রায় তিনি একাই সহ্য করেছিলেন। বাবার দেওয়া সনাতন নাম ‘মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র আগে ‘রুদ্র’ যোগ করে নিজে যেমন বদলে নিয়েছিলেন নিজের নাম, তেমনি সব ভাইবোনেরটাও বদলে দিয়েছিলেন তিনিই। যেমন ‘আবদুল্লাহ’ থেকে ‘আবীর আব্দুল্লাহ’, ‘সারাফাত’ থেকে ‘সুমেল সারাফাত’, ‘মরিয়ম’ থেকে ‘মেরী’।

নিজে যখন ঢাকায় গিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন, তখন থেকেই একেকজন ভাইবোনকে মফস্বল শহর থেকে ঢাকা নিয়ে গিয়েছিলেন। ছোট ভাইকে বাবা যখন মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে চেয়েছেন, তিনি যুদ্ধ করে তা প্রতিহত করেছিলেন।

কবির জীবনের আরেকটা বড় বিষয় আছে তা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ। হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালে পোর্ট এলাকার একমাত্র ডাক্তার রুদ্রের বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহকে ধরে নিয়ে যায়। সে সময় ১৫ বছরের রুদ্রকে তাঁর শয্যাশায়ী মা কিছুতেই যুদ্ধে যেতে দেননি। এই যন্ত্রণা তাঁর বিভিন্ন লেখায় বারবার খুঁজে পাই। তবে আজ শুধু পারিবারিক রুদ্রের কথাই বলছি।

সেই অবরুদ্ধ সময়ে রুদ্র তাঁর পিঠাপিঠি বোন বীথিকে নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র শুনতেন, স্লোগান দিতেন, পড়তেন ডায়েরির পাতায় বোনের লেখা যুদ্ধ দিনের কথা, গোপনে সাহায্য করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। দেশ স্বাধীনের খবর পেয়ে তিনি ভাইবোনদের নিয়ে বাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন।

জীবনের একটা সময় বিচ্ছেদ, ভালোবাসা, নানান দ্বন্দ্ব নিয়ে তিনি মিঠেখালি গ্রামে অনেকটা সময় কাটান। পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সমাজ, বিশেষ করে যুব সমাজকে তিনি নানান কাজে উৎসাহিত করতেন, তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেন। অসম্ভব সাহসী রুদ্র, সেই অঞ্চলের দুর্ধর্ষ ডাকাত আজহারকে একা মেরে শায়েস্তা করেছিলেন।

নিভৃতে বসে সবার প্রিয় ‘কবি সাহেব’ তৈরি করেছিলেন গানের দল ‘অন্তর বাজাও’। তারা আজও ভরা পূর্ণিমায় গান গায়, স্মরণ করে সেই অভিমানী কবিকে।

হাসপাতাল থেকে সুস্থতার ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে, পরের দিন ভোরেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন না-ফেরার দেশে। এই দুঃসহ কষ্ট আজও বয়ে বেড়ায় তাঁর পরিবার।

সেই অসম্ভব মায়াবী চোখের কবি আজও তাঁর প্রতিটি ভাইবোনের মাঝে মিশে আছেন। কারও কথায়, কারও সাহসে, কারও লেখনীতে, কারও ভালোবাসার শক্তিতে আর প্রত্যেকের চেহারায় ও মনে তিনি আছেন। তাঁর লেখার মতোই বলতে হয়: 

‘আমি টের পাই,
মাঝরাত্রিতে আমাকে জাগায় স্মৃতি...’

রুদ্রদাও তাঁর তীব্র শক্তিশালী ভালোবাসার স্মৃতি দিয়ে তাঁর পরিবারটিকে বেঁধে রেখেছেন। নিজের সন্তান নেই তাতে কী! তাঁর ভাইবোনেরা আছে, তাদের সন্তানেরা আছে। তাদের সবার চোখে সেই মায়া, যেই মায়া একসময় রুদ্রের চোখে খেলা করত। এক আশ্চর্য, সাহসী আর ভালোবাসায় ভরা কবির জন্মদিন গেছে গতকাল। তাঁকে অনিঃশেষ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানাই তাঁর সেই অবিস্মরণীয় গানের কলির মধ্য দিয়ে:

‘ভালো আছি ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি
বাউলের এই মনটারে...’

লেখক: আবৃত্তি শিল্পী

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত