মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিশোরগঞ্জে নবপ্রতিষ্ঠিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাস উদ্বোধন করেন। এরপর তিনি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হেলিপ্যাড মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় ভাষণ দেন। এই হাওর অঞ্চল একসময় জনবিচ্ছিন্ন ছিল; ছিল না রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং উন্নত জীবনযাত্রার ব্যবস্থাও। কিন্তু গত ১৩-১৪ বছরে গোটা কিশোরগঞ্জই বদলে গেছে। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ফলে ওই দিনের জনসভায় গোটা অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন। বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মানুষ খেয়েপরে ভালো থাকে। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। অন্তত ১৪ বছরে আজকের বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছে, বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’
মিঠামইনের জনসভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন প্রাণবন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত। আগের মতো দারিদ্র্যের ছাপ তাঁদের মধ্যে দেখা যায়নি। বদলে যাওয়া কিশোরগঞ্জের মানুষ ১০-১২ বছর আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত যোগাযোগ, যাতায়াত, কৃষি, নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদিতে জীবন অনেকটাই পাল্টে দিতে পেরেছেন। এই অঞ্চলের কোথাও তেমন হাহাকার, অভাব-অনটন কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষের প্রকাশ ঘটানোর মতো তেমন কিছু এ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু এক যুগ আগেই এই এলাকার মানুষের বেশির ভাগই হাওর-বিলের কারণে অতি সাধারণ দারিদ্র্য জীবনের মধ্যে আটকে ছিল।
তাই বলে আমরা এ কথা বলব না যে, করোনা অতিমারির দুই বছর এবং ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের অভিঘাতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সবাই খুব ভালো আছেন, কারও কোনো অভাব নেই, সমস্যা নেই। সারা বিশ্বের মতোই আমাদের দেশেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ব্যয় যতটা বেড়েছে, আয় হয়তো ততটা বাড়েনি। তবে সবার অবস্থা এক রকম নয়। হাহাকার করার মতো পরিস্থিতি গ্রামগঞ্জে সৃষ্টি হয়েছে—এমন খবর আমাদের কানে এ পর্যন্ত আসেনি। কিছুটা টানাটানি কোনো কোনো পরিবারে নতুন করে দেখা দিচ্ছে। কিন্তু সেগুলোতেও সরকার নানা ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে, কেউ ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্যসামগ্রী কেনার সুযোগ পাচ্ছে, অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ভাতা, শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলো উপবৃত্তি পাচ্ছে, ওএমএস এবং কম ও বিনা মূল্যে চালসহ কিছু কিছু পণ্য তারা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে পাচ্ছে। এর বাইরে বেশির ভাগ মানুষই এখন কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নানা ধরনের পরিবহন, মৎস্য চাষ, পশুপালন এবং প্রবাসে কর্মরত আছেন। প্রবাসীরা নিয়মিত বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাচ্ছেন। গ্রামগঞ্জে অন্যরা যা উপার্জন করছেন, তাতে অনেকে বেশ ভালো আছেন, কেউ কেউ হয়তো ততটা ভালো করতে পারছেন না। কিন্তু খেয়েপরে সবাই কমবেশি স্বাচ্ছন্দ্যেই আছেন।
গ্রামে এখন কাঁচা বাড়ির সংখ্যা কমে যাচ্ছে, পাকা বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। যাঁদের ঘর নেই, তারা শেখ হাসিনার ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের’ মাধ্যমে আধা পাকা বাড়ি পাচ্ছেন। আয়-উপার্জন করে মোটামুটি সুন্দর জীবনযাপন করছেন। যাঁরা শারীরিক পরিশ্রম করতে পারেন, তাঁরা প্রতিদিনই খেতখামারে কাজ করে ৫০০-৬০০ টাকা আয় করছেন। বদলে যাওয়া এই পরিস্থিতি এখন সাধারণ দৃশ্য। এই দৃশ্য আগে কেউ কল্পনা করতে পারেনি। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রভাব মানুষের আর্থসামাজিক জীবনব্যবস্থায় যে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, তার ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায়ও আমাদের বেশির ভাগ মানুষই নিজস্ব আয়-উপার্জনে যাঁর যাঁর মতো করে চলতে পারছেন। বাকিদের পাশে সরকারি নানা ধরনের প্রণোদনা ও সহযোগিতা থাকায় তাঁদের ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হচ্ছে না।
গ্রামে কোথাও তেমন ভিক্ষুকের আনাগোনা চোখে পড়ছে না।
গ্রামের সঙ্গে আমাদের কমবেশি যোগাযোগ মোবাইল ফোনেই রয়েছে। খোঁজখবর প্রায় প্রতিদিনই পাচ্ছি। আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করে এলাকায় বেশ ভালো আছেন। বেচাকেনার কথা জানতে চাইলে কেউ বলেন না যে সাধারণ ক্রেতারা তেল, আটা, মুদি কেনাকাটায় অক্ষম হয়ে পড়েছেন কিংবা না কিনে বাড়ি ফিরে চলে যাচ্ছেন। এই যখন গ্রামের অবস্থা, তখন বুঝতে কষ্ট হয় না যে মানুষ বর্তমান বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক সংকটের কালে খুব খারাপ আছে, না খেয়ে দিনাতিপাত করছে কিংবা হাহাকার করে বেড়াচ্ছে। হ্যাঁ, কিছু কিছু আমদানি করা পণ্যের দাম আগের চেয়েও বেশ বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীদেরও একটি বড় অংশ দাম বাড়ানোর নানা অজুহাত, ফন্দিফিকির করে বেড়াচ্ছে। ফলে দামের ওঠানামাটা অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিম, স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়তি। যদি ব্যবসায়ীরা অতিমুনাফায় পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো না বাড়াতেন, তাহলে অনেক পণ্যের দাম নিশ্চয়ই এতটা বেশি হতো না। সে কারণে মাঝেমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যখন কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন ক্রেতাসাধারণ পরিমাণে কম কেনেন। কিন্তু একেবারে না কিনে চুলোয় আগুন জ্বালান না, এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটতে শুনিনি।
এই কথাগুলো লিখতে হলো এ কারণেই যে, ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হেলিপ্যাড মাঠে বক্তৃতায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তার বিপক্ষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে চারদিকে শুধু হাহাকার, নাই আর নাই। সমগ্র দেশটাই যেন এক নাইয়ের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের জাঁতাকলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এককথায়, দেশের অর্থনীতি এক মহাসংকটে নিমজ্জিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত আগস্টে সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি দেখানো হয় ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কমছে দেখানো হলেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখনো প্রায় দুই অঙ্কের কাছাকাছি রয়েছে। জানুয়ারি মাসে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।’ তিনি মন্তব্য করেন, ‘বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বারবার বৃদ্ধি, রিজার্ভ তলানিতে নেমে আসা, ডলারের নজিরবিহীন সংকট, ডলারের বিনিময়ে টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে অব্যবস্থাপনা, অপরিণামদর্শী ভ্রান্তনীতি, লাগামহীন দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি বৃদ্ধি পাওয়া, ঋণপ্রাপ্তির অপর্যাপ্ততা, অর্থনৈতিক আয়বৈষম্য, সুশাসনের অভাব এবং গণতন্ত্র না থাকার কারণে দেশে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।’
মির্জা ফখরুল সাহেব যে হাহাকারের বর্ণনা সংবাদ সম্মেলনে দিয়েছেন, সেটি তিনি কোথায় শুনেছেন? তিনি খুব আবেগ দিয়ে যখন এই হাহাকারের কথা বলেন, তখন মনে হতে পারে যে তাঁর মন মানুষের জন্য ছটফট করছে। দেশের নেতৃত্ব এই মুহূর্তে তার হাতে থাকলে বোধ হয় সবাই মহাসুখে থাকতেন। দেশে কোনো অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, সুশাসনের অভাব, গণতন্ত্রের অভাব, মুদ্রাস্ফীতি বৈশ্বিক এই মহামন্দায়ও আমাদের স্পর্শ করত না! আমাদের রিজার্ভ সম্ভবত পৃথিবীর শীর্ষে অবস্থান করত!
আসলে মির্জা ফখরুল কতগুলো মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষের আবেগকে উসকে দিতে চাইছেন। আমাদের রিজার্ভ তলানিতে ঠেকেছে বলে তিনি কী বোঝাতে চাইছেন? পাকিস্তানের চেয়েও আমাদের রিজার্ভ কি আরও খারাপে চলে গেছে? ৩২ বিলিয়ন রিজার্ভের অর্থ যদি তলানিতে ঠেকার কথা বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে ২০০৬ সালে ক্ষমতায় থাকা বিএনপির বিদায়ের প্রাক্কালে জুন মাসে ৩.৪৮ বিলিয়ন, যা এখন পাকিস্তানের কাছাকাছি, সেটাকে তিনি কী বলবেন? তিনি নিজে একজন অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। অর্থনীতি তাঁর পঠিত বিষয়। কিন্তু দেশের অর্থনীতির যে চালচিত্রের ধারণা তিনি দিচ্ছেন, সেটি বাস্তবের সঙ্গে যখন মেলে না তখন অভিযোগটা কার বিরুদ্ধে বলব—রাজনীতি, নাকি অর্থনীতির শিক্ষার বিরুদ্ধে?
মুখে বলে দেশে হাহাকার সৃষ্টি করা যাবে না। সত্যিকার হাহাকার সৃষ্টি হয় অর্থনীতির ভয়াবহ সংকট থেকে। সেটি যখন যে দেশে ঘটে বা ঘটছে, সেখানে কাউকে বলে শোনাতে হবে না দেশে হাহাকার চলছে। সরকার সেটি ধামাচাপা দিতে চাইলেও থামানো যাবে না, ঢাকাও যাবে না। হাহাকার নিবারণের একমাত্র উপায় হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিরাজমান সংকট, খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্য নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। বাংলাদেশে খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্য, মানুষের উপার্জন এবং অর্থনীতির সংকট নাগালের বাইরে চলে যায়নি। শহরাঞ্চলে কিংবা গ্রামাঞ্চলেও মানুষের আচার-অনুষ্ঠান, পর্যটন, উৎসব ইত্যাদিতে তেমন কোনো ভাটা চোখে পড়েনি। বাংলাদেশের এক কোটির বেশি মানুষ বিদেশ থেকে নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, রপ্তানি আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি অর্থনীতিও যথেষ্ট চাঙা রয়েছে। অর্থনীতির অন্যান্য খাতও স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে করপোরেট, মধ্যস্বত্বভোগী এবং ছোট ব্যবসায়ীদের মধ্যে আয়ের বৈষম্য থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য করে কয়েক কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। সুতরাং হাহাকারের কাল্পনিক আহাজারি মানুষের খুব বেশি কানে স্পর্শ করলেও অন্তরকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার কথা বাদ দিলাম, খোদ ইংল্যান্ডে এই মুহূর্তে রেশনিং প্রথার বাইরে কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারে না। আরও অনেক দেশেই অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন।
২০১৯ সাল পর্যন্ত আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে গতিতে ছিল, তা দুই বছরের করোনায় কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তেই ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞার কবলে আমরাও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সেই অবস্থায়ও এখনো বড় ধরনের সংকটে বাংলাদেশ পড়েনি। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা যদি বাস্তবতাবিবর্জিতভাবে হাহাকারের আহাজারিতে ভোগেন, তাহলে লাভ কার হবে?
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিশোরগঞ্জে নবপ্রতিষ্ঠিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাস উদ্বোধন করেন। এরপর তিনি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হেলিপ্যাড মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় ভাষণ দেন। এই হাওর অঞ্চল একসময় জনবিচ্ছিন্ন ছিল; ছিল না রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং উন্নত জীবনযাত্রার ব্যবস্থাও। কিন্তু গত ১৩-১৪ বছরে গোটা কিশোরগঞ্জই বদলে গেছে। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ফলে ওই দিনের জনসভায় গোটা অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন। বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মানুষ খেয়েপরে ভালো থাকে। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। অন্তত ১৪ বছরে আজকের বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছে, বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’
মিঠামইনের জনসভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন প্রাণবন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত। আগের মতো দারিদ্র্যের ছাপ তাঁদের মধ্যে দেখা যায়নি। বদলে যাওয়া কিশোরগঞ্জের মানুষ ১০-১২ বছর আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত যোগাযোগ, যাতায়াত, কৃষি, নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদিতে জীবন অনেকটাই পাল্টে দিতে পেরেছেন। এই অঞ্চলের কোথাও তেমন হাহাকার, অভাব-অনটন কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষের প্রকাশ ঘটানোর মতো তেমন কিছু এ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু এক যুগ আগেই এই এলাকার মানুষের বেশির ভাগই হাওর-বিলের কারণে অতি সাধারণ দারিদ্র্য জীবনের মধ্যে আটকে ছিল।
তাই বলে আমরা এ কথা বলব না যে, করোনা অতিমারির দুই বছর এবং ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের অভিঘাতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সবাই খুব ভালো আছেন, কারও কোনো অভাব নেই, সমস্যা নেই। সারা বিশ্বের মতোই আমাদের দেশেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ব্যয় যতটা বেড়েছে, আয় হয়তো ততটা বাড়েনি। তবে সবার অবস্থা এক রকম নয়। হাহাকার করার মতো পরিস্থিতি গ্রামগঞ্জে সৃষ্টি হয়েছে—এমন খবর আমাদের কানে এ পর্যন্ত আসেনি। কিছুটা টানাটানি কোনো কোনো পরিবারে নতুন করে দেখা দিচ্ছে। কিন্তু সেগুলোতেও সরকার নানা ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে, কেউ ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্যসামগ্রী কেনার সুযোগ পাচ্ছে, অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ভাতা, শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলো উপবৃত্তি পাচ্ছে, ওএমএস এবং কম ও বিনা মূল্যে চালসহ কিছু কিছু পণ্য তারা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে পাচ্ছে। এর বাইরে বেশির ভাগ মানুষই এখন কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নানা ধরনের পরিবহন, মৎস্য চাষ, পশুপালন এবং প্রবাসে কর্মরত আছেন। প্রবাসীরা নিয়মিত বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাচ্ছেন। গ্রামগঞ্জে অন্যরা যা উপার্জন করছেন, তাতে অনেকে বেশ ভালো আছেন, কেউ কেউ হয়তো ততটা ভালো করতে পারছেন না। কিন্তু খেয়েপরে সবাই কমবেশি স্বাচ্ছন্দ্যেই আছেন।
গ্রামে এখন কাঁচা বাড়ির সংখ্যা কমে যাচ্ছে, পাকা বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। যাঁদের ঘর নেই, তারা শেখ হাসিনার ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের’ মাধ্যমে আধা পাকা বাড়ি পাচ্ছেন। আয়-উপার্জন করে মোটামুটি সুন্দর জীবনযাপন করছেন। যাঁরা শারীরিক পরিশ্রম করতে পারেন, তাঁরা প্রতিদিনই খেতখামারে কাজ করে ৫০০-৬০০ টাকা আয় করছেন। বদলে যাওয়া এই পরিস্থিতি এখন সাধারণ দৃশ্য। এই দৃশ্য আগে কেউ কল্পনা করতে পারেনি। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রভাব মানুষের আর্থসামাজিক জীবনব্যবস্থায় যে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, তার ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায়ও আমাদের বেশির ভাগ মানুষই নিজস্ব আয়-উপার্জনে যাঁর যাঁর মতো করে চলতে পারছেন। বাকিদের পাশে সরকারি নানা ধরনের প্রণোদনা ও সহযোগিতা থাকায় তাঁদের ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হচ্ছে না।
গ্রামে কোথাও তেমন ভিক্ষুকের আনাগোনা চোখে পড়ছে না।
গ্রামের সঙ্গে আমাদের কমবেশি যোগাযোগ মোবাইল ফোনেই রয়েছে। খোঁজখবর প্রায় প্রতিদিনই পাচ্ছি। আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করে এলাকায় বেশ ভালো আছেন। বেচাকেনার কথা জানতে চাইলে কেউ বলেন না যে সাধারণ ক্রেতারা তেল, আটা, মুদি কেনাকাটায় অক্ষম হয়ে পড়েছেন কিংবা না কিনে বাড়ি ফিরে চলে যাচ্ছেন। এই যখন গ্রামের অবস্থা, তখন বুঝতে কষ্ট হয় না যে মানুষ বর্তমান বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক সংকটের কালে খুব খারাপ আছে, না খেয়ে দিনাতিপাত করছে কিংবা হাহাকার করে বেড়াচ্ছে। হ্যাঁ, কিছু কিছু আমদানি করা পণ্যের দাম আগের চেয়েও বেশ বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীদেরও একটি বড় অংশ দাম বাড়ানোর নানা অজুহাত, ফন্দিফিকির করে বেড়াচ্ছে। ফলে দামের ওঠানামাটা অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিম, স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়তি। যদি ব্যবসায়ীরা অতিমুনাফায় পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো না বাড়াতেন, তাহলে অনেক পণ্যের দাম নিশ্চয়ই এতটা বেশি হতো না। সে কারণে মাঝেমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যখন কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন ক্রেতাসাধারণ পরিমাণে কম কেনেন। কিন্তু একেবারে না কিনে চুলোয় আগুন জ্বালান না, এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটতে শুনিনি।
এই কথাগুলো লিখতে হলো এ কারণেই যে, ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হেলিপ্যাড মাঠে বক্তৃতায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তার বিপক্ষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে চারদিকে শুধু হাহাকার, নাই আর নাই। সমগ্র দেশটাই যেন এক নাইয়ের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের জাঁতাকলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এককথায়, দেশের অর্থনীতি এক মহাসংকটে নিমজ্জিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত আগস্টে সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি দেখানো হয় ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কমছে দেখানো হলেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখনো প্রায় দুই অঙ্কের কাছাকাছি রয়েছে। জানুয়ারি মাসে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।’ তিনি মন্তব্য করেন, ‘বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বারবার বৃদ্ধি, রিজার্ভ তলানিতে নেমে আসা, ডলারের নজিরবিহীন সংকট, ডলারের বিনিময়ে টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে অব্যবস্থাপনা, অপরিণামদর্শী ভ্রান্তনীতি, লাগামহীন দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি বৃদ্ধি পাওয়া, ঋণপ্রাপ্তির অপর্যাপ্ততা, অর্থনৈতিক আয়বৈষম্য, সুশাসনের অভাব এবং গণতন্ত্র না থাকার কারণে দেশে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।’
মির্জা ফখরুল সাহেব যে হাহাকারের বর্ণনা সংবাদ সম্মেলনে দিয়েছেন, সেটি তিনি কোথায় শুনেছেন? তিনি খুব আবেগ দিয়ে যখন এই হাহাকারের কথা বলেন, তখন মনে হতে পারে যে তাঁর মন মানুষের জন্য ছটফট করছে। দেশের নেতৃত্ব এই মুহূর্তে তার হাতে থাকলে বোধ হয় সবাই মহাসুখে থাকতেন। দেশে কোনো অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, সুশাসনের অভাব, গণতন্ত্রের অভাব, মুদ্রাস্ফীতি বৈশ্বিক এই মহামন্দায়ও আমাদের স্পর্শ করত না! আমাদের রিজার্ভ সম্ভবত পৃথিবীর শীর্ষে অবস্থান করত!
আসলে মির্জা ফখরুল কতগুলো মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষের আবেগকে উসকে দিতে চাইছেন। আমাদের রিজার্ভ তলানিতে ঠেকেছে বলে তিনি কী বোঝাতে চাইছেন? পাকিস্তানের চেয়েও আমাদের রিজার্ভ কি আরও খারাপে চলে গেছে? ৩২ বিলিয়ন রিজার্ভের অর্থ যদি তলানিতে ঠেকার কথা বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে ২০০৬ সালে ক্ষমতায় থাকা বিএনপির বিদায়ের প্রাক্কালে জুন মাসে ৩.৪৮ বিলিয়ন, যা এখন পাকিস্তানের কাছাকাছি, সেটাকে তিনি কী বলবেন? তিনি নিজে একজন অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। অর্থনীতি তাঁর পঠিত বিষয়। কিন্তু দেশের অর্থনীতির যে চালচিত্রের ধারণা তিনি দিচ্ছেন, সেটি বাস্তবের সঙ্গে যখন মেলে না তখন অভিযোগটা কার বিরুদ্ধে বলব—রাজনীতি, নাকি অর্থনীতির শিক্ষার বিরুদ্ধে?
মুখে বলে দেশে হাহাকার সৃষ্টি করা যাবে না। সত্যিকার হাহাকার সৃষ্টি হয় অর্থনীতির ভয়াবহ সংকট থেকে। সেটি যখন যে দেশে ঘটে বা ঘটছে, সেখানে কাউকে বলে শোনাতে হবে না দেশে হাহাকার চলছে। সরকার সেটি ধামাচাপা দিতে চাইলেও থামানো যাবে না, ঢাকাও যাবে না। হাহাকার নিবারণের একমাত্র উপায় হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিরাজমান সংকট, খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্য নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। বাংলাদেশে খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্য, মানুষের উপার্জন এবং অর্থনীতির সংকট নাগালের বাইরে চলে যায়নি। শহরাঞ্চলে কিংবা গ্রামাঞ্চলেও মানুষের আচার-অনুষ্ঠান, পর্যটন, উৎসব ইত্যাদিতে তেমন কোনো ভাটা চোখে পড়েনি। বাংলাদেশের এক কোটির বেশি মানুষ বিদেশ থেকে নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, রপ্তানি আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি অর্থনীতিও যথেষ্ট চাঙা রয়েছে। অর্থনীতির অন্যান্য খাতও স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে করপোরেট, মধ্যস্বত্বভোগী এবং ছোট ব্যবসায়ীদের মধ্যে আয়ের বৈষম্য থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য করে কয়েক কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। সুতরাং হাহাকারের কাল্পনিক আহাজারি মানুষের খুব বেশি কানে স্পর্শ করলেও অন্তরকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার কথা বাদ দিলাম, খোদ ইংল্যান্ডে এই মুহূর্তে রেশনিং প্রথার বাইরে কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারে না। আরও অনেক দেশেই অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন।
২০১৯ সাল পর্যন্ত আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে গতিতে ছিল, তা দুই বছরের করোনায় কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তেই ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞার কবলে আমরাও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সেই অবস্থায়ও এখনো বড় ধরনের সংকটে বাংলাদেশ পড়েনি। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা যদি বাস্তবতাবিবর্জিতভাবে হাহাকারের আহাজারিতে ভোগেন, তাহলে লাভ কার হবে?
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
১১ দিন আগেবিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪