তাসলিহা মওলা
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহ হবে—এটাই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ঘটনা। তাপপ্রবাহ এই অঞ্চলে নতুন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতীতে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রার পারদ ঊর্ধ্বমুখী হলেও এতটা বেশি ছিল না যে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর ১৯৭২ সালে। সে বছরের ১৮ মে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার স্বাধীনতার আগে ১৯৬০ সালে ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি।
অপরদিকে ২০১৪ সালে ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি। গত বছরের এপ্রিল মাসেও একই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। তবে দেখা যায়, ২০১৪ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে একই তাপমাত্রার সহনীয়তায় পার্থক্য আছে। গরম যেন ইদানীং বেশি অনুভূত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সেই সময়ে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ হলেও গরম নিয়ে এতটা অভিযোগ বা হা-হুতাশ শোনা যেত না।
এর অন্যতম কারণ হলো তাপসূচক বা ‘হিট ইনডেক্স’—বায়ুর তাপমাত্রা ও জলীয় বাষ্পের জন্য মানুষের দেহে কতটা গরম অনুভূত হবে।সাধারণত আবহাওয়ার তাপমাত্রা থেকে তাপ সূচক, ১ বা ২ ডিগ্রি, ঊর্ধ্বে ৩ ডিগ্রি বেশি থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই তারতম্য অনেক ক্ষেত্রে ৮ বা ৯ ডিগ্রি করে হচ্ছে; যা একেবারেই অস্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই তারতম্য? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে তাপমাত্রা অনেকটা বাড়বে তা আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থাগুলো জানিয়েছিল ২০২০ সালের দিকেই। এর অন্যতম কারণ হলো
‘এল নিনো’র সক্রিয়তা।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে প্রাকৃতিক কারণ থাকলেও মনুষ্য সৃষ্ট কারণগুলোই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়; বরং আমরা পুরোপুরি উল্টো পথে হাঁটছি। গত ১০ বছরে প্রকৃতি ধ্বংসের যে মহোৎসবে আমরা মেতেছি, এর ফলে যে আবহাওয়ার এই বিরূপ প্রভাব দেখা দেবে, তা বিশেষজ্ঞরা বহু আগেই সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু আমরা কি আদৌ তাঁদের সতর্কবার্তা অনুসরণ করেছি? আমরা কি আদতেই যথাযথ নিয়ম মেনে অগ্রসর হচ্ছি?
যেকোনো উন্নয়নের, স্থাপনার অন্যতম মূল শর্ত হলো সেই দেশের প্রকৃতি, জলবায়ু, আবহাওয়া, বাস্তুসংস্থান—এসবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা। সেটা কোনো ভবন হোক, অবকাঠামো বা নগর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের নগরগুলো গড়ে উঠেছে ইচ্ছেমতো, যেখানে যা খুশি তা-ই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃতি, জলবায়ু, আবহাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় আনা হয়নি বললেই চলে। আর অপরিকল্পিত এলাকাগুলোর অবস্থা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া বাংলাদেশে এখন ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে।
ফলে বেশ কিছু মেগা প্রজেক্ট, অর্থনৈতিক অঞ্চল ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এগুলো তৈরি করতে গিয়ে ব্যাপক বৃক্ষনিধন হচ্ছে। উপরন্তু এসব প্রকল্পকে কেন্দ্র করে আশপাশে লোকালয় গড়ে উঠতে শুরু করেছে। ভূমি ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগে আবাসন প্রকল্পের ব্যবসা শুরু করেছেন। ফলে নদী, খাল-বিল যেমন ভরাট হচ্ছে, তেমনি ভরাট হচ্ছে কৃষিজমিও। বিশ্বের অন্যান্য দেশে সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা থাকলেও আমাদের দেশে নেই। ফলে বনভূমি, জলাভূমি, খাল-বিল, কৃষিজমি ইত্যাদি রক্ষা পায় এবং প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকে।
এবারের তাপপ্রবাহের কারণ হিসেবে অনেকে সবুজ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন। কিন্তু আসলেই কি শুধু সবুজ কমে যাওয়াতেই এতটা তাপ অনুভূত হচ্ছে? পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য গাছের পাশাপাশি নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদির সমানুপাতিক অবস্থান প্রয়োজন, যার প্রকট অভাব আমরা এখন উপলব্ধি করছি।
বাংলাদেশের গত ৩০ বছরের স্যাটেলাইট ইমেজ যদি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে, আমরা কত দ্রুত আমাদের সবুজের পরিমাণ হারিয়েছি, নদীগুলো কীভাবে শুকিয়ে গেছে। একে তো বাঁধ দেওয়ার কারণে আমাদের ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার জলপ্রবাহ নিতান্তই কমে গেছে, এরপর নদীগুলোও নির্বিচারে ভরাট করা হয়েছে। ঢাকা শহরে বর্তমানে জলাভূমির পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ, যেখানে একটি শহরের মোট আয়তনের ১২-১৫ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়। গত ১০ বছরে শুধু ঢাকা শহরের সবুজ আচ্ছাদন ২১ থেকে ৯ শতাংশে নেমেছে। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স)। সুতরাং এ কথা সহজেই অনুমেয়, পুরো দেশে কী পরিমাণ বনভূমি নিধন এবং জলাভূমি ভরাট হয়েছে।
একটি দেশের জন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিকল্পনা ও পরিচালনা করা একটি অনিবার্য বিষয়। আপনার দেশে যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান, তখন উন্নয়নবিমুখতাও আত্মঘাতী। আমাদের পাওয়ার প্ল্যান্ট লাগবে, পরিবহন অবকাঠামোর প্রয়োজন হবে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, অর্থনৈতিক অঞ্চল, এমনকি নতুন নতুন নগর, বাজার, হাট সবকিছুরই প্রয়োজন আছে প্রবৃদ্ধির জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই প্রকৃতিকে পাশ কাটিয়ে নয়। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতিই আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলেই উল্টো হিতে বিপরীত হয়, যেমনটা আমাদের ক্ষেত্রে হচ্ছে।
আমরা উন্নয়নের নামে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন করেছি। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে নগর গড়েছি। সামাজিক বনায়নের নামে বিজাতীয় গাছ রোপণ করেছি। নদীগুলোও দূষিত হয়েছে একের পর এক। ফলে ৩০ বছর আগে যে তাপমাত্রায় আমরা হাঁসফাঁস করতাম না, ৩০ বছর পরে তার চেয়ে ২-৩ ডিগ্রি কম তাপমাত্রাও অসহনীয় হয়ে উঠছে। কারণ ছায়া দেওয়ার মতো গাছ নেই, নদীতে যেমন পানি নেই, মাটির নিচেও পানির স্তর গেছে নেমে। প্রকৃতিতে তো সব জিনিসের সমান ও পরিমিত সহাবস্থান প্রয়োজন হয়। প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্র অত্যন্ত জটিল বিষয়, যার সম্পূর্ণ উল্টোপথে আমরা গিয়েছি।
আমরা নগর গড়েছি, ভাবিনি সেখানে কতটুকু সবুজ, কতখানি জলাশয়, কতগুলো খোলা মাঠের প্রয়োজন। নগরে প্লটগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যাতে করে একটি বাড়ির সঙ্গে আরেকটি বাড়ির দূরত্ব একেবারে ন্যূনতম থাকছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই যাঁরা অবস্থাপন্ন, তাঁরা যান্ত্রিক সমাধান, অর্থাৎ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের দিকে ঝুঁকছেন। পাশের বাড়িটিতে এর কী প্রভাব পড়ছে, বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কি না, সুউচ্চ ভবনকে কাচ দিয়ে ঘিরে, সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসিয়ে ভেতরের পরিবেশকে আরামদায়ক ও শীতল করছি বটে, তবে বায়ুমণ্ডলকে করে তুলেছি উষ্ণতর।
বলা হচ্ছে ঢাকার অনুভূত তাপমাত্রার বেশির ভাগটাই হলো আটকে পড়া তাপের কারণে, যার জন্য ভবন ও যানবাহনের এসির তপ্ত হাওয়া দায়ী। অথচ, আশি বা নব্বইয়ের দশকেও ভবন তৈরির সময় আমরা প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতাম। সে সময়কার ভবনগুলোতে এই তাপপ্রবাহের সময়েও বেশ বাতাস চলাচল করে।
তাপমাত্রা এবং তাপসূচক বৃদ্ধির মূল কারণ, আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। আমাদের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা প্রকৃতিকে নিয়ে নয়; বরং পাশ কাটিয়ে করা হয়। এই যে গাছ লাগানোর কথা বলা হচ্ছে, শুধু গাছ লাগালেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
নদী, খাল-বিল ও জলাভূমি এবং খোলা মাঠগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। শহরাঞ্চলে কংক্রিট আচ্ছাদন অত্যন্ত বেড়ে গেছে, যা ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্মজুদ হতে দিচ্ছে না। উপরন্তু আমরা ভূ-পৃষ্ঠের পানি, অর্থাৎ নদী, খাল-বিল ইত্যাদি দূষিত করে মাটির নিচের পানির মজুত ধ্বংস করে চলেছি সুপেয় পানি ও সেচের প্রয়োজনে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনের কারণগুলো যেমন সমন্বিত, তেমনি এর প্রতিকারও হতে হবে সমন্বিত। বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রে বিজাতীয় মূল্যবান গাছ নয়, দেশীয় গাছ রোপণ করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সমাধান প্রকৃতিকে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমেই করতে হবে, এর কোনো ব্যত্যয় নেই। সামনের দিনগুলোতে পুরো পৃথিবীতেই প্রকৃতি আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে। আমাদের প্রকৃতিবিমুখ এই উন্নয়ন তখন হয়ে উঠবে আত্মঘাতী। সময় অনেকটা চলে গেছে, সর্বনাশও কিছু কম হয়নি। কিন্তু এখনো যতটুকু আছে, তাকে বাঁচিয়ে রেখে প্রকৃতি পুনরুদ্ধারে সমন্বিত উদ্যোগই পারবে আমাদের রক্ষা করতে।
লেখক: স্থপতি ও নগর-পরিকল্পনাবিদ
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহ হবে—এটাই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ঘটনা। তাপপ্রবাহ এই অঞ্চলে নতুন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতীতে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রার পারদ ঊর্ধ্বমুখী হলেও এতটা বেশি ছিল না যে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর ১৯৭২ সালে। সে বছরের ১৮ মে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার স্বাধীনতার আগে ১৯৬০ সালে ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি।
অপরদিকে ২০১৪ সালে ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি। গত বছরের এপ্রিল মাসেও একই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। তবে দেখা যায়, ২০১৪ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে একই তাপমাত্রার সহনীয়তায় পার্থক্য আছে। গরম যেন ইদানীং বেশি অনুভূত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সেই সময়ে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ হলেও গরম নিয়ে এতটা অভিযোগ বা হা-হুতাশ শোনা যেত না।
এর অন্যতম কারণ হলো তাপসূচক বা ‘হিট ইনডেক্স’—বায়ুর তাপমাত্রা ও জলীয় বাষ্পের জন্য মানুষের দেহে কতটা গরম অনুভূত হবে।সাধারণত আবহাওয়ার তাপমাত্রা থেকে তাপ সূচক, ১ বা ২ ডিগ্রি, ঊর্ধ্বে ৩ ডিগ্রি বেশি থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই তারতম্য অনেক ক্ষেত্রে ৮ বা ৯ ডিগ্রি করে হচ্ছে; যা একেবারেই অস্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই তারতম্য? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে তাপমাত্রা অনেকটা বাড়বে তা আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থাগুলো জানিয়েছিল ২০২০ সালের দিকেই। এর অন্যতম কারণ হলো
‘এল নিনো’র সক্রিয়তা।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে প্রাকৃতিক কারণ থাকলেও মনুষ্য সৃষ্ট কারণগুলোই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়; বরং আমরা পুরোপুরি উল্টো পথে হাঁটছি। গত ১০ বছরে প্রকৃতি ধ্বংসের যে মহোৎসবে আমরা মেতেছি, এর ফলে যে আবহাওয়ার এই বিরূপ প্রভাব দেখা দেবে, তা বিশেষজ্ঞরা বহু আগেই সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু আমরা কি আদৌ তাঁদের সতর্কবার্তা অনুসরণ করেছি? আমরা কি আদতেই যথাযথ নিয়ম মেনে অগ্রসর হচ্ছি?
যেকোনো উন্নয়নের, স্থাপনার অন্যতম মূল শর্ত হলো সেই দেশের প্রকৃতি, জলবায়ু, আবহাওয়া, বাস্তুসংস্থান—এসবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা। সেটা কোনো ভবন হোক, অবকাঠামো বা নগর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের নগরগুলো গড়ে উঠেছে ইচ্ছেমতো, যেখানে যা খুশি তা-ই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃতি, জলবায়ু, আবহাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় আনা হয়নি বললেই চলে। আর অপরিকল্পিত এলাকাগুলোর অবস্থা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া বাংলাদেশে এখন ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে।
ফলে বেশ কিছু মেগা প্রজেক্ট, অর্থনৈতিক অঞ্চল ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এগুলো তৈরি করতে গিয়ে ব্যাপক বৃক্ষনিধন হচ্ছে। উপরন্তু এসব প্রকল্পকে কেন্দ্র করে আশপাশে লোকালয় গড়ে উঠতে শুরু করেছে। ভূমি ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগে আবাসন প্রকল্পের ব্যবসা শুরু করেছেন। ফলে নদী, খাল-বিল যেমন ভরাট হচ্ছে, তেমনি ভরাট হচ্ছে কৃষিজমিও। বিশ্বের অন্যান্য দেশে সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা থাকলেও আমাদের দেশে নেই। ফলে বনভূমি, জলাভূমি, খাল-বিল, কৃষিজমি ইত্যাদি রক্ষা পায় এবং প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকে।
এবারের তাপপ্রবাহের কারণ হিসেবে অনেকে সবুজ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন। কিন্তু আসলেই কি শুধু সবুজ কমে যাওয়াতেই এতটা তাপ অনুভূত হচ্ছে? পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য গাছের পাশাপাশি নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদির সমানুপাতিক অবস্থান প্রয়োজন, যার প্রকট অভাব আমরা এখন উপলব্ধি করছি।
বাংলাদেশের গত ৩০ বছরের স্যাটেলাইট ইমেজ যদি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে, আমরা কত দ্রুত আমাদের সবুজের পরিমাণ হারিয়েছি, নদীগুলো কীভাবে শুকিয়ে গেছে। একে তো বাঁধ দেওয়ার কারণে আমাদের ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার জলপ্রবাহ নিতান্তই কমে গেছে, এরপর নদীগুলোও নির্বিচারে ভরাট করা হয়েছে। ঢাকা শহরে বর্তমানে জলাভূমির পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ, যেখানে একটি শহরের মোট আয়তনের ১২-১৫ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়। গত ১০ বছরে শুধু ঢাকা শহরের সবুজ আচ্ছাদন ২১ থেকে ৯ শতাংশে নেমেছে। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স)। সুতরাং এ কথা সহজেই অনুমেয়, পুরো দেশে কী পরিমাণ বনভূমি নিধন এবং জলাভূমি ভরাট হয়েছে।
একটি দেশের জন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিকল্পনা ও পরিচালনা করা একটি অনিবার্য বিষয়। আপনার দেশে যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান, তখন উন্নয়নবিমুখতাও আত্মঘাতী। আমাদের পাওয়ার প্ল্যান্ট লাগবে, পরিবহন অবকাঠামোর প্রয়োজন হবে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, অর্থনৈতিক অঞ্চল, এমনকি নতুন নতুন নগর, বাজার, হাট সবকিছুরই প্রয়োজন আছে প্রবৃদ্ধির জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই প্রকৃতিকে পাশ কাটিয়ে নয়। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতিই আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলেই উল্টো হিতে বিপরীত হয়, যেমনটা আমাদের ক্ষেত্রে হচ্ছে।
আমরা উন্নয়নের নামে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন করেছি। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে নগর গড়েছি। সামাজিক বনায়নের নামে বিজাতীয় গাছ রোপণ করেছি। নদীগুলোও দূষিত হয়েছে একের পর এক। ফলে ৩০ বছর আগে যে তাপমাত্রায় আমরা হাঁসফাঁস করতাম না, ৩০ বছর পরে তার চেয়ে ২-৩ ডিগ্রি কম তাপমাত্রাও অসহনীয় হয়ে উঠছে। কারণ ছায়া দেওয়ার মতো গাছ নেই, নদীতে যেমন পানি নেই, মাটির নিচেও পানির স্তর গেছে নেমে। প্রকৃতিতে তো সব জিনিসের সমান ও পরিমিত সহাবস্থান প্রয়োজন হয়। প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্র অত্যন্ত জটিল বিষয়, যার সম্পূর্ণ উল্টোপথে আমরা গিয়েছি।
আমরা নগর গড়েছি, ভাবিনি সেখানে কতটুকু সবুজ, কতখানি জলাশয়, কতগুলো খোলা মাঠের প্রয়োজন। নগরে প্লটগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যাতে করে একটি বাড়ির সঙ্গে আরেকটি বাড়ির দূরত্ব একেবারে ন্যূনতম থাকছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই যাঁরা অবস্থাপন্ন, তাঁরা যান্ত্রিক সমাধান, অর্থাৎ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের দিকে ঝুঁকছেন। পাশের বাড়িটিতে এর কী প্রভাব পড়ছে, বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কি না, সুউচ্চ ভবনকে কাচ দিয়ে ঘিরে, সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসিয়ে ভেতরের পরিবেশকে আরামদায়ক ও শীতল করছি বটে, তবে বায়ুমণ্ডলকে করে তুলেছি উষ্ণতর।
বলা হচ্ছে ঢাকার অনুভূত তাপমাত্রার বেশির ভাগটাই হলো আটকে পড়া তাপের কারণে, যার জন্য ভবন ও যানবাহনের এসির তপ্ত হাওয়া দায়ী। অথচ, আশি বা নব্বইয়ের দশকেও ভবন তৈরির সময় আমরা প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতাম। সে সময়কার ভবনগুলোতে এই তাপপ্রবাহের সময়েও বেশ বাতাস চলাচল করে।
তাপমাত্রা এবং তাপসূচক বৃদ্ধির মূল কারণ, আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। আমাদের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা প্রকৃতিকে নিয়ে নয়; বরং পাশ কাটিয়ে করা হয়। এই যে গাছ লাগানোর কথা বলা হচ্ছে, শুধু গাছ লাগালেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
নদী, খাল-বিল ও জলাভূমি এবং খোলা মাঠগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। শহরাঞ্চলে কংক্রিট আচ্ছাদন অত্যন্ত বেড়ে গেছে, যা ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্মজুদ হতে দিচ্ছে না। উপরন্তু আমরা ভূ-পৃষ্ঠের পানি, অর্থাৎ নদী, খাল-বিল ইত্যাদি দূষিত করে মাটির নিচের পানির মজুত ধ্বংস করে চলেছি সুপেয় পানি ও সেচের প্রয়োজনে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনের কারণগুলো যেমন সমন্বিত, তেমনি এর প্রতিকারও হতে হবে সমন্বিত। বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রে বিজাতীয় মূল্যবান গাছ নয়, দেশীয় গাছ রোপণ করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সমাধান প্রকৃতিকে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমেই করতে হবে, এর কোনো ব্যত্যয় নেই। সামনের দিনগুলোতে পুরো পৃথিবীতেই প্রকৃতি আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে। আমাদের প্রকৃতিবিমুখ এই উন্নয়ন তখন হয়ে উঠবে আত্মঘাতী। সময় অনেকটা চলে গেছে, সর্বনাশও কিছু কম হয়নি। কিন্তু এখনো যতটুকু আছে, তাকে বাঁচিয়ে রেখে প্রকৃতি পুনরুদ্ধারে সমন্বিত উদ্যোগই পারবে আমাদের রক্ষা করতে।
লেখক: স্থপতি ও নগর-পরিকল্পনাবিদ
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে