জ্বালানি সংকটে পোশাকশিল্পে লালবাতির দশা

ফারুক মেহেদী, ঢাকা
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২২, ০৮: ২০

তীব্র বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংকটে ধুঁকছে ঢাকা ও এর আশপাশের শিল্পকারখানা। চাহিদার তুলনায় কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ-গ্যাস না পাওয়ায় রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, বস্ত্র, চামড়াসহ বিভিন্ন খাতের হাজার হাজার ছোট-বড় শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অথচ কর্মীদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে হচ্ছে।

এরই মধ্যে গতকাল পোশাক-মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকটের কারণে সামনে ২০ শতাংশ রপ্তানি কমে যাবে। ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের শিল্পমালিকেরা জানিয়েছেন, সরকার চাইলেই গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থা সমন্বয় করে এবং আপৎকালীন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করে শিল্পোৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখতে পারে। দ্রুত এ পদক্ষেপ না নিলে শিল্পকারখানা বসে পড়বে।

দেশের অন্যতম শীর্ষ নিট পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মাইক্রো ফাইবার গ্রুপ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও ফতুল্লায় এ গ্রুপের বেশ কয়েকটি নিট কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় অন্তত ৪০ হাজার কর্মী কাজ করছেন। গতকাল এই গ্রুপের উদ্যোক্তা পরিচালক ড. কামরুজ্জামান কায়সার আজকের পত্রিকাকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকটে উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের অর্ডার থাকলেও চাহিদামতো পণ্য উৎপাদন করতে পারছি না। গ্যাসের জাতীয় গ্রিডের ওপর আমরা নির্ভর করি। রাতে যখন প্রেশার আসে, তখন এক শিফট চালাতে পারি। বাকি সময়টা আমাদের ডিজেল দিয়ে চালাতে হয়। সব কটি কারখানায় প্রতিদিন ডিজেলের পেছনেই খরচ হয় প্রায় দুই লাখ টাকা।’ তিনি পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে জানিয়ে বলেন, খরচ বেড়ে গিয়ে সবার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

মাইক্রো ফাইবার গ্রুপের মতো রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের এ রকম হাজারো ছোট-বড় শিল্পকারখানায় সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে। উদ্যোক্তারা এখন মরিয়া হয়ে ডিজেলে বাড়তি খরচ করেও শিল্প টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তাঁরা এখন কম গুরুত্বপূর্ণ খাত ও জায়গা থেকে সমন্বয় করে রাজধানীর আশপাশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

তাঁরা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে এসব স্থানে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। এর বাইরেও তাঁরা সরকারকে কাতার ও ওমানের সাথে চুক্তির আওতায় ১০০ এমএমসিএফ গ্যাস আনার পাশাপাশি স্পট মার্কেট থেকে আরও ১০০ এমএমসিএফ এলএনজি আমদানির সুপারিশ করেছেন।

ইভেন্স গ্রুপের উদ্যোক্তা ও বিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের শিল্পগুলো মারাত্মক গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকটের কবলে। এ থেকে মুক্তি পেতে সরকারকে বলেছি স্পট মার্কেট থেকে অতিরিক্ত ১০০ এমএমসিএফ এলএনজি আমদানি করতে। এ জন্য বড়জোর ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার লাগবে। এটা দিয়ে আগামী ছয় মাস চলবে।

প্রয়োজনে আলোচনা করে আমরা বেশি দাম দিতেও রাজি আছি। সরকার যদি মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করে পুরো শিল্পকে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ না নেয়, তাহলে রিজার্ভ রেখে লাভ কী?’ তিনি বলেন, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টার সাথে আলাপ হয়েছে।

গ্যাস-সংকটে বেশি ভুগছে নিট রপ্তানি শিল্প। বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিদ্যুৎ না থাকায় আমাদের জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। ডিজেল খরচ বেড়েছে। পরিবহন খরচ বেড়েছে। গ্যাস না থাকায় বাড়তি অর্থ খরচ করে সিএনজি কিনে চালাতে হচ্ছে।’

আজকের পত্রিকার গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার প্রতিনিধিরা রাজধানীর আশপাশের তিনটি অঞ্চলের শিল্পোৎপাদন পরিস্থিতির খোঁজখবর নিয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তা ও তিতাস গ্যাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথেও আলাপ করেছেন।

আজকের পত্রিকার সাভার প্রতিনিধি অরূপ রায় জানিয়েছেন, সাভার-আশুলিয়া অঞ্চলে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধিত শিল্প-বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০। এগুলোর জন্য দিনে ১৭০ এমএমসিএফ পরিমাণ গ্যাসের চাহিদা রয়েছে, আর সরবরাহ করা হচ্ছে ১৪০-১৪২ এমএমসিএফ। ফলে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি কারখানাই গ্যাস-সংকটে পুরো উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে না। এতে দৈনন্দিন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কর্মীরা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় অলস বসে থাকছেন। এতে উদ্যোক্তাদের লোকসান বাড়ছে।

স্থানীয় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক অজিত চন্দ্র দেব আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় কারখানায় ঠিকমতো গ্যাস সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না। এতে উৎপাদন কিছুটা কমছে বলে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি।’

এদিকে রাজধানীর লাগোয়া শিল্পাঞ্চল গাজীপুরেও প্রায় একই অবস্থা চলছে। আজকের পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ৬৫০ মেগাওয়াট। তার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে অর্ধেক। এতে লোডশেডিং বেড়েছে।

তিতাস গ্যাস-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গাজীপুরের শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ক্যাপটিভ পাওয়ার কেন্দ্র, সিএনজি স্টেশন ও আবাসিক মিলিয়ে প্রতিদিন ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। সেখানে গড়ে প্রতিদিন আড়াই শ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে।

গাজীপুরের স্প্যারো অ্যাপারেলসের চিফ অপারেশন অফিসার শরিফুল রেজা জানান, তাঁদের কারখানায় প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়। অন্যদিকে ১২-১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ১ দশমিক ৫ থেকে ২ পিএসআই। ফলে কারখানা চালু রাখার জন্য ডিজেলে নির্ভর করতে হয়। এতে মাসে প্রায় এক কোটি টাকার ডিজেল খরচ হয়।

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের সাদমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সহসভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংকটের কারণে কারখানা চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ-১-এর সিনিয়র জিএম যুবরাজ চন্দ্র পাল জানান, চাহিদার তুলনায় বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

তিতাস গ্যাসের জয়দেবপুর শাখার ব্যবস্থাপক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, গাজীপুরের শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ক্যাপটিভ পাওয়ার কেন্দ্র, সিএনজি স্টেশন ও আবাসিক মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রতিদিন আড়াই শ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। কখনো এ ঘাটতি আরও বেড়ে যায়।

আজকের পত্রিকার নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি সাবিত আল হাসান জানিয়েছেন, জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে কলকারখানা রয়েছে অন্তত ছয় হাজার। এসব কারখানা সাম্প্রতিক সময়ের লোডশেডিং ও গ্যাস-সংকটে ভুগছে।

নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের সহসভাপতি মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল বলেন, ‘আমাদের নতুন বিপত্তি গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকট। একদিকে টাকা আসছে না, অন্যদিকে ব্যাংক ইনস্টলমেন্টের জন্য চাপ দিচ্ছে, শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকটে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত