স্বজন হারিয়ে দিশেহারা

বরগুনা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৭: ১২
আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২২, ১০: ৩৯

দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের। এখনো নিখোঁজ অনেকের সন্ধান মেলেনি। আত্মীয়স্বজনেরা নিখোঁজদের জীবিত ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। আশা ছিল মরদেহ ফিরে পাবেন। কিন্তু সে আশারও আর করতে পারছেন না। দাফন করা মৃতদেহের পরিচয় পেতেও স্বজনদের অপেক্ষা করতে হবে আরও এক মাস। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা অপরদিকে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনেরা।

বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের মানিকখালী গ্রামের হাকিম শরীফ সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির (এসএমসসি) একটি কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্ত্রী পাখি বেগম ছোট ছেলে শিশু নাসরুল্লাহকে নিয়ে স্বামীর কাছে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে লঞ্চে আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ হন তিনজনই। হাকিম শরীফের বড় মেয়ে হাফসা এ বছর দাখিলে এ প্লাস পেয়েছে। ছুমাইয়া স্থানীয় মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণিতে ও ফজলুল হক তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। বাবা-মা ভাইকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হাফসা দুই ভাই-বোনকে নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে। প্রতিবেশীদের সহায়তায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। হাফসা বলে, ‘মোর এই ছোডো ভাই বুইনরে কেডা এহন পড়ালেহা হরাইবে, খাওন জোগামু ক্যামনে। মুই এহন কী হরমু কিদ্দা সংসার চালামু দিশা পাইতেছি না।’

পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের ছোট টেংরা গ্রামের আফজাল হোসেনের মেয়ে ফজিলা আক্তার পপি (২৬)। ৭ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয় তাঁর। একমাত্র মেয়ে লামিয়ার (১১) লেখাপড়া ও জীবিকার তাগিদে ঢাকার একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেন পপি। ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে বরগুনার উদ্দেশে রওনা হন তিনি। নিজ কর্মস্থল ঢাকার সাভারে বিদ্যালয়ে মেয়েকে ভর্তি করানোর স্বপ্ন বুনে বাবার বাড়ি থেকে মেয়েকে নিতে আসছিলেন তিনি। ইচ্ছেটা পূরণ হলো না। দুর্ঘটনার পর স্বজনেরা তাঁকে লঞ্চে, নদী, বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রশাসনের উদ্ধার করা লাশের মধ্যেও খুঁজে পাননি। অভিভাবকহীন লামিয়ার জীবনের গন্তব্য এখন অনিশ্চিত। পপির মেয়ে লামিয়া বলে, ‘মা বলছিল বাড়িতে এসে আমাকে ঢাকায় নিয়ে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করে দেবে। এখনো মা আসেনি। শুনেছি যে লঞ্চে আগুন লেগেছে সেই লঞ্চেই আমার মা আসতেছিল। এখন আমায় মা বলে কে ডাকবে? মা কি আসবে?’

পপির বৃদ্ধ বাবা আফজাল হোসেন বলেন, ‘একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে কীভাবে থাকব? জীবনের তাগিদে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করত সে। নাতনিডারে কেমনে বুজ দিমু, মুই বুড়া মানু মইর‍্যা গ্যালে এই নাতিরে মোর কেডা খাওয়াইবে পড়াইবে।’

ছেলে আরিফুর রহমানকে হারিয়ে বৃদ্ধা মা আলেয়া জাহান এখনো মূর্ছা যাচ্ছে। আরিফুর রহমানের বৃদ্ধা মা আলেয়া জাহান বলেন, ‘মোর পোলা আরিফ কামাই কইর‍্যা সংসার চালাইত। এহন ওর দুইডা সন্তান লইয়া দুশ্চিন্তায় আছি। ওগো কেডা পড়ালেহা করাইবে, ভবিষ্যৎ কী?’ তিনি বলেন, ‘ছেলে ও নাতনির পরিচয় শনাক্তে আমরা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছি। তবে এখনো আমরা তাদের জীবিত ফেরার আশা ছেড়ে দিয়েছি। আরিফুর রহমানের স্ত্রী খাদিজা বেগম বলেন, ‘আমার বড় মেয়েটা মানসিক প্রতিবন্ধী আর ছেলেটা ছোট। সামনের দিনগুলো কীভাবে চলব? সেই চিন্তায় দিশেহারা আমি।’

একইভাবে লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত, নিখোঁজ ও চিকিৎসাধীন অধিকাংশ পরিবার উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে সংসারের ব্যয় নির্বাহের ভারে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা নিহতের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা অর্থসহায়তা দিয়েছি। এ ছাড়া নিহত, নিখোঁজদের স্বজন ও চিকিৎসাধীন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তার জন্য আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা যথাসাধ্য তাঁদের পাশে থাকব।’

২৩ ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী অতিক্রমকালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৪৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২৩ জনের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় তাঁদের বরগুনা সদরের পোটকাখালী গ্রামে খাকদোন নদীর তীরবর্তী গণকবরে দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় বরগুনা, ঝালকাঠি ও ঢাকায় তিনটি মামলা হয়েছে। মামলায় লঞ্চের মালিকসহ পাঁচজন কারাগারে রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত