শরিফুল হাসান
ঈদ সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেই বৈধ বা ব্যাংকিং চ্যানেলে ৯৫ কোটি ৮৭ লাখ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় এর (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা ধরে) পরিমাণ ১০ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা।
এর আগে মার্চ মাসে বৈধ পথে দেশে এসেছে ২০১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২১ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। আর
২০২২-২৩ অর্থবছরের (জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত) ৯ মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৬৩০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৪ কোটি বেশি।
সংকটের এই সময়ে প্রবাসী এই আয় দেশের জন্য ইতিবাচক। কোনো সন্দেহ নেই—রোজা ও ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা বেশি বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ—সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন ও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে বেশি প্রবাসী আয় আসে।
প্রবাসী ভাইবোনদের বলব, এই টাকা পাঠানো অব্যাহত থাকুক। কারণ, অর্থনৈতিক মন্দা হোক কিংবা করোনা মহামারি, যুদ্ধ হোক কিংবা দুর্যোগ, বাংলাদেশের যেকোনো বৈশ্বিক সংকটে বড় ভরসার নাম এই প্রবাসী আয়। আর এই আয়ের নেপথ্যে আছেন এক কোটির বেশি বাংলাদেশি। তাঁরা এক অর্থে দেশের আশীর্বাদ।
অবশ্য প্রবাসীরা পরিবারের কাছে ডলার পাঠালে দেশের জন্য আশীর্বাদ কেন, এই তথ্য সাধারণ মানুষের অনেকেই বুঝতে পারেন না। তাঁদের জন্য সহজ কয়েকটা কথা: আসলে ডলার ছাড়া একটা দেশ চলতে পারে না। পৃথিবীর ৯০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তি হয় ডলারে। এই যে আমাদের জ্বালানি তেল লাগে, বিদেশ থেকে নানা কিছু আমদানি করতে হয়, এর মূল্য পরিশোধ করতে হয় ডলারে। বৈশ্বিক ঋণের ৪০ শতাংশ ইস্যু হয় ডলারে। আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি বা ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ’ হিসেবেও ডলারই ব্যবহৃত হয়।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ডলার ধীরে ধীরে পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা হিসেবে স্থান করে নেয়। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলারের প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি করে স্বর্ণ রিজার্ভের ধারণা থেকে বের করে নিয়ে আসেন বিশ্বকে। এই সময় তাঁরা ডলারের ‘স্বর্ণভিত্তি’ বাতিল করেন। তখন থেকে দেশটি বিশ্বব্যাপী বিভিন্নভাবে ডলারের প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি ও জোগান দেওয়ার মাধ্যমে ডলারকে বিশ্ববাণিজ্যের মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ডলারের ক্ষমতা কমাতে ফ্রান্স ও জার্মানি ১৯৯৯ সালে চালু করে ইউরো মুদ্রা। ওই সময় ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ঘোষণা দেন, ‘তেল আর ডলারে নয়, ইউরোতে বিক্রি করবে ইরাক। এরপর ২০০০ সাল থেকে ইরাক ইউরোতে তেল বিক্রি শুরু করে। ডলারের পতন আশঙ্কায় ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে। তারা সাদ্দাম সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন সরকার বসায় এবং ফের ডলারে তেল বিক্রি শুরু করে।
এককথায় বর্তমান সময়ে ডলার ছাড়া চলা অসম্ভব। আর আমরা চাইলে ধান, চাল, মাংস বা সবকিছুর উৎপাদন চেষ্টা করে বাড়াতে পারি, কালকে যদি মনে করি বেশি টাকা ছাপব, সেটাও পারি, কিন্তু একটা ডলার তৈরির ক্ষমতাও আমাদের নেই। আর সে কারণেই আমরা চাই বৈধপথে ডলার আসুক। আমরা আসলে আমাদের লোকজনকে বিদেশে পাঠাই ডলারের জন্য। এই ডলার ছাড়া চলা যায় না। হুন্ডিতে টাকা এলে সেটা দেশের কাজে লাগে না। কিন্তু তারপরও বিপুল পরিমাণ অর্থ হুন্ডিতে লেনদেন হয়।
আসলে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটা বিষয়কে গুরুত্ব দেন। তাঁরা বিবেচনায় নেন, কত দ্রুত দেশে অর্থ পাঠানো যাবে; সেই প্রক্রিয়া কতটা সহজ। এর সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—ডলারের দাম। ডলারের বিপরীতে কত টাকা তিনি পাবেন, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বারবার ডলারের রেট বেঁধে দেওয়া, যেটি খোলাবাজারের চেয়ে অনেক কম, সেটি কিন্তু হুন্ডি বাড়িয়েছে। কারণ হুন্ডিতে রেট বেশি ছিল।
এপ্রিল মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৭৯ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৩৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। এই আয় আরও বাড়ানো সম্ভব। এ জন্য ব্যাংকগুলোর আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
আসলে প্রবাসী জনশক্তির অধিকাংশই শ্রমিক। মধ্যপ্রাচ্যের যেসব জায়গায় থাকেন, সেখান থেকে ব্যাংকের দূরত্ব অনেক বেশি। আবার প্রবাসীদের কাজের সময় ও ব্যাংক খোলা থাকার সময় একই। ফলে ব্যাংকে গেলে ছুটি নিতে হবে, বেতন কাটা যাবে। হুন্ডির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এসব সুযোগ নিয়ে সরাসরি শ্রমিকদের আবাসিক ক্যাম্পে চলে যান। এখন বৈধ সেবাগুলো যদি প্রবাসীদের দোরগোড়ায় না যায়, তাহলে হুন্ডি ঠেকানো কঠিন। কাজেই সব প্রবাসীকে ব্যাংকিংয়ের আওতায় আনতে হবে। এমএফএস বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসগুলোও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কয়েক বছর ধরে গড়ে ১০ লাখেরও বেশি কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন, যাঁরা মূলত নির্মাণশ্রমিক, প্ল্যান্টেশন, কৃষি, সার্ভিস বা উৎপাদন খাতে কাজ করেন। আর তাঁরাই মূলত প্রবাসী আয় পাঠান। আমাদের শিক্ষিত যে শ্রেণিটি একেবারে বিদেশে চলে যান, তাঁদের অধিকাংশই দেশ থেকে সব নিয়ে যান বা পাচার করেন, কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকেরা টাকা পাঠান স্বজনদের জন্য।
কাজেই প্রতিবছর যাঁরা বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন, যাওয়ার আগে প্রত্যেকের দুটি করে ব্যাংক হিসাব খোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। একটিতে তিনি পরিবারের জন্য টাকা পাঠাবেন, আরেকটিতে নিজের জন্য কিছু সঞ্চয় করবেন। এই সঞ্চয়ের ওপর ভিত্তি করে পরে দেশে ফিরলে তাঁকে পেনশন-ভাতা দেওয়াসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
শুধু প্রবাসী নন, দেশে থাকা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্যও উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে করে তিনি দেশে বেশি করে প্রবাসী আয় পাঠান। এ ক্ষেত্রে তাঁর সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, লেখাপড়ায় বৃত্তি, চিকিৎসাব্যবস্থায় বিশেষ সুবিধাসহ আরও অনেক কিছু ভাবা যেতে পারে। প্রবাসীদের দেশে-বিদেশে সম্মান জানাতে রাষ্ট্রীয় কিছু উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যাতে বৈধভাবে তাঁরা প্রবাসী আয় পাঠাতে উৎসাহী হন। দূতাবাসগুলোর উচিত প্রবাসীদের তালিকা করে তাঁদের নিয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করা। সেখানে হুন্ডি প্রতিরোধে প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বিদেশে দক্ষ কর্মী পাঠানো বাড়াতে হবে। এ জন্য নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান জরুরি। পুরোনো কয়েকটি বাজারের দিকেও নজর দিতে হবে।
এই যে প্রবাসীরা বছরে ২২ বা ২৪ বিলিয়ন ডলার পাঠান, এটি কিন্তু বিশাল। সহজ করে বললে, সারা পৃথিবী মিলে বাংলাদেশকে এখন যে পরিমাণ ঋণ বা অনুদান দিচ্ছে বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) যে অর্থ আসছে, তার চেয়ে ছয় থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশ যে এখন আর বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল নয়, তার কারণ এই প্রবাসী আয়।
২০০৮-০৯ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশকে কোনো সংকটে পড়তে হয়নি প্রবাসী আয়ের কারণে। করোনা মহামারির মধ্যেও রেকর্ড পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সারা বিশ্ব যখন সংকটে, সেই সময়ও বাংলাদেশের ভরসা প্রবাসী আয়।
এই বিশাল অবদানের পরও প্রবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু বদলায়নি। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দূতাবাস—সবখানেই পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই শুরু। এরপর দালাল, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্রসহ সবখানে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত-কী! আবার বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে গেলে কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলে না, দেশে ফিরলেও ভোগান্তি।
যদিও পরিস্থিতি একটু একটু ইতিবাচক হচ্ছে এবং মন্ত্রণালয় ও সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। তবু এখনো অনেক পথচলা বাকি। তবে যত উদ্যোগ হোক, সবার আগে প্রবাসীদের সম্মান দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, তাঁরাও মানুষ। মনে রাখতে হবে, এক কোটির বেশি প্রবাসী শুধু যে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন তা নয়, অনেক দূর থেকেও বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছেন
লাল-সবুজের জন্য ভালোবাসা। দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে তাঁরাই আমাদের ভরসা। তাঁদের জন্য ভালোবাসা। তাঁদের সবাইকে ঈদ মোবারক।
লেখক: হেড অব মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভস, ব্র্যাক এবং কলামিস্ট
ঈদ সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেই বৈধ বা ব্যাংকিং চ্যানেলে ৯৫ কোটি ৮৭ লাখ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় এর (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা ধরে) পরিমাণ ১০ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা।
এর আগে মার্চ মাসে বৈধ পথে দেশে এসেছে ২০১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২১ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। আর
২০২২-২৩ অর্থবছরের (জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত) ৯ মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৬৩০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৪ কোটি বেশি।
সংকটের এই সময়ে প্রবাসী এই আয় দেশের জন্য ইতিবাচক। কোনো সন্দেহ নেই—রোজা ও ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা বেশি বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ—সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন ও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে বেশি প্রবাসী আয় আসে।
প্রবাসী ভাইবোনদের বলব, এই টাকা পাঠানো অব্যাহত থাকুক। কারণ, অর্থনৈতিক মন্দা হোক কিংবা করোনা মহামারি, যুদ্ধ হোক কিংবা দুর্যোগ, বাংলাদেশের যেকোনো বৈশ্বিক সংকটে বড় ভরসার নাম এই প্রবাসী আয়। আর এই আয়ের নেপথ্যে আছেন এক কোটির বেশি বাংলাদেশি। তাঁরা এক অর্থে দেশের আশীর্বাদ।
অবশ্য প্রবাসীরা পরিবারের কাছে ডলার পাঠালে দেশের জন্য আশীর্বাদ কেন, এই তথ্য সাধারণ মানুষের অনেকেই বুঝতে পারেন না। তাঁদের জন্য সহজ কয়েকটা কথা: আসলে ডলার ছাড়া একটা দেশ চলতে পারে না। পৃথিবীর ৯০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তি হয় ডলারে। এই যে আমাদের জ্বালানি তেল লাগে, বিদেশ থেকে নানা কিছু আমদানি করতে হয়, এর মূল্য পরিশোধ করতে হয় ডলারে। বৈশ্বিক ঋণের ৪০ শতাংশ ইস্যু হয় ডলারে। আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি বা ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ’ হিসেবেও ডলারই ব্যবহৃত হয়।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ডলার ধীরে ধীরে পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা হিসেবে স্থান করে নেয়। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলারের প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি করে স্বর্ণ রিজার্ভের ধারণা থেকে বের করে নিয়ে আসেন বিশ্বকে। এই সময় তাঁরা ডলারের ‘স্বর্ণভিত্তি’ বাতিল করেন। তখন থেকে দেশটি বিশ্বব্যাপী বিভিন্নভাবে ডলারের প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি ও জোগান দেওয়ার মাধ্যমে ডলারকে বিশ্ববাণিজ্যের মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ডলারের ক্ষমতা কমাতে ফ্রান্স ও জার্মানি ১৯৯৯ সালে চালু করে ইউরো মুদ্রা। ওই সময় ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ঘোষণা দেন, ‘তেল আর ডলারে নয়, ইউরোতে বিক্রি করবে ইরাক। এরপর ২০০০ সাল থেকে ইরাক ইউরোতে তেল বিক্রি শুরু করে। ডলারের পতন আশঙ্কায় ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে। তারা সাদ্দাম সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন সরকার বসায় এবং ফের ডলারে তেল বিক্রি শুরু করে।
এককথায় বর্তমান সময়ে ডলার ছাড়া চলা অসম্ভব। আর আমরা চাইলে ধান, চাল, মাংস বা সবকিছুর উৎপাদন চেষ্টা করে বাড়াতে পারি, কালকে যদি মনে করি বেশি টাকা ছাপব, সেটাও পারি, কিন্তু একটা ডলার তৈরির ক্ষমতাও আমাদের নেই। আর সে কারণেই আমরা চাই বৈধপথে ডলার আসুক। আমরা আসলে আমাদের লোকজনকে বিদেশে পাঠাই ডলারের জন্য। এই ডলার ছাড়া চলা যায় না। হুন্ডিতে টাকা এলে সেটা দেশের কাজে লাগে না। কিন্তু তারপরও বিপুল পরিমাণ অর্থ হুন্ডিতে লেনদেন হয়।
আসলে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটা বিষয়কে গুরুত্ব দেন। তাঁরা বিবেচনায় নেন, কত দ্রুত দেশে অর্থ পাঠানো যাবে; সেই প্রক্রিয়া কতটা সহজ। এর সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—ডলারের দাম। ডলারের বিপরীতে কত টাকা তিনি পাবেন, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বারবার ডলারের রেট বেঁধে দেওয়া, যেটি খোলাবাজারের চেয়ে অনেক কম, সেটি কিন্তু হুন্ডি বাড়িয়েছে। কারণ হুন্ডিতে রেট বেশি ছিল।
এপ্রিল মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৭৯ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৩৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। এই আয় আরও বাড়ানো সম্ভব। এ জন্য ব্যাংকগুলোর আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
আসলে প্রবাসী জনশক্তির অধিকাংশই শ্রমিক। মধ্যপ্রাচ্যের যেসব জায়গায় থাকেন, সেখান থেকে ব্যাংকের দূরত্ব অনেক বেশি। আবার প্রবাসীদের কাজের সময় ও ব্যাংক খোলা থাকার সময় একই। ফলে ব্যাংকে গেলে ছুটি নিতে হবে, বেতন কাটা যাবে। হুন্ডির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এসব সুযোগ নিয়ে সরাসরি শ্রমিকদের আবাসিক ক্যাম্পে চলে যান। এখন বৈধ সেবাগুলো যদি প্রবাসীদের দোরগোড়ায় না যায়, তাহলে হুন্ডি ঠেকানো কঠিন। কাজেই সব প্রবাসীকে ব্যাংকিংয়ের আওতায় আনতে হবে। এমএফএস বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসগুলোও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কয়েক বছর ধরে গড়ে ১০ লাখেরও বেশি কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন, যাঁরা মূলত নির্মাণশ্রমিক, প্ল্যান্টেশন, কৃষি, সার্ভিস বা উৎপাদন খাতে কাজ করেন। আর তাঁরাই মূলত প্রবাসী আয় পাঠান। আমাদের শিক্ষিত যে শ্রেণিটি একেবারে বিদেশে চলে যান, তাঁদের অধিকাংশই দেশ থেকে সব নিয়ে যান বা পাচার করেন, কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকেরা টাকা পাঠান স্বজনদের জন্য।
কাজেই প্রতিবছর যাঁরা বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন, যাওয়ার আগে প্রত্যেকের দুটি করে ব্যাংক হিসাব খোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। একটিতে তিনি পরিবারের জন্য টাকা পাঠাবেন, আরেকটিতে নিজের জন্য কিছু সঞ্চয় করবেন। এই সঞ্চয়ের ওপর ভিত্তি করে পরে দেশে ফিরলে তাঁকে পেনশন-ভাতা দেওয়াসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
শুধু প্রবাসী নন, দেশে থাকা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্যও উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে করে তিনি দেশে বেশি করে প্রবাসী আয় পাঠান। এ ক্ষেত্রে তাঁর সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, লেখাপড়ায় বৃত্তি, চিকিৎসাব্যবস্থায় বিশেষ সুবিধাসহ আরও অনেক কিছু ভাবা যেতে পারে। প্রবাসীদের দেশে-বিদেশে সম্মান জানাতে রাষ্ট্রীয় কিছু উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যাতে বৈধভাবে তাঁরা প্রবাসী আয় পাঠাতে উৎসাহী হন। দূতাবাসগুলোর উচিত প্রবাসীদের তালিকা করে তাঁদের নিয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করা। সেখানে হুন্ডি প্রতিরোধে প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বিদেশে দক্ষ কর্মী পাঠানো বাড়াতে হবে। এ জন্য নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান জরুরি। পুরোনো কয়েকটি বাজারের দিকেও নজর দিতে হবে।
এই যে প্রবাসীরা বছরে ২২ বা ২৪ বিলিয়ন ডলার পাঠান, এটি কিন্তু বিশাল। সহজ করে বললে, সারা পৃথিবী মিলে বাংলাদেশকে এখন যে পরিমাণ ঋণ বা অনুদান দিচ্ছে বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) যে অর্থ আসছে, তার চেয়ে ছয় থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশ যে এখন আর বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল নয়, তার কারণ এই প্রবাসী আয়।
২০০৮-০৯ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশকে কোনো সংকটে পড়তে হয়নি প্রবাসী আয়ের কারণে। করোনা মহামারির মধ্যেও রেকর্ড পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সারা বিশ্ব যখন সংকটে, সেই সময়ও বাংলাদেশের ভরসা প্রবাসী আয়।
এই বিশাল অবদানের পরও প্রবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু বদলায়নি। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দূতাবাস—সবখানেই পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই শুরু। এরপর দালাল, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্রসহ সবখানে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত-কী! আবার বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে গেলে কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলে না, দেশে ফিরলেও ভোগান্তি।
যদিও পরিস্থিতি একটু একটু ইতিবাচক হচ্ছে এবং মন্ত্রণালয় ও সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। তবু এখনো অনেক পথচলা বাকি। তবে যত উদ্যোগ হোক, সবার আগে প্রবাসীদের সম্মান দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, তাঁরাও মানুষ। মনে রাখতে হবে, এক কোটির বেশি প্রবাসী শুধু যে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন তা নয়, অনেক দূর থেকেও বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছেন
লাল-সবুজের জন্য ভালোবাসা। দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে তাঁরাই আমাদের ভরসা। তাঁদের জন্য ভালোবাসা। তাঁদের সবাইকে ঈদ মোবারক।
লেখক: হেড অব মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভস, ব্র্যাক এবং কলামিস্ট
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১৯ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে