বিভুরঞ্জন সরকার
এ লেখাটি ছাপা হওয়ার দিন, অর্থাৎ ১২ জুলাই রাজধানীতে রাজনৈতিক ‘শক্তি’ দেখাতে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে করবে শান্তি সমাবেশ আর বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বড় শোডাউন করে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা দিয়ে নতুন আন্দোলনের সূচনা করবে। দুই দলের পক্ষ থেকেই ব্যাপক জনসমাগম ঘটানোর পরিকল্পনার কথা গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের উপস্থিতিতে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল সমাবেশ করে নিজ নিজ জনপ্রিয়তার পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করবে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান একমুখী নয়। আওয়ামী লীগ চায় আরও এক মেয়াদ সরকারে থাকতে। বিএনপি চায় সরকার ফেলে দিতে। সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক উপায় হলো নির্বাচন। এই নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়েই দুই দলের মতবিরোধ। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির পথে হাঁটতে দুই দলেরই আগ্রহ কম। এই বিরোধ-বিতর্কের সুযোগে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়াদৌড়ি রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সরকার পতনের আন্দোলনে গতি সঞ্চারের চেষ্টা বহুদিন ধরেই বিএনপি করছে। বৃহত্তর ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে বিএনপি নতুন কৌশল নিয়েছে। বিএনপির এখন একাধিক মিত্র জোট। রয়েছে ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং সমমনা গণতান্ত্রিক জোট, অর্থাৎ এক জোট ভেঙে একাধিক জোটকে আন্দোলনের সঙ্গী হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চ নামেও বিএনপির সঙ্গে একটি জোট আছে। জামায়াতে ইসলামী নামের দলটি বিএনপির স্বাভাবিক মিত্র হলেও সম্প্রতি এই দুই দলের মধ্যে চলছে মান-অভিমানের খেলা। সব মিলিয়ে হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার। বিএনপির সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে মোট দলের সংখ্যা কেউ বলছেন ৫৪, কেউ বলছেন ৬৬, আবার কেউ বলছেন সংখ্যা হয়তো শতাধিকও হয়ে যেতে পারে। তবে এই মিত্রদের সংখ্যা অনেক হলেও কার কতটুকু শক্তি আছে তা নিয়ে সংশয় আছে বিএনপির মধ্যেই। সব দল ও নেতার নাম মনে রাখাও কঠিন। আসলে মিত্র নিয়ে বিএনপি সমস্যায়ই পড়েছে। এত দলকে নিয়ে একমত হয়ে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সহজ কথা নয়। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে বিএনপিতে, এমনকি গণতন্ত্র মঞ্চেও। আবার নুরের দল গণ অধিকার পরিষদে তহবিলের স্বচ্ছতা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের জেরে দলের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়াকে অব্যাহতি দিয়ে নুর নিজেই দলের প্রধান হয়ে বসেছেন। নুর মনে করছেন, তাঁর গণ অধিকার পরিষদ অনেক বড় দল হয়ে উঠেছে এবং তিনি নিজে একজন বড় জাতীয় নেতা। এহেন নুরকে সামাল দিয়ে বিএনপি কি সঙ্গে রাখতে পারবে?
বিএনপির নেতারা আন্দোলন নিয়ে বড় বড় কথা বললেও বাস্তবে দলটি খুব সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন না। মাস কয়েক আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, কোনো স্বৈরাচারী সরকার আপসে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে চায় না। তাদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর বিকল্প নেই। অতীতে যেমন ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার এরশাদকে হটিয়েছে। এই সরকারও গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় নেবে—এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র!
বিষয়টি যেন এমন, বিএনপির নেতারা হুইসিল বাজাবেন আর দেশে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে যাবে! এ ধরনের মুখস্থ বক্তৃতা শুনে বিএনপির কর্মীরাও এখন খুশি হন কি না, সেটা এক মস্ত প্রশ্ন। কিছু কিছু ঘটনার জন্য দেশবাসীর একাংশ কিছুটা অসন্তুষ্ট থাকলেও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য মানুষ উসখুস করছে, বাস্তবে কি তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে? ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষের মধ্যে বিএনপি কৌতূহল তৈরি করতে পারলেও তা ধরে রাখতে পারেনি। বিএনপি যদি সরকারের নিষেধ অমান্য করে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে পারত, তাহলে এটা বোঝা যেত যে সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সক্ষমতা বিএনপি অর্জন করেছে। কিন্তু উল্টো বিএনপি সরকারের শর্তেই সমাবেশের জায়গা বদলাতে বাধ্য হয়েছে।
সরকারকে অনির্বাচিত বা অগণতান্ত্রিক যে হিসেবেই বিএনপি উল্লেখ করুক না কেন, সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সক্ষমতা দলটি দেখাতে পারছে না।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করছে। সরকার বিএনপির এই দাবি মানবে বলে মনে হয় না। আগেও এই দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করে সফল হয়নি। এবারও হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিএনপিকে আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে কীভাবে দলটির প্রার্থীদের পরাজিত করে জয় ছিনিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করাই কি দলটির জন্য ভালো নয়? ভোটাররা যাতে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন, অর্থাৎ আগামী নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। গত দুটি সংসদ নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, আগামী নির্বাচন যে সেভাবে হবে না, তা তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলছেন।
আমেরিকাসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের দৌড়াদৌড়ি কিংবা আমেরিকার ভিসা নীতি দেখে বিএনপি নিজেদের পরিকল্পনা সাজালে ভুল হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আমেরিকার দূরত্ব তৈরির গল্প যদি সত্যও হয়ে থাকে, তাতে বিএনপির খুশিতে আটখানা হওয়ার কিছু আছে কি? গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলা আমেরিকার পুরোনো অভ্যাস। আবার এটাও তো অসত্য নয় যে অতীতে পৃথিবীর অনেক দেশে সামরিক সরকার আমেরিকার সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পেরেছিল। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে মানবাধিকারের বুলি ভুলতে আমেরিকার সময় লাগে না।
রাজনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি ওয়ানওয়ে ট্রাফিকের মতো নয়। আমেরিকার ওপর বাংলাদেশের যেমন নির্ভরশীলতার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, তেমনি ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের পাশে থাকা আমেরিকারও স্বার্থসংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ যেন সব বিষয়ে ভারত, চীন ও রাশিয়ার ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে না ওঠে, সেটা আমেরিকা নিশ্চিত করতে চায়। বাংলাদেশ একটু ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রাখতে পারলে অনেক সংকটই এড়িয়ে চলতে পারবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই ভারসাম্যের কূটনীতিই অনুসরণ করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরের সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার যে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে, তাতে ভূরাজনীতি ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব রয়েছে। এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেরও স্বার্থ জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের সবচেয়ে বড় উৎস যেমন চীন, তেমনি রপ্তানির অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে আমেরিকা। এই বাস্তবতায় দেশ দুটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভৌগোলিক অবস্থান ও কৌশলগত নানা কারণ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তায়ও বাংলাদেশ প্রশংসিত ভূমিকা রাখছে। তাই এখন ঢাকাকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখতে চায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থায় নির্দিষ্ট কোনো জোটে বা প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সতর্ক ও কৌশলী অবস্থানে থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
নানা বিবেচনা ও সমীকরণ মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের জোট কোয়াডে বাংলাদেশ আপাতত যুক্ত হচ্ছে না। তবে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে (আইপিএস) সম্পৃক্ত হচ্ছে।
ভৌগোলিক অবস্থান, উদীয়মান অর্থনীতি ও বিপুল জনশক্তির বড় বাজার বাংলাদেশকে কৌশলগত কারণে তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতেও পাশে রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। আর তাদের চিরশত্রু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়েও তারা অবগত। বাংলাদেশ কোনো বলয়ে থাকবে না স্পষ্ট করলেও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ঐতিহাসিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ভারতের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক বজায় রেখেই অগ্রসর হবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। ভারতের কাছেও বাংলাদেশ অগ্রাধিকারের স্থান ধরে রেখেছে। এ অঞ্চলে এখনো ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাই বাইডেন প্রশাসনের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ নীতির খুব একটা হেরফের হওয়ার সুযোগ আছে কি?
বিএনপি রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের আগে এসব বাস্তবতা বিবেচনায় না নিলে আগের নির্বাচনের মতোই ভুল করবে। অসংখ্য ছোট ছোট দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নেমে বড় বড় কথা বলে অযথা উত্তেজনা ছড়ানোর ফল যে ভালো হয় না, বিএনপির নেতৃত্ব ১০ ডিসেম্বরের ঘটনায় নিশ্চয়ই সেটা টের পেয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশগ্রহণ না করে তার পরিণতি কী হবে, তার একটি ছোট রিহার্সাল সম্ভবত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে হয়েছে। বিএনপি ছেড়ে আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়াকে জিতিয়ে আনার জন্য শুধু আওয়ামী লীগ নয়, স্থানীয় বিএনপি ও জাতীয় পার্টিও এক হয়েছিল। বিএনপির জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি শিক্ষা হতে পারে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত অমান্য করার প্রস্তুতি নেই, সেটা কে বলতে পারে? বিএনপি যে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করেছিল সেটা তো তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত অমান্য করেই। নির্বাচনে অংশ না নেওয়া কিংবা নির্বাচন ভন্ডুল করার পথে না হেঁটে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগকে শক্ত চ্যালেঞ্জে ফেলতে পারবে বিএনপি। আর তা না হলে বিএনপিই সম্ভবত আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বিএনপির উচিত হবে বড় বড় কথা না বলে সংগঠন গুছিয়ে নির্বাচনকে আন্দোলন হিসেবে নিয়ে সরকারকেই চাপের মুখে ফেলা।
বিএনপি সরকার হটানোর তোড়জোড় করবে, আর আওয়ামী লীগ বসে বসে দেখবে, তা কি হওয়ার মতো? রাজনীতিকে বলা হয় কৌশলের খেলা। শেখ হাসিনাকে এই কৌশলের খেলায় বিএনপি কি পরাজিত করতে পেরেছে কখনো?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
এ লেখাটি ছাপা হওয়ার দিন, অর্থাৎ ১২ জুলাই রাজধানীতে রাজনৈতিক ‘শক্তি’ দেখাতে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে করবে শান্তি সমাবেশ আর বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বড় শোডাউন করে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা দিয়ে নতুন আন্দোলনের সূচনা করবে। দুই দলের পক্ষ থেকেই ব্যাপক জনসমাগম ঘটানোর পরিকল্পনার কথা গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের উপস্থিতিতে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল সমাবেশ করে নিজ নিজ জনপ্রিয়তার পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করবে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান একমুখী নয়। আওয়ামী লীগ চায় আরও এক মেয়াদ সরকারে থাকতে। বিএনপি চায় সরকার ফেলে দিতে। সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক উপায় হলো নির্বাচন। এই নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়েই দুই দলের মতবিরোধ। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির পথে হাঁটতে দুই দলেরই আগ্রহ কম। এই বিরোধ-বিতর্কের সুযোগে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়াদৌড়ি রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সরকার পতনের আন্দোলনে গতি সঞ্চারের চেষ্টা বহুদিন ধরেই বিএনপি করছে। বৃহত্তর ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে বিএনপি নতুন কৌশল নিয়েছে। বিএনপির এখন একাধিক মিত্র জোট। রয়েছে ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং সমমনা গণতান্ত্রিক জোট, অর্থাৎ এক জোট ভেঙে একাধিক জোটকে আন্দোলনের সঙ্গী হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চ নামেও বিএনপির সঙ্গে একটি জোট আছে। জামায়াতে ইসলামী নামের দলটি বিএনপির স্বাভাবিক মিত্র হলেও সম্প্রতি এই দুই দলের মধ্যে চলছে মান-অভিমানের খেলা। সব মিলিয়ে হইহই কাণ্ড রইরই ব্যাপার। বিএনপির সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে মোট দলের সংখ্যা কেউ বলছেন ৫৪, কেউ বলছেন ৬৬, আবার কেউ বলছেন সংখ্যা হয়তো শতাধিকও হয়ে যেতে পারে। তবে এই মিত্রদের সংখ্যা অনেক হলেও কার কতটুকু শক্তি আছে তা নিয়ে সংশয় আছে বিএনপির মধ্যেই। সব দল ও নেতার নাম মনে রাখাও কঠিন। আসলে মিত্র নিয়ে বিএনপি সমস্যায়ই পড়েছে। এত দলকে নিয়ে একমত হয়ে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সহজ কথা নয়। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে বিএনপিতে, এমনকি গণতন্ত্র মঞ্চেও। আবার নুরের দল গণ অধিকার পরিষদে তহবিলের স্বচ্ছতা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের জেরে দলের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়াকে অব্যাহতি দিয়ে নুর নিজেই দলের প্রধান হয়ে বসেছেন। নুর মনে করছেন, তাঁর গণ অধিকার পরিষদ অনেক বড় দল হয়ে উঠেছে এবং তিনি নিজে একজন বড় জাতীয় নেতা। এহেন নুরকে সামাল দিয়ে বিএনপি কি সঙ্গে রাখতে পারবে?
বিএনপির নেতারা আন্দোলন নিয়ে বড় বড় কথা বললেও বাস্তবে দলটি খুব সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন না। মাস কয়েক আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, কোনো স্বৈরাচারী সরকার আপসে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে চায় না। তাদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর বিকল্প নেই। অতীতে যেমন ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার এরশাদকে হটিয়েছে। এই সরকারও গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় নেবে—এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র!
বিষয়টি যেন এমন, বিএনপির নেতারা হুইসিল বাজাবেন আর দেশে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে যাবে! এ ধরনের মুখস্থ বক্তৃতা শুনে বিএনপির কর্মীরাও এখন খুশি হন কি না, সেটা এক মস্ত প্রশ্ন। কিছু কিছু ঘটনার জন্য দেশবাসীর একাংশ কিছুটা অসন্তুষ্ট থাকলেও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য মানুষ উসখুস করছে, বাস্তবে কি তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে? ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষের মধ্যে বিএনপি কৌতূহল তৈরি করতে পারলেও তা ধরে রাখতে পারেনি। বিএনপি যদি সরকারের নিষেধ অমান্য করে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে পারত, তাহলে এটা বোঝা যেত যে সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সক্ষমতা বিএনপি অর্জন করেছে। কিন্তু উল্টো বিএনপি সরকারের শর্তেই সমাবেশের জায়গা বদলাতে বাধ্য হয়েছে।
সরকারকে অনির্বাচিত বা অগণতান্ত্রিক যে হিসেবেই বিএনপি উল্লেখ করুক না কেন, সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সক্ষমতা দলটি দেখাতে পারছে না।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করছে। সরকার বিএনপির এই দাবি মানবে বলে মনে হয় না। আগেও এই দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করে সফল হয়নি। এবারও হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিএনপিকে আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে কীভাবে দলটির প্রার্থীদের পরাজিত করে জয় ছিনিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করাই কি দলটির জন্য ভালো নয়? ভোটাররা যাতে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন, অর্থাৎ আগামী নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। গত দুটি সংসদ নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, আগামী নির্বাচন যে সেভাবে হবে না, তা তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলছেন।
আমেরিকাসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের দৌড়াদৌড়ি কিংবা আমেরিকার ভিসা নীতি দেখে বিএনপি নিজেদের পরিকল্পনা সাজালে ভুল হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আমেরিকার দূরত্ব তৈরির গল্প যদি সত্যও হয়ে থাকে, তাতে বিএনপির খুশিতে আটখানা হওয়ার কিছু আছে কি? গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলা আমেরিকার পুরোনো অভ্যাস। আবার এটাও তো অসত্য নয় যে অতীতে পৃথিবীর অনেক দেশে সামরিক সরকার আমেরিকার সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পেরেছিল। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে মানবাধিকারের বুলি ভুলতে আমেরিকার সময় লাগে না।
রাজনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি ওয়ানওয়ে ট্রাফিকের মতো নয়। আমেরিকার ওপর বাংলাদেশের যেমন নির্ভরশীলতার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, তেমনি ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের পাশে থাকা আমেরিকারও স্বার্থসংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ যেন সব বিষয়ে ভারত, চীন ও রাশিয়ার ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে না ওঠে, সেটা আমেরিকা নিশ্চিত করতে চায়। বাংলাদেশ একটু ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রাখতে পারলে অনেক সংকটই এড়িয়ে চলতে পারবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই ভারসাম্যের কূটনীতিই অনুসরণ করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরের সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার যে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে, তাতে ভূরাজনীতি ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব রয়েছে। এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেরও স্বার্থ জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের সবচেয়ে বড় উৎস যেমন চীন, তেমনি রপ্তানির অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে আমেরিকা। এই বাস্তবতায় দেশ দুটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভৌগোলিক অবস্থান ও কৌশলগত নানা কারণ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তায়ও বাংলাদেশ প্রশংসিত ভূমিকা রাখছে। তাই এখন ঢাকাকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখতে চায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থায় নির্দিষ্ট কোনো জোটে বা প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সতর্ক ও কৌশলী অবস্থানে থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
নানা বিবেচনা ও সমীকরণ মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের জোট কোয়াডে বাংলাদেশ আপাতত যুক্ত হচ্ছে না। তবে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে (আইপিএস) সম্পৃক্ত হচ্ছে।
ভৌগোলিক অবস্থান, উদীয়মান অর্থনীতি ও বিপুল জনশক্তির বড় বাজার বাংলাদেশকে কৌশলগত কারণে তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতেও পাশে রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। আর তাদের চিরশত্রু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়েও তারা অবগত। বাংলাদেশ কোনো বলয়ে থাকবে না স্পষ্ট করলেও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ঐতিহাসিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ভারতের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক বজায় রেখেই অগ্রসর হবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। ভারতের কাছেও বাংলাদেশ অগ্রাধিকারের স্থান ধরে রেখেছে। এ অঞ্চলে এখনো ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাই বাইডেন প্রশাসনের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ নীতির খুব একটা হেরফের হওয়ার সুযোগ আছে কি?
বিএনপি রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের আগে এসব বাস্তবতা বিবেচনায় না নিলে আগের নির্বাচনের মতোই ভুল করবে। অসংখ্য ছোট ছোট দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নেমে বড় বড় কথা বলে অযথা উত্তেজনা ছড়ানোর ফল যে ভালো হয় না, বিএনপির নেতৃত্ব ১০ ডিসেম্বরের ঘটনায় নিশ্চয়ই সেটা টের পেয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশগ্রহণ না করে তার পরিণতি কী হবে, তার একটি ছোট রিহার্সাল সম্ভবত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে হয়েছে। বিএনপি ছেড়ে আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়াকে জিতিয়ে আনার জন্য শুধু আওয়ামী লীগ নয়, স্থানীয় বিএনপি ও জাতীয় পার্টিও এক হয়েছিল। বিএনপির জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি শিক্ষা হতে পারে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত অমান্য করার প্রস্তুতি নেই, সেটা কে বলতে পারে? বিএনপি যে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করেছিল সেটা তো তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত অমান্য করেই। নির্বাচনে অংশ না নেওয়া কিংবা নির্বাচন ভন্ডুল করার পথে না হেঁটে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগকে শক্ত চ্যালেঞ্জে ফেলতে পারবে বিএনপি। আর তা না হলে বিএনপিই সম্ভবত আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বিএনপির উচিত হবে বড় বড় কথা না বলে সংগঠন গুছিয়ে নির্বাচনকে আন্দোলন হিসেবে নিয়ে সরকারকেই চাপের মুখে ফেলা।
বিএনপি সরকার হটানোর তোড়জোড় করবে, আর আওয়ামী লীগ বসে বসে দেখবে, তা কি হওয়ার মতো? রাজনীতিকে বলা হয় কৌশলের খেলা। শেখ হাসিনাকে এই কৌশলের খেলায় বিএনপি কি পরাজিত করতে পেরেছে কখনো?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪