বিভুরঞ্জন সরকার
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৫ জুন। ১৬ জুন ‘আজকের পত্রিকা’র প্রধান শিরোনাম ‘দিনের শান্তি রাতে নষ্ট’। আমার কাছে কুসিক নির্বাচনের পর এ শিরোনামটি সবচেয়ে জুতসই মনে হয়েছে। কারণ, সারা দিন ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে। কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনের কারণে ভোট গ্রহণ কিছুটা শ্লথ হওয়া এবং শুরুর দিকে ভোটার উপস্থিতি কম থাকা ছাড়া ভোট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। কাউকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে কিংবা কোনো ভোটারকে ইভিএম মেশিনের সামনে দাঁড় করিয়ে কোনো ‘ডাকাত’ বা ‘সন্ত্রাসী’ বলেছে ‘আঙুল আপনার টিপ আমার’—এমন অভিযোগও শোনা যায়নি। ভোটাররা ভীতিমুক্তভাবে নিজের পছন্দের প্রার্থীর মার্কায় টিপ দিতে পেরেছেন। কোনো কেন্দ্র থেকে কোনো প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেনি। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ভোট নিয়ে যেসব অভিযোগ শোনা যায়, তার একটিও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সারা দিন শোনা যায়নি। ভোট গ্রহণের দায়িত্ব যাঁরা পালন করেছেন, তাঁরা যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। এটা ভালো লক্ষণ অবশ্যই। শুধু স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে চিঠি দিয়েও কুমিল্লা ত্যাগে বাধ্য করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। একে অনেকেই কমিশনের অসহায় ‘আত্মসমর্পণ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ভোটের ফলাফল ঘোষণার শুরুও ভালো ছিল। আমি নিজে টেলিভিশনে দেখেছি, শুরুর দিকে কয়েকটি কেন্দ্রের ঘোষিত ফলে সামান্য এগিয়ে ছিলেন টেবিলঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। তারপর বেশ কিছু সময় এগিয়ে ছিলেন নৌকা প্রতীকের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। ভোটের ব্যবধান অবশ্য কখনোই হাজার হাজার ছিল না। মোট ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১০১টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা পর্যন্ত সাক্কু সামান্য ভোটে এগিয়ে ছিলেন। এ সময় ফল ঘোষণার জায়গায় নৌকা ও টেবিলঘড়ি প্রতীকের দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে বচসা ও কথা-কাটাকাটি শুরু হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, শান্তি বিঘ্নিত হয়। ফলাফল ঘোষণা ৪৫ মিনিটের জন্য স্থগিত থাকে। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ-আনসার সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ৪৫ মিনিট পর রিটার্নিং কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতকে ৩৪৩ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের সদস্যরা উল্লাসে মেতে ওঠেন। আগে দুইবারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর মেয়র পদে হ্যাটট্রিক করার স্বপ্ন ভেঙে যায়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ৪৫ মিনিটের নাটকীয়তায় চার কেন্দ্রের ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং করে তাঁকে হারিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা গোলযোগের সময় কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর তাঁকে পরাজিত ঘোষণা করা হয়। সাক্কুর অভিযোগ থেকে মনে হয়, টেলিফোনে কারও নির্দেশ পেয়েই রিটার্নিং কর্মকর্তা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছেন।
এই অভিযোগের ব্যাপারে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরীর বক্তব্য: কুসিক নির্বাচনে দুই পক্ষের নেতা-কর্মী ও অনুসারীদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে ফলাফল ঘোষণায় একটু দেরি হয়। এ ছাড়া সে সময় বৃষ্টির কারণে ফল দেরিতে পৌঁছানোকেও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
ফোন কলে কারও সঙ্গে কথা বলার পর ভোটের ফল পাল্টে যাওয়ার বিষয়টি একেবারে ভিত্তিহীন বলে দাবি করে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘তখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি ফোনে কথা বলছিলাম সিইসি, ডিসি ও এসপির সঙ্গে। অন্য কারও ফোন আসেনি। পরাজিত প্রার্থী চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। ফল ঘোষণার সময় তাঁরা কেন অভিযোগ জানাননি।’ তিনি এটাও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘যে চারটি কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেখানে সব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রতিনিধি ছিলেন। সেখানে তাঁদের যে রেজাল্ট শিট দেওয়া হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে আমরা যে ঘোষণা দিয়েছি, সেখানে কোনো অমিল থাকলে আমাদের বলতে পারতেন।’
রিটার্নিং কর্মকর্তার মতোই নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরও বলেছেন, ‘প্রতিটা কেন্দ্রে নির্বাচন শেষে গণনা করে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারাই ফলাফল ঘোষণা করেন। তাঁর এই ফলাফলটাই হলো চূড়ান্ত। সেটার ভিত্তিতেই রিটার্নিং অফিসার সেই ফলাফল কম্পাইল করে, যোগ-বিয়োগ করে কেন্দ্রীয়ভাবে তা ঘোষণা করেন। ফলাফল পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার কোনো সুযোগ তাঁর নেই।’
সাক্কুর কাছে ওই চার কেন্দ্রের ফলাফল শিট আছে। তাতে গরমিল থাকলে সেই ফলাফল শিট গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে না দিয়ে তাঁকে হারিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুললেন কেন? নিজে জিতলে ঠিক আর হারলে সব বেঠিক—এই নীতি তো সমর্থনযোগ্য নয়। আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে আর আওয়ামী লীগ জিতলে বলা হবে নির্বাচন ভালো হয়নি, এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে নির্বাচনের পরিবেশ কীভাবে উন্নত হবে? হারজিত যে নির্বাচনের স্বাভাবিক নিয়ম, সেটা না মানলে তো নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ কখনো তৈরি সহজ হবে না। আওয়ামী লীগকে কেন হেরেই প্রমাণ করতে হবে যে নির্বাচন ভালো হয়েছে?
কুসিক নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী পাঁচজন থাকলেও মূল আলোচনায় ছিলেন তিনজন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নবনির্বাচিত মেয়র আরফানুল হক রিফাত, বিদায়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কু এবং বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার। কুমিল্লার রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, নিজাম উদ্দিন কায়সারের ঘোড়া প্রতীকে নির্বাচন করাই সাক্কুর হারের বড় কারণ। কায়সার ভোট পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯টি। এর সবই বিএনপির সমর্থকদের। এই ভোটই পারত রিফাত ও সাক্কুর লড়াইয়ে পার্থক্য গড়ে দিতে। সে ক্ষেত্রে হয়তো সাক্কুর জয় সম্ভব ছিল। অন্যদিকে সাক্কু যাঁদের ভোট পেয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের বিরোধী তথা আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটার। বিএনপিকে সমর্থন করেন এমন ভোট সাক্কু খুব কমই পেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। সাক্কুর পাওয়া ভোটের একটা অংশ এসেছে কুমিল্লার জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি-গোষ্ঠীর কাছ থেকে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রথম পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় কমিশন পাস করতে পেরেছে, না ফেল করেছে—তা নিয়েও আমরা একমত হতে পারব না। কারণ, আমাদের রাজনীতি হলো একমত না হওয়ার। যাঁরা পরীক্ষক, তাঁরাও একমতের মানুষ নন। একজন পাস নম্বর দিলে অন্যজন অবশ্যই ফেল করাবেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনের কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচন কমিশনকে কুমিল্লায় ফেল করিয়েছেন। কিন্তু এই সংগঠনের কুমিল্লা জেলা সভাপতি আলমগীর খান বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে যেমন সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন চেয়েছি, তার পুরোটাই হয়েছে। নির্বাচনে কোনো অনিয়ম ঘটেনি। বৃষ্টি না হলে ভোটার আরও বাড়ত।’ চার কেন্দ্রের ফল ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি সারা দিন উৎসবের ভোট হওয়ার পর রাতে ফলাফল ঘোষণার সময় হট্টগোল বাধে। ফলাফল ঘোষণায় ৪৫ মিনিট দেরি হওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ইসি। অন্যদিকে সাক্কুর লোকজন যে অভিযোগ করেছেন, তার প্রমাণ থাকা উচিত ছিল। তাতে চার কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা না করা নিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, তা সেখানেই দূর হয়ে যেত।’
আমাদের রাজনীতিতে যেমন স্বচ্ছতার অভাব, তেমনি অন্য সব ক্ষেত্রেও। আমরা সন্দেহ তৈরি করতে যতটা উৎসাহী, সন্দেহ দূর করতে ততটা নয়। তবে আমরা চাইব, কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে দিনের শান্তি রাতে নষ্ট হওয়ার যে ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয়েছে, সেটা যেন পরের নির্বাচনগুলোতে আর না হয়। আওয়ামী লীগকে যেমন বুঝতে হবে দেশে আরও দল আছে, দলমতের সমর্থন করেন না—এমন মানুষও আছেন। দেশের সব মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নন, আবার সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শেরও সৈনিক নন। অন্যদিকে বিএনপিকেও বুঝতে হবে, তাদের মতের সঙ্গে দেশের সব মানুষই একমত নন। সরকারবিরোধী হলেই সবাই বিএনপিকে ভোট দেবেন, তা-ও নয়। সরকারের সমালোচনা মানেই বিএনপির পক্ষে নয়। রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করার সময় একরৈখিক পথনকশা প্রস্তুত না করাই শ্রেয়।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৪৩ ভোটে সাক্কুকে হারিয়ে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন আওয়ামী লীগের আরফানুল হক রিফাত। কুমিল্লার মানুষ এই পরিবর্তনের পক্ষে না থাকলে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি শান্ত থাকত না।
বিজয়ী মেয়র রিফাতের সাফল্য কামনা করে নিজের অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানিয়ে তাঁর বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরছি। জয়ী হওয়ার পর আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেছেন, ‘জনগণ যে দায়িত্ব পালনের জন্য আমাকে জয়ী করেছেন, তা আমি পরিপূর্ণভাবে পালন করব। আমি কুমিল্লাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমাকে এবং নৌকাকে ভালোবেসে আমাকে জয়ী করেছেন। আমি তাঁদের সেই সম্মান রাখব। আর সেটা অবশ্যই সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজের মাধ্যমে।’ দায়িত্ব নিয়েই সবার আগে নগরীর সমস্যা চিহ্নিত করবেন বলে জানিয়েছেন রিফাত। তিনি বলেন, ‘কোন সমস্যা আগে সমাধান করব, সেটার জন্য আলোচনায় বসব। সুন্দর নগরী গড়তে দেশের নামকরা নগরবিদদের সাহায্য নেব।’
পরের নির্বাচনের আগে তাঁর বিরুদ্ধে ওয়াদা ভঙ্গের অপবাদ যেন না ওঠে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৫ জুন। ১৬ জুন ‘আজকের পত্রিকা’র প্রধান শিরোনাম ‘দিনের শান্তি রাতে নষ্ট’। আমার কাছে কুসিক নির্বাচনের পর এ শিরোনামটি সবচেয়ে জুতসই মনে হয়েছে। কারণ, সারা দিন ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে। কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনের কারণে ভোট গ্রহণ কিছুটা শ্লথ হওয়া এবং শুরুর দিকে ভোটার উপস্থিতি কম থাকা ছাড়া ভোট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। কাউকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে কিংবা কোনো ভোটারকে ইভিএম মেশিনের সামনে দাঁড় করিয়ে কোনো ‘ডাকাত’ বা ‘সন্ত্রাসী’ বলেছে ‘আঙুল আপনার টিপ আমার’—এমন অভিযোগও শোনা যায়নি। ভোটাররা ভীতিমুক্তভাবে নিজের পছন্দের প্রার্থীর মার্কায় টিপ দিতে পেরেছেন। কোনো কেন্দ্র থেকে কোনো প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেনি। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ভোট নিয়ে যেসব অভিযোগ শোনা যায়, তার একটিও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সারা দিন শোনা যায়নি। ভোট গ্রহণের দায়িত্ব যাঁরা পালন করেছেন, তাঁরা যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। এটা ভালো লক্ষণ অবশ্যই। শুধু স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে চিঠি দিয়েও কুমিল্লা ত্যাগে বাধ্য করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। একে অনেকেই কমিশনের অসহায় ‘আত্মসমর্পণ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ভোটের ফলাফল ঘোষণার শুরুও ভালো ছিল। আমি নিজে টেলিভিশনে দেখেছি, শুরুর দিকে কয়েকটি কেন্দ্রের ঘোষিত ফলে সামান্য এগিয়ে ছিলেন টেবিলঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। তারপর বেশ কিছু সময় এগিয়ে ছিলেন নৌকা প্রতীকের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। ভোটের ব্যবধান অবশ্য কখনোই হাজার হাজার ছিল না। মোট ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১০১টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা পর্যন্ত সাক্কু সামান্য ভোটে এগিয়ে ছিলেন। এ সময় ফল ঘোষণার জায়গায় নৌকা ও টেবিলঘড়ি প্রতীকের দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে বচসা ও কথা-কাটাকাটি শুরু হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, শান্তি বিঘ্নিত হয়। ফলাফল ঘোষণা ৪৫ মিনিটের জন্য স্থগিত থাকে। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ-আনসার সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ৪৫ মিনিট পর রিটার্নিং কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতকে ৩৪৩ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের সদস্যরা উল্লাসে মেতে ওঠেন। আগে দুইবারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর মেয়র পদে হ্যাটট্রিক করার স্বপ্ন ভেঙে যায়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ৪৫ মিনিটের নাটকীয়তায় চার কেন্দ্রের ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং করে তাঁকে হারিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা গোলযোগের সময় কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর তাঁকে পরাজিত ঘোষণা করা হয়। সাক্কুর অভিযোগ থেকে মনে হয়, টেলিফোনে কারও নির্দেশ পেয়েই রিটার্নিং কর্মকর্তা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছেন।
এই অভিযোগের ব্যাপারে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরীর বক্তব্য: কুসিক নির্বাচনে দুই পক্ষের নেতা-কর্মী ও অনুসারীদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে ফলাফল ঘোষণায় একটু দেরি হয়। এ ছাড়া সে সময় বৃষ্টির কারণে ফল দেরিতে পৌঁছানোকেও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
ফোন কলে কারও সঙ্গে কথা বলার পর ভোটের ফল পাল্টে যাওয়ার বিষয়টি একেবারে ভিত্তিহীন বলে দাবি করে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘তখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি ফোনে কথা বলছিলাম সিইসি, ডিসি ও এসপির সঙ্গে। অন্য কারও ফোন আসেনি। পরাজিত প্রার্থী চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। ফল ঘোষণার সময় তাঁরা কেন অভিযোগ জানাননি।’ তিনি এটাও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘যে চারটি কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেখানে সব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রতিনিধি ছিলেন। সেখানে তাঁদের যে রেজাল্ট শিট দেওয়া হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে আমরা যে ঘোষণা দিয়েছি, সেখানে কোনো অমিল থাকলে আমাদের বলতে পারতেন।’
রিটার্নিং কর্মকর্তার মতোই নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরও বলেছেন, ‘প্রতিটা কেন্দ্রে নির্বাচন শেষে গণনা করে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারাই ফলাফল ঘোষণা করেন। তাঁর এই ফলাফলটাই হলো চূড়ান্ত। সেটার ভিত্তিতেই রিটার্নিং অফিসার সেই ফলাফল কম্পাইল করে, যোগ-বিয়োগ করে কেন্দ্রীয়ভাবে তা ঘোষণা করেন। ফলাফল পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার কোনো সুযোগ তাঁর নেই।’
সাক্কুর কাছে ওই চার কেন্দ্রের ফলাফল শিট আছে। তাতে গরমিল থাকলে সেই ফলাফল শিট গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে না দিয়ে তাঁকে হারিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুললেন কেন? নিজে জিতলে ঠিক আর হারলে সব বেঠিক—এই নীতি তো সমর্থনযোগ্য নয়। আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে আর আওয়ামী লীগ জিতলে বলা হবে নির্বাচন ভালো হয়নি, এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে নির্বাচনের পরিবেশ কীভাবে উন্নত হবে? হারজিত যে নির্বাচনের স্বাভাবিক নিয়ম, সেটা না মানলে তো নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ কখনো তৈরি সহজ হবে না। আওয়ামী লীগকে কেন হেরেই প্রমাণ করতে হবে যে নির্বাচন ভালো হয়েছে?
কুসিক নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী পাঁচজন থাকলেও মূল আলোচনায় ছিলেন তিনজন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নবনির্বাচিত মেয়র আরফানুল হক রিফাত, বিদায়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কু এবং বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার। কুমিল্লার রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, নিজাম উদ্দিন কায়সারের ঘোড়া প্রতীকে নির্বাচন করাই সাক্কুর হারের বড় কারণ। কায়সার ভোট পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯টি। এর সবই বিএনপির সমর্থকদের। এই ভোটই পারত রিফাত ও সাক্কুর লড়াইয়ে পার্থক্য গড়ে দিতে। সে ক্ষেত্রে হয়তো সাক্কুর জয় সম্ভব ছিল। অন্যদিকে সাক্কু যাঁদের ভোট পেয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের বিরোধী তথা আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটার। বিএনপিকে সমর্থন করেন এমন ভোট সাক্কু খুব কমই পেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। সাক্কুর পাওয়া ভোটের একটা অংশ এসেছে কুমিল্লার জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি-গোষ্ঠীর কাছ থেকে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রথম পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় কমিশন পাস করতে পেরেছে, না ফেল করেছে—তা নিয়েও আমরা একমত হতে পারব না। কারণ, আমাদের রাজনীতি হলো একমত না হওয়ার। যাঁরা পরীক্ষক, তাঁরাও একমতের মানুষ নন। একজন পাস নম্বর দিলে অন্যজন অবশ্যই ফেল করাবেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনের কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচন কমিশনকে কুমিল্লায় ফেল করিয়েছেন। কিন্তু এই সংগঠনের কুমিল্লা জেলা সভাপতি আলমগীর খান বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে যেমন সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন চেয়েছি, তার পুরোটাই হয়েছে। নির্বাচনে কোনো অনিয়ম ঘটেনি। বৃষ্টি না হলে ভোটার আরও বাড়ত।’ চার কেন্দ্রের ফল ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি সারা দিন উৎসবের ভোট হওয়ার পর রাতে ফলাফল ঘোষণার সময় হট্টগোল বাধে। ফলাফল ঘোষণায় ৪৫ মিনিট দেরি হওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ইসি। অন্যদিকে সাক্কুর লোকজন যে অভিযোগ করেছেন, তার প্রমাণ থাকা উচিত ছিল। তাতে চার কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা না করা নিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, তা সেখানেই দূর হয়ে যেত।’
আমাদের রাজনীতিতে যেমন স্বচ্ছতার অভাব, তেমনি অন্য সব ক্ষেত্রেও। আমরা সন্দেহ তৈরি করতে যতটা উৎসাহী, সন্দেহ দূর করতে ততটা নয়। তবে আমরা চাইব, কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে দিনের শান্তি রাতে নষ্ট হওয়ার যে ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয়েছে, সেটা যেন পরের নির্বাচনগুলোতে আর না হয়। আওয়ামী লীগকে যেমন বুঝতে হবে দেশে আরও দল আছে, দলমতের সমর্থন করেন না—এমন মানুষও আছেন। দেশের সব মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নন, আবার সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শেরও সৈনিক নন। অন্যদিকে বিএনপিকেও বুঝতে হবে, তাদের মতের সঙ্গে দেশের সব মানুষই একমত নন। সরকারবিরোধী হলেই সবাই বিএনপিকে ভোট দেবেন, তা-ও নয়। সরকারের সমালোচনা মানেই বিএনপির পক্ষে নয়। রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করার সময় একরৈখিক পথনকশা প্রস্তুত না করাই শ্রেয়।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৪৩ ভোটে সাক্কুকে হারিয়ে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন আওয়ামী লীগের আরফানুল হক রিফাত। কুমিল্লার মানুষ এই পরিবর্তনের পক্ষে না থাকলে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি শান্ত থাকত না।
বিজয়ী মেয়র রিফাতের সাফল্য কামনা করে নিজের অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানিয়ে তাঁর বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরছি। জয়ী হওয়ার পর আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেছেন, ‘জনগণ যে দায়িত্ব পালনের জন্য আমাকে জয়ী করেছেন, তা আমি পরিপূর্ণভাবে পালন করব। আমি কুমিল্লাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমাকে এবং নৌকাকে ভালোবেসে আমাকে জয়ী করেছেন। আমি তাঁদের সেই সম্মান রাখব। আর সেটা অবশ্যই সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজের মাধ্যমে।’ দায়িত্ব নিয়েই সবার আগে নগরীর সমস্যা চিহ্নিত করবেন বলে জানিয়েছেন রিফাত। তিনি বলেন, ‘কোন সমস্যা আগে সমাধান করব, সেটার জন্য আলোচনায় বসব। সুন্দর নগরী গড়তে দেশের নামকরা নগরবিদদের সাহায্য নেব।’
পরের নির্বাচনের আগে তাঁর বিরুদ্ধে ওয়াদা ভঙ্গের অপবাদ যেন না ওঠে।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে