চাই বুঝেশুনে মোকাবিলার প্রস্তুতি

হাসান মামুন
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ১৬

কিছু বিষয় নিয়ে আমরা অনেকে অতিরিক্ত হইচই করে থাকি, নাকি? ভারতে ইলিশ রপ্তানি নিয়ে হালে এমনটাই বোধ হয় হয়ে গেল। হইচই দেখে মনে হচ্ছিল, না জানি কত ইলিশ চলে যাবে দেশ থেকে! খুব বেশি পরিমাণ রপ্তানির অনুমতিও কিন্তু দেওয়া হয়নি।

এটাও বলা হচ্ছিল, প্রতিবারই বাস্তবে রপ্তানি হয় অনুমোদিত পরিমাণের অনেক কম। এবারও একই ঘটনা ঘটল। অনুমোদিত পরিমাণের এক-চতুর্থাংশ ইলিশও যায়নি। ভারতের আমদানিকারকেরা অত নেননি; আমাদের ব্যবসায়ীরাও বেশি ইলিশ জোগাতে পারেননি।

অনুমতিপ্রাপ্ত অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কোনো রপ্তানিই করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ দাম। দামের বিষয়ে ঐকমত্য না হলে রপ্তানি হবে কীভাবে!

এটা সম্ভবত জানাই ছিল বাণিজ্য উপদেষ্টার। ঘরে-বাইরে তীব্র আপত্তির মুখে ওই সময় তাঁকে এটাও ভেঙে বলতে হয়, সামগ্রিক আহরণের তুলনায় রপ্তানিটা অতি সামান্য। বাস্তবে দেখা গেল, সেটুকু রপ্তানিও হয়নি। এটা আসলে ছিল প্রতিবেশী দেশে সৌজন্যমূলক রপ্তানি। আর রপ্তানি তো হয়েছে মূলত পশ্চিমবঙ্গে। ওখানেও এ পণ্য কেনার সামর্থ্য আছে কম লোকেরই। তাদের আহরিত ইলিশের দামও কম নয়।

সে জন্য তারা মিয়ানমার থেকে কিছুটা সস্তায় ইলিশ এনে থাকে। এর একাংশ হয়তো যায় ঘুরপথে বাংলাদেশ থেকেই! ইলিশ চোরাচালান হলে সরকার আবার রাজস্ব হারায়। ভারত বা মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে এখানে কিছু এলে সে ক্ষেত্রে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত থেকে অনেক দিন ধরে চিনি চোরাচালান হয়ে আসছে বলে খবর রয়েছে। সে জন্য আবার এর আমদানি হচ্ছে কম।

হালে কর-শুল্ক কমিয়ে চিনি আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিগত সরকারের আমল থেকেই চিনি নিয়ে এ কাণ্ড হচ্ছে।এরও কারণ রয়েছে। ভারতে চিনির দাম অনেক কম। চোরাইপথে আনলে এটা কম দামে বেচা যায়। এতে আবার আমদানি করা চিনি বিক্রি হয়ে পড়ে কঠিন। দুর্গাপূজায় ইলিশ রপ্তানি না হলে এরও কিছুটা কি চোরাচালান হয়ে ওখানে যেত না? যাচ্ছিলও। তবে খুব বেশি চোরাচালান বোধ হয় হতো না। এখানেও দামের প্রশ্ন। ব্যবসায়ীরা কি খাতির করে কম দামে ইলিশ দিতে সম্মত হতেন?

বাণিজ্যে খাতিরের ব্যাপার নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু বিবেচনার বিষয় অবশ্য আছে। যেমন, অন্তর্বর্তী সরকার ইলিশ রপ্তানিতে সম্মত হয়েছিল বিশেষ বিবেচনা থেকে। নিজেদের মধ্যকার বিরোধিতা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয় নীতিনির্ধারকদের।

‘টেবিলের ওপাশ থেকে এপাশে’ আসার কারণেও একই ব্যক্তিকে ভিন্ন অবস্থান নিতে দেখা যায়। এ কারণে একজন উপদেষ্টা ওই সময় বেশ সমালোচিত হন, যদিও ইলিশ রপ্তানির সঙ্গে তার মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত নয়। সমালোচনা হতেই পারে; তবে সেটা তথ্য দ্বারা সমর্থিত হওয়া প্রয়োজন। ভিত্তিহীন সমালোচনার চাপেও বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে থাকে। ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওই সময়টায় এর বিরুদ্ধে হইচইয়ের কারণে এর বাজার কি অস্থির হয়নি? এটা অবশ্য আগে থেকেই ছিল অস্থির। তখন আবার ছিল ইলিশ শিকারের শেষ সময়।

সাগর ও নদীতে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যে। এটা কার্যকরের চেষ্টায় আবার এ সময়ে বাজারে মাছের সরবরাহ গেছে কমে। ইলিশ রক্ষায় এমন ‘ত্যাগ স্বীকার’ করতে হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। এতে ইলিশের দাম যদি কমত, তাহলেও পুষিয়ে যেত ব্যাপারটা!

বিপুলসংখ্যক জেলেকে এ সময়ে কিছু খাদ্য সহায়তা জুগিয়ে মাছ শিকার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত নয় মোটেও। চালের সঙ্গে আরও কিছু লাগে দুবেলা পেট ভরে খেতে হলেও। সেসব সংগ্রহের জন্য তাদের বাজারেই যেতে হচ্ছে বৈকি। সেখানে আবার একগাদা নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। চিনির কথা বলা হচ্ছিল। ভোজ্যতেলের দামও কিছুটা বেড়েছে এর মধ্যে। আলু ‘উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল’।

তবে অন্যান্য সবজির দাম এত বেড়েছে যে আলুর দামটাও কম মনে হবে। কেজিপ্রতি ৮০ টাকার নিচে যেসব সবজি রয়েছে, তার মধ্যে বেশি খেতে হচ্ছে পেঁপে। মাছ শিকার করতে না পারা জেলেরা এ মুহূর্তে কেমন আছে, সেটা তাই বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন। বিশেষ বিশেষ ‘পকেটে’ আলাদা অনুসন্ধান করলে বিশেষভাবে কিছু ব্যবস্থা কিন্তু নেওয়া যায়। যেমন, এ সময়টায় ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় চাল, ডাল ও ভোজ্যতেল সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ খাতে সৃষ্ট অস্থিরতা হালে যে রূপ নিয়েছে, তা সুন্দরভাবে মোকাবিলার জন্যও এটা প্রয়োজন।

এ খাতে মালিকপক্ষেরও কিছু দাবি আছে। তাঁরা বলছেন, দেশ থেকে ক্রয়াদেশ চলে যাচ্ছে প্রতিযোগী দেশগুলোয়। প্রতিযোগী বলতে আবার অনেকে কেবল ভারতকে বোঝাতে চান! ক্রয়াদেশ তো পাকিস্তান, এমনকি মিয়ানমারে চলে যেতে পারে। আমরাও কি অন্যদের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হলে এ ধরনের সুবিধা পাই না? বাণিজ্যে এসব ঘটেই থাকে। অভিযোগ করে তাই লাভ নেই। এখানে সক্ষমতার পরিচয় দেওয়াটাই জরুরি। তারপরও দেখা যাচ্ছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় গার্মেন্টস খাতে রপ্তানি ভালো।

এ সময়ে প্রতিযোগী দেশগুলো কেমন করছে, সেটা দিয়েও নিজেদের পারফরম্যান্স বিচার করা যায়। সে চিত্রটি নাকি খারাপ। ইলিশ তো নয়; গার্মেন্টসের মতো পণ্য রপ্তানি বাড়িয়েই আমাদের চলতে হবে। এক গার্মেন্টসের ওপর নির্ভর করে থাকাও বিপজ্জনক। আমরা দশকের পর দশক নির্ভরশীলতার এ ধারা বদলাতে পারছি না। এ খাতে অস্থিরতাও তাই বাড়তে দেওয়া যাবে না। মূল্যস্ফীতি, বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকার সময়টায় শ্রমিকদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণের উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক। তাদের আরও কিছু দাবিও এর মধ্যে মেনে নেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞায় থাকা জেলেদের দিকেও সযত্ন নজর দিতে হবে।

নিষেধাজ্ঞা মানতে জেলেদের খুব একটা বাধ্য করা কিন্তু যাচ্ছে না। গতকালের আজকের পত্রিকায় এ বিষয়ক একাধিক খবর চোখে পড়ল। মাছ শিকারে নামা জেলের দল কোথাও কোথাও নজরদারিতে নিয়োজিত প্রশাসনের লোকজনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে শক্তিশালী হয়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয়ে এসব হচ্ছে বলেও খবরে প্রকাশ।

এখন নদী অঞ্চলেও কি সেনাবাহিনী নামাতে হবে? রাজধানীতে অনেক দিন ধরে যানজট পরিস্থিতি খারাপ। মনোবলহীন ট্রাফিক পুলিশ এখনো ঠিকমতো কাজ করছে না বলে অভিযোগও কমেনি। এ অবস্থায় যানজট সহনীয় করে আনতেও সেনাসদস্য নামানোর কথা বলছেন অনেকে। সেনাদের কাজ মূলত দেশরক্ষা। তবে দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে তাদের বিশেষ কিছু দায়িত্বও পালন করতে হয়।

সেটা সহজ করতে তাদের বিশেষ ক্ষমতাও দেওয়া হয়ে থাকে। এ মুহূর্তে যেমন তারা মাঠে রয়েছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে; যদিও সেটা বেশি প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে না। তবে কোথাও খোদ প্রশাসন আক্রান্ত হলে সেটা তাদের সহ্য করার কথা নয়। নির্দিষ্ট নদী অঞ্চলে শৃঙ্খলা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে তাদের ধরা তো কঠিন নয়। পাশাপাশি মাছের বাজার স্বাভাবিকভাবে চলছে কি না, সেদিকেও কড়া নজর রাখতে হবে। অবশ্য সরবরাহ কম থাকলে বাজার স্বাভাবিক রাখা কঠিন।

মাছ, সবজি ও ডিমের বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে সরবরাহ কমে যাওয়াটা তো অবশ্যই দায়ী। একের পর এক বন্যায় সব রকম কৃষিপণ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারটা ঘটেছে আমাদের চোখের সামনে। যেসব অঞ্চলে বন্যা হয়নি, সেখানে আবার হয়েছে অতিবৃষ্টি। তাতে বিশেষ করে সবজির বড় ক্ষতি হয়েছে। শীতকালীন আগাম সবজির ক্ষতিও কম হয়নি। এ বিষয়েও খবর আছে গতকালের আজকের পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায়।

এ অবস্থায় একটাই বড় খবর—ডিমের দাম কমে আসা। শুল্ক কমিয়ে ডিম আমদানির খবরে এর বাজারে একটা প্রভাব তো পড়েছে অবশ্যই। সরকার এ ক্ষেত্রে একটি ‘পাইলট প্রজেক্ট’ও নিয়েছে, যার আওতায় মধ্যস্বত্বভোগী এড়িয়ে সরাসরি ডিম আনার ব্যবস্থা হয়েছে রাজধানীর আড়তে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভালো; তবে ঘাটতির সময় ডিমের মতো পণ্যের সরবরাহ দ্রুত বাড়াতে হবে।

কম দামে আমদানির সুযোগ এ ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার। সেটা না থাকলে কী হতো? অন্যরা কমে দিতে পারলে আমরা পারছি না কেন, তারও সদুত্তর প্রয়োজন। আর কোন সময়ে কোন পণ্যের ঘাটতি হতে পারে এবং কী কারণে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। বর্ষায় প্রতিবছর কমবেশি একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে থাকলে সেটা মোকাবিলাও সরকারের নিয়মিত কাজের অংশ হতে হবে। এ জন্য জনসাধারণকেও রাখতে হবে সতর্কাবস্থায়।

লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত