শিল্পীসমাজও রাজপথে

এ আর চন্দন, ঢাকা
Thumbnail image

একাত্তরের উত্তাল মার্চের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠক হয়েছিল। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সামরিক আইন প্রত্যাহার চাওয়ার পাশাপাশি বাঙালিদের ওপর গুলিবর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ড বন্ধ করাসহ বিভিন্ন নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে এর জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে বিচার দাবি করেছিলেন। বাঙালি হত্যার প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে অংশ নেন বৈঠকে। সকাল থেকেই উৎসুক জনতা অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠকের ফল কী হয় তা জানতে। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া বৈঠকটি শেষ হয়েছিল দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ইয়াহিয়ার কাছ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। ওই বৈঠক নিয়েই পরদিন ঢাকার সব সংবাদপত্রের প্রধান প্রতিবেদন সাজানো ছিল। ব্যানার, অর্থাৎ আট কলাম শিরোনাম করেছিল দৈনিক সংগ্রাম ও আজাদ।

দৈনিক পাকিস্তানে ‘মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা শুরু’ শিরোনামটি ছিল সাত কলাম। সংবাদে শিরোনাম ছিল ছয় কলাম। দৈনিক ইত্তেফাক বাঁ দিকে বঙ্গবন্ধুর চার কলাম ছবি দিয়ে ডানে চার কলাম শিরোনাম করে ‘জাতির ভাগ্য নির্ধারণী আলোচনা শুরু’।

সময় তখন দ্রুত এগিয়ে চলছিল অনিবার্য পরিণতির দিকে। ওই সময়ে স্বাধীনতার আন্দোলনকে আরও উজ্জীবিত করতে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন শিল্পীরাও। রাজপথে, মাঠে-ময়দানে তখন গণসংগীত, নাটক, পথনাটক ও পথসভা করে চলছিল উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বেতার-টেলিভিশন শিল্পী সংসদ, মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন। এর প্রতিফলন দেখা যায় সংবাদপত্রের পাতায়ও। আর্ট কলেজের ছাত্র-শিক্ষকেরা ১৬ মার্চ ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সভা করেন।

সভাশেষে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে মিছিল হয়। শিল্পীদের সেই বিক্ষোভ মিছিলের একটি খাড়া ছবিসহ ‘শিল্পী সমাজের বজ্র শপথে রাজপথ প্রকম্পিত’ শিরোনামে পরদিন খবর প্রকাশ করে দৈনিক পাকিস্তান প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনামের ডান পাশে। ইত্তেফাকে শিল্পীদের মিছিলের তিন কলাম ছবি ছাপা হয় প্রথম পাতায় নিচের দিকে।

সমঝোতার নাটক করতে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেও মুক্তিকামী বাঙালি তাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখে। দেশবাসীকে অধিকারবঞ্চিত করার প্রতিবাদস্বরূপ শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের খেতাব বর্জন এই দিনেও অব্যাহত রাখেন। চারদিকে শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যায়। শিল্পাচার্য জয়নুলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাঁদের রাষ্ট্রীয় খেতাব বর্জন করেন। পরদিন ১৭ মার্চ দৈনিক পাকিস্তানে খেতাব বর্জনের সংবাদ ছাপা হয় প্রথম পাতায় প্রধান ছবির নিচে।

এদিকে দেশবাসীও নিজেদের সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠক চলা অবস্থায়ই স্বাধীনতাকামী বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামে গোটা বাংলা কার্যত অচল ছিল। সামরিক জান্তার কোনো আদেশ-নির্দেশই মানছিল না বীর বাঙালি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আলোচনার জন্য ঢাকায় অবস্থান করলেও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ভেতরে-ভেতরে সামরিক শক্তি বাড়ানো হচ্ছিল। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে গোপনে সারা দেশে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টি। এ-সংক্রান্ত কিছু খবর পত্রপত্রিকায়ও উঠে আসে তখন। মহিলা পরিষদ ও ছাত্র ইউনিয়নের ১৬ মার্চের কুচকাওয়াজের খবর পরদিন প্রথম পাতায় প্রধান প্রতিবেদনের বাঁ দিকে প্রকাশ করে দৈনিক সংবাদ। প্রধান প্রতিবেদনের নিচে ডান দিকে তিন কলাম শিরোনাম ছিল ‘সভায়-মিছিলে লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখার শপথ’। পত্রিকাটি সেদিন প্রধান শিরোনামের বাঁ পাশে শীর্ষ কলামে ছেপেছিল ‘জামালপুরে হাজার হাজার লোকের সশস্ত্র মিছিল’ শিরোনামে একটি খবর।

শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আগে পাকিস্তানের দুই অংশে দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দেওয়া প্রস্তাবের প্রতিবাদে এদিন লাহোরে প্রতীক অনশন করেন কয়েকজন ছাত্রনেতা। পরদিন দৈনিক পাকিস্তানে প্রথম পাতায় সংবাদটি ছাপা হয় ‘ভুট্টোর উক্তির প্রতিবাদে লাহোরে অনশন ধর্মঘট’ শিরোনামে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত