মাসুদ রানা
আজকের পত্রিকা: বর্তমানে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
শান্তনু মজুমদার: সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আর সবার মতো আমার মনেও একধরনের অস্বস্তি ও উদ্বেগ আছে। পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক নয়। তবে আতঙ্কিত নই। রাজনীতির প্রভাব জনজীবনে পড়তে শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা দিক থেকে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবনেও এখন চাপটা লাগছে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতিটা সুখকর কিছু নয়।
আজকের পত্রিকা: পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এর সমাধানের কি কোনো উপায় নেই?
শান্তনু মজুমদার: আপনি কি কোনো চটজলদি জাদুকরি সমাধানের কথা ভাবছেন? সে ক্ষেত্রে আমি আপনার সঙ্গে একমত নই। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ও স্বাধীন না থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা কমে যায়। এই অর্জনটা সময়সাপেক্ষ। পৃথিবীর কোথাও এটা আসমান থেকে পড়েনি। ২০০ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাস বলে, পৃথিবীর কোনো দেশেই বিনা পরিশ্রমে, বিনা টেনশনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়নি। দেশে নির্বাচনের ঘণ্টা বেজে গেছে। এখন এসব আলোচনার সুযোগ কম। এখনকার কাজ হচ্ছে এবারের নির্বাচন গণতন্ত্রসম্মত উপায়ে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ করার ভাবনা-চিন্তা করা এবং এই লক্ষ্য পূরণে সক্রিয় হওয়া।
আজকের পত্রিকা: তবু এই আলোচনাটা আরেকটু চলুক?
শান্তনু মজুমদার: ঠিক আছে। দেশের কিছুসংখ্যক জ্ঞানী-গুণী মানুষ তিন দশক ধরে আমাদের মন ছোট করে দেওয়ার মতো কথা বলছেন। তাঁদের কথাবার্তা থেকে মনে হয়, এ দেশের মতো খারাপ রাজনীতি আর রাজনীতিক বিশ্বের আর কোথাও নেই। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ কিন্তু তথ্য-উপাত্তভিত্তিক নয়। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ থেকে একটি গণতন্ত্রবিরোধী উপসংহারেও পৌঁছে গেছেন কিছু মানুষ। উপসংহারটা হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাহলে করণীয় কী? করণীয় হচ্ছে ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিদের অধীনে নির্বাচনটা ছেড়ে দেওয়া। এই ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য জানা যায় না। আর এই ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিরা যে অনির্বাচিত, এ কথাটা কোথাও বলার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় একটি প্রশ্ন অনালোচিত থেকেই যায়—গণতন্ত্রে যেকোনো পরিচয়েই হোক, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ আছে কি না? কিছু জ্ঞানী মানুষ আবার তত্ত্বাবধায়কের বিরোধিতা দেখলে আবেগী প্রতিক্রিয়া দেখান। তখন আলোচনা বা তর্ক কোনোটিই চলে না। কেউ কেউ তত্ত্বাবধায়কবিরোধীকে অমুকের দালাল-তমুকের দালাল হিসেবে লেবেল লাগিয়ে দুর্নাম ছড়ান।
আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পরে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাটা খুব স্বল্পমেয়াদি হয়েছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক সরকার ছিল। এ সময় দলীয় সরকার ছিল না। সামরিক শাসন শেষে যে নতুন সুযোগ এসেছিল, সেটাও সেভাবে কাজে লাগানো যায়নি। ১৯৯৪ সালের মার্চে মাগুরা উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক অনিয়মের বিরোধিতা করতে গিয়ে গণতন্ত্রের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনা ঘটে যায়। বলা শুরু হয়, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সে সময় বিরোধী দলের প্রতি নমনীয় বুদ্ধিজীবী এবং শক্তিমান হতে থাকা নতুন ধারার শহুরে সুশীল সমাজের অনেকেই এই বক্তব্যে সোচ্চার ছিলেন।
একটু আগেই বলেছি, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে দলীয় সরকার ছিল না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে ১৯৭৩ সালে। সেই নির্বাচনে কিছু সহিংসতা ও অনিয়ম হলেও, কোনো গবেষক এবং সে সময়কার আন্তর্জাতিক কোনো মিডিয়া নির্বাচনটিকে খারিজ করেনি।
রাজনৈতিক দল সময়ভেদে অবস্থান পরিবর্তন করে। যেমন বর্তমানে যে দল তত্ত্বাবধায়ক চাইছে তারা একসময় এর ঘোর বিরোধী ছিল। বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাও তত্ত্বাবধায়ক প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান পাল্টেছে। কিন্তু মাগুরা উপনির্বাচনকে উদাহরণ করে এত বড় একটা রায় শহুরে সুশীল সমাজ কেন দিয়েছিলেন?
আমি মনে করি, বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলো সামরিক শাসন-পরবর্তী যুগে শক্তিশালী হতে না পারার একটি বড় কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব অনির্বাচিত লোকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। নিরপেক্ষতার বিষয়টি নিয়েও দুই বড় দলের মনে প্রশ্ন আছে। ২০০১ সালের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিএনপি সুখী ছিল না। ২০০৭ সালের শুরুতে ক্ষমতা নেওয়া তত্ত্বাবধায়কের তিন মাসের জায়গায় দুই বছর থেকে যাওয়াটাই-বা কতটা গণতান্ত্রিক ছিল?
আমার মনে হয়, নিরপেক্ষ নির্বাচনের আলোচনায় স্কয়ার ওয়ানে ফিরে গিয়ে লাভ নেই। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন করানো এবং রাজনীতিকদের অযোগ্য-অপদার্থ হিসেবে চিহ্নিত করানো বন্ধ হোক। দুই শর বেশি দেশ যেভাবে নির্বাচন করে, উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব চেষ্টা-চরিত্র করে, সেগুলোই আমাদের পথ হোক। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশন যাতে পক্ষপাতিত্বের পথে যেতে না পারে, তার জন্য যত রকমের প্রতিষেধক-প্রতিরোধক নেওয়া দরকার, সেগুলোর আলোচনা দরকার।
আজকের পত্রিকা: ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আছে?
শান্তনু মজুমদার: বিতর্ক আছে এটা ঠিক। তবে এই দুই নির্বাচনকে একভাবে দেখলে হবে না। ২০১৪ সালে তত্ত্বাবধায়ককে কেন্দ্র করে প্রধান দুই পক্ষ নো-রিটার্ন পয়েন্টে চলে গিয়েছিল। বিরোধীরা তত্ত্বাবধায়ক বাদে নির্বাচন হতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। ক্ষমতাসীনেরা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলেছিল। তখন একটা শক্তিমত্তার পরীক্ষা হয়েছিল।
তখন আর বিষয়টা সংলাপের মধ্যে ছিল না। পক্ষান্তরে ২০১৮ সালে পরিস্থিতি বেশ ভালো ছিল। তথাপি নির্বাচনটি কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পারেনি। এটা অবশ্যই দুঃখের ব্যাপার। এবার কিন্তু সে রকম কোনো কিছু বরদাশত হওয়ার সুযোগ নেই।
আজকের পত্রিকা: বিএনপিকে বাদ দিয়ে এবার যদি নির্বাচন হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক হবে কি?
শান্তনু মজুমদার: বিষয়টা বাদ দেওয়ার ব্যাপার নয়। বিএনপি বলছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এটা যদি অনড় অবস্থান হয়, তাহলে তো তারা আবার ২০১৪ সালের অবস্থানে ফিরে গেল। আবার ক্ষমতাসীনেরা তফসিল ঘোষণার আগে বলল, সংলাপে বসার সময় পার হয়ে গেছে। এগুলো খুব বেশি কাজের কথা মনে হয় কি? কোনো দল নির্বাচনে আসবে কি না, তা দলের নিজস্ব বিচার-বিবেচনা। কিন্তু যদি কেউ কাউকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে চায়, সেটা অবশ্যই গণতন্ত্রের জন্য ভালো হবে না। আবার কেউ যদি অগণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবিতে অটল থাকে, তাহলেও সুবিধা হবে না।
এসব বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ করার জন্য সবার পক্ষ থেকে চাপ তৈরি করা দরকার। গণবুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, মিডিয়া, রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা দরকার। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখাই এ সময়ের জরুরি কাজ।
আজকের পত্রিকা: কেউ কেউ বলে থাকেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সংকট নিরসন সহজ হতে পারে। আপনি কী বলবেন?
শান্তনু মজুমদার: এটা বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার জন্য ভালো। এটা নিয়ে কথাবার্তা হতে পারে আগামী নির্বাচনের পরে। একটা প্রশ্ন—যেসব দেশে এভাবে নির্বাচন হয়, সেখানে কি রাজনৈতিক সংকট ও সংঘর্ষ হয় না? সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলেই যে আমাদের রাজনৈতিক সংকটগুলো সমাধান হবে, এটা আমি মনে করি না; বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানোন্নয়ন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, সরকারি দলের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মুক্ত রাখার কষ্টকর চ্যালেঞ্জগুলোতে আমাদের জয়ী হতে হবে। উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রতিটি রাষ্ট্র এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যায়।
এখানে একটা নির্জলা বাস্তবতা উল্লেখ করা দরকার—দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে গণতন্ত্র নিয়ে যে রকম উচ্ছ্বাস দেখা যায়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার ক্ষেত্রে কিন্তু সেই পর্যায়ের মনোযোগ দেখা যায় না। বাংলাদেশ এই প্রবণতার বাইরে নয়।
আজকের পত্রিকা: নির্বাচন কমিশনকে আইনে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেই ক্ষমতা তারা কেন ব্যবহার করতে পারে না?
শান্তনু মজুমদার: রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো তুড়ি বাজালেই শক্তিশালী বা ধ্বংস হয়ে যায় না। একটা সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ এবং জনমনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার নিট যোগফল হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের এখানে এগুলো বারবার জখম হয়েছে। যখন যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁদের ওপরে এর দায় বর্তাবে অবশ্যই। যেসব ব্যক্তি নির্বাচনী পদগুলোতে থাকেন, তাঁদের কাছে পদে থাকাটাই প্রধান বিবেচনা হয়ে ওঠে কি না, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়।
আজকের পত্রিকা: আওয়ামী লীগ প্রতি নির্বাচনের আগে কৌশল পরিবর্তন করছে। কিন্তু বিএনপি একই কৌশলে আছে। এভাবে বিএনপি কি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে?
শান্তনু মজুমদার: বিএনপির কৌশল আমার জানা নেই। আমি বুঝি যে প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজ মতাদর্শ, বুদ্ধিমত্তা ও সামর্থ্য অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করে। এগুলোর ভিত্তিতে কখনো তারা জয়ী হয়, কখনো হেরে যায়। এই বিষয়ে বাইরের লোকেরা কীই-বা বলতে পারবে!
কোনো দলকে আগ বাড়ানো, কোনো দলকে পিছু টানা বা কোনো দলকে টেনে নামানো নয়; বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল্যবোধসম্পন্ন দলগুলোকে সরকারে এবং বিরোধী দলে দেখতে পাওয়াটাই হবে বড় অর্জন। এ ক্ষেত্রে আরও বলতে চাই, আমাদের দেশে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের অভাব আছে।
আজকের পত্রিকা: বর্তমানে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
শান্তনু মজুমদার: সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আর সবার মতো আমার মনেও একধরনের অস্বস্তি ও উদ্বেগ আছে। পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক নয়। তবে আতঙ্কিত নই। রাজনীতির প্রভাব জনজীবনে পড়তে শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা দিক থেকে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবনেও এখন চাপটা লাগছে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতিটা সুখকর কিছু নয়।
আজকের পত্রিকা: পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এর সমাধানের কি কোনো উপায় নেই?
শান্তনু মজুমদার: আপনি কি কোনো চটজলদি জাদুকরি সমাধানের কথা ভাবছেন? সে ক্ষেত্রে আমি আপনার সঙ্গে একমত নই। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ও স্বাধীন না থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা কমে যায়। এই অর্জনটা সময়সাপেক্ষ। পৃথিবীর কোথাও এটা আসমান থেকে পড়েনি। ২০০ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাস বলে, পৃথিবীর কোনো দেশেই বিনা পরিশ্রমে, বিনা টেনশনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়নি। দেশে নির্বাচনের ঘণ্টা বেজে গেছে। এখন এসব আলোচনার সুযোগ কম। এখনকার কাজ হচ্ছে এবারের নির্বাচন গণতন্ত্রসম্মত উপায়ে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ করার ভাবনা-চিন্তা করা এবং এই লক্ষ্য পূরণে সক্রিয় হওয়া।
আজকের পত্রিকা: তবু এই আলোচনাটা আরেকটু চলুক?
শান্তনু মজুমদার: ঠিক আছে। দেশের কিছুসংখ্যক জ্ঞানী-গুণী মানুষ তিন দশক ধরে আমাদের মন ছোট করে দেওয়ার মতো কথা বলছেন। তাঁদের কথাবার্তা থেকে মনে হয়, এ দেশের মতো খারাপ রাজনীতি আর রাজনীতিক বিশ্বের আর কোথাও নেই। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ কিন্তু তথ্য-উপাত্তভিত্তিক নয়। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ থেকে একটি গণতন্ত্রবিরোধী উপসংহারেও পৌঁছে গেছেন কিছু মানুষ। উপসংহারটা হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাহলে করণীয় কী? করণীয় হচ্ছে ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিদের অধীনে নির্বাচনটা ছেড়ে দেওয়া। এই ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য জানা যায় না। আর এই ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিরা যে অনির্বাচিত, এ কথাটা কোথাও বলার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় একটি প্রশ্ন অনালোচিত থেকেই যায়—গণতন্ত্রে যেকোনো পরিচয়েই হোক, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ আছে কি না? কিছু জ্ঞানী মানুষ আবার তত্ত্বাবধায়কের বিরোধিতা দেখলে আবেগী প্রতিক্রিয়া দেখান। তখন আলোচনা বা তর্ক কোনোটিই চলে না। কেউ কেউ তত্ত্বাবধায়কবিরোধীকে অমুকের দালাল-তমুকের দালাল হিসেবে লেবেল লাগিয়ে দুর্নাম ছড়ান।
আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পরে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাটা খুব স্বল্পমেয়াদি হয়েছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক সরকার ছিল। এ সময় দলীয় সরকার ছিল না। সামরিক শাসন শেষে যে নতুন সুযোগ এসেছিল, সেটাও সেভাবে কাজে লাগানো যায়নি। ১৯৯৪ সালের মার্চে মাগুরা উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক অনিয়মের বিরোধিতা করতে গিয়ে গণতন্ত্রের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনা ঘটে যায়। বলা শুরু হয়, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সে সময় বিরোধী দলের প্রতি নমনীয় বুদ্ধিজীবী এবং শক্তিমান হতে থাকা নতুন ধারার শহুরে সুশীল সমাজের অনেকেই এই বক্তব্যে সোচ্চার ছিলেন।
একটু আগেই বলেছি, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে দলীয় সরকার ছিল না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে ১৯৭৩ সালে। সেই নির্বাচনে কিছু সহিংসতা ও অনিয়ম হলেও, কোনো গবেষক এবং সে সময়কার আন্তর্জাতিক কোনো মিডিয়া নির্বাচনটিকে খারিজ করেনি।
রাজনৈতিক দল সময়ভেদে অবস্থান পরিবর্তন করে। যেমন বর্তমানে যে দল তত্ত্বাবধায়ক চাইছে তারা একসময় এর ঘোর বিরোধী ছিল। বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাও তত্ত্বাবধায়ক প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান পাল্টেছে। কিন্তু মাগুরা উপনির্বাচনকে উদাহরণ করে এত বড় একটা রায় শহুরে সুশীল সমাজ কেন দিয়েছিলেন?
আমি মনে করি, বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলো সামরিক শাসন-পরবর্তী যুগে শক্তিশালী হতে না পারার একটি বড় কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব অনির্বাচিত লোকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। নিরপেক্ষতার বিষয়টি নিয়েও দুই বড় দলের মনে প্রশ্ন আছে। ২০০১ সালের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিএনপি সুখী ছিল না। ২০০৭ সালের শুরুতে ক্ষমতা নেওয়া তত্ত্বাবধায়কের তিন মাসের জায়গায় দুই বছর থেকে যাওয়াটাই-বা কতটা গণতান্ত্রিক ছিল?
আমার মনে হয়, নিরপেক্ষ নির্বাচনের আলোচনায় স্কয়ার ওয়ানে ফিরে গিয়ে লাভ নেই। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন করানো এবং রাজনীতিকদের অযোগ্য-অপদার্থ হিসেবে চিহ্নিত করানো বন্ধ হোক। দুই শর বেশি দেশ যেভাবে নির্বাচন করে, উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব চেষ্টা-চরিত্র করে, সেগুলোই আমাদের পথ হোক। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশন যাতে পক্ষপাতিত্বের পথে যেতে না পারে, তার জন্য যত রকমের প্রতিষেধক-প্রতিরোধক নেওয়া দরকার, সেগুলোর আলোচনা দরকার।
আজকের পত্রিকা: ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আছে?
শান্তনু মজুমদার: বিতর্ক আছে এটা ঠিক। তবে এই দুই নির্বাচনকে একভাবে দেখলে হবে না। ২০১৪ সালে তত্ত্বাবধায়ককে কেন্দ্র করে প্রধান দুই পক্ষ নো-রিটার্ন পয়েন্টে চলে গিয়েছিল। বিরোধীরা তত্ত্বাবধায়ক বাদে নির্বাচন হতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। ক্ষমতাসীনেরা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলেছিল। তখন একটা শক্তিমত্তার পরীক্ষা হয়েছিল।
তখন আর বিষয়টা সংলাপের মধ্যে ছিল না। পক্ষান্তরে ২০১৮ সালে পরিস্থিতি বেশ ভালো ছিল। তথাপি নির্বাচনটি কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পারেনি। এটা অবশ্যই দুঃখের ব্যাপার। এবার কিন্তু সে রকম কোনো কিছু বরদাশত হওয়ার সুযোগ নেই।
আজকের পত্রিকা: বিএনপিকে বাদ দিয়ে এবার যদি নির্বাচন হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক হবে কি?
শান্তনু মজুমদার: বিষয়টা বাদ দেওয়ার ব্যাপার নয়। বিএনপি বলছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এটা যদি অনড় অবস্থান হয়, তাহলে তো তারা আবার ২০১৪ সালের অবস্থানে ফিরে গেল। আবার ক্ষমতাসীনেরা তফসিল ঘোষণার আগে বলল, সংলাপে বসার সময় পার হয়ে গেছে। এগুলো খুব বেশি কাজের কথা মনে হয় কি? কোনো দল নির্বাচনে আসবে কি না, তা দলের নিজস্ব বিচার-বিবেচনা। কিন্তু যদি কেউ কাউকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে চায়, সেটা অবশ্যই গণতন্ত্রের জন্য ভালো হবে না। আবার কেউ যদি অগণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবিতে অটল থাকে, তাহলেও সুবিধা হবে না।
এসব বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ করার জন্য সবার পক্ষ থেকে চাপ তৈরি করা দরকার। গণবুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, মিডিয়া, রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা দরকার। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখাই এ সময়ের জরুরি কাজ।
আজকের পত্রিকা: কেউ কেউ বলে থাকেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সংকট নিরসন সহজ হতে পারে। আপনি কী বলবেন?
শান্তনু মজুমদার: এটা বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার জন্য ভালো। এটা নিয়ে কথাবার্তা হতে পারে আগামী নির্বাচনের পরে। একটা প্রশ্ন—যেসব দেশে এভাবে নির্বাচন হয়, সেখানে কি রাজনৈতিক সংকট ও সংঘর্ষ হয় না? সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলেই যে আমাদের রাজনৈতিক সংকটগুলো সমাধান হবে, এটা আমি মনে করি না; বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানোন্নয়ন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, সরকারি দলের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মুক্ত রাখার কষ্টকর চ্যালেঞ্জগুলোতে আমাদের জয়ী হতে হবে। উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রতিটি রাষ্ট্র এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যায়।
এখানে একটা নির্জলা বাস্তবতা উল্লেখ করা দরকার—দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে গণতন্ত্র নিয়ে যে রকম উচ্ছ্বাস দেখা যায়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার ক্ষেত্রে কিন্তু সেই পর্যায়ের মনোযোগ দেখা যায় না। বাংলাদেশ এই প্রবণতার বাইরে নয়।
আজকের পত্রিকা: নির্বাচন কমিশনকে আইনে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেই ক্ষমতা তারা কেন ব্যবহার করতে পারে না?
শান্তনু মজুমদার: রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো তুড়ি বাজালেই শক্তিশালী বা ধ্বংস হয়ে যায় না। একটা সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ এবং জনমনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার নিট যোগফল হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের এখানে এগুলো বারবার জখম হয়েছে। যখন যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁদের ওপরে এর দায় বর্তাবে অবশ্যই। যেসব ব্যক্তি নির্বাচনী পদগুলোতে থাকেন, তাঁদের কাছে পদে থাকাটাই প্রধান বিবেচনা হয়ে ওঠে কি না, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়।
আজকের পত্রিকা: আওয়ামী লীগ প্রতি নির্বাচনের আগে কৌশল পরিবর্তন করছে। কিন্তু বিএনপি একই কৌশলে আছে। এভাবে বিএনপি কি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে?
শান্তনু মজুমদার: বিএনপির কৌশল আমার জানা নেই। আমি বুঝি যে প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজ মতাদর্শ, বুদ্ধিমত্তা ও সামর্থ্য অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করে। এগুলোর ভিত্তিতে কখনো তারা জয়ী হয়, কখনো হেরে যায়। এই বিষয়ে বাইরের লোকেরা কীই-বা বলতে পারবে!
কোনো দলকে আগ বাড়ানো, কোনো দলকে পিছু টানা বা কোনো দলকে টেনে নামানো নয়; বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল্যবোধসম্পন্ন দলগুলোকে সরকারে এবং বিরোধী দলে দেখতে পাওয়াটাই হবে বড় অর্জন। এ ক্ষেত্রে আরও বলতে চাই, আমাদের দেশে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের অভাব আছে।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে