পোড়া গাড়িটি যেন ঘটনার ভয়াবহতার সাক্ষী

তাসনীম হাসান, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১০ জুন ২০২২, ০৭: ০৩
আপডেট : ১০ জুন ২০২২, ১১: ৪৫

চাকার টায়ার পুড়ে বেরিয়ে এসেছে ভেতরটা। সামনের গ্লাসের ছিটেফোঁটাও বাকি নেই। গাড়ির পুরোটা জুড়েই ছোপ ছোপ কালো দাগ। হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে, যুদ্ধে বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া কোনো এক সাঁজোয়া যান!

না, এটি কোনো যুদ্ধযান নয়। পুড়ে ‘কঙ্কাল’ হয়ে যাওয়া গাড়িটি কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের। সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লেগেছে এমন খবর পেয়ে যেটি নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৫ কর্মী সেই রাতে ছুটেছিলেন ঘটনাস্থলে। ভেঁপু বাজিয়ে যে গাড়িটি গিয়েছিল ডিপোতে, সেটি আর অক্ষত ফিরে আসতে পারেনি। সম্পূর্ণ অচল হয়ে যাওয়ায় গাড়িটি আনতে হয়েছে লরির সহায়তায়। সেই গাড়িটির মতোই জীবন নিয়ে ফিরতে পারেননি অনেক আগুনযোদ্ধা। আগুন নেভাতে গিয়ে যে নিজেরাই নিভে গেছেন আগুনে! এখন গাড়িটি যেন সেদিনের ভয়াবহ বিস্ফোরণের নীরব সাক্ষ্য দিচ্ছে।

গত শনিবার রাত তখন ৯টা বেজে ২৫ মিনিট। হঠাৎ বেজে ওঠে আগুন লাগার ঘণ্টি। সেটি শুনেই কুমিরা ফায়ার স্টেশনের প্রধান সুলতান মাহমুদ ১৫ সহকর্মী নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়েন গাড়ি নিয়ে। কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন থেকে ডিপোর দূরত্ব প্রায় নয় কিলোমিটার। ১০ মিনিটেরও কম সময়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পৌঁছান সেই দূরত্বে। ঘটনাস্থলে গিয়েই শুরু করেন আগুন নেভানোর কাজ। এর মধ্যেই ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে আগুন নির্বাপণে কাজ শুরু করেন সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ১১ সদস্যও।

আগুন নির্বাপণের কাজ শুরুর প্রায় ঘণ্টাখানেক পরেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে অন্যদের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের কোনো সদস্য উড়ে যান দূরে কোথাও। কেউ বা আগুনের ফুলকিতে হারিয়ে যান। এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের নয় সদস্যের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। নিখোঁজ আছেন আরও তিনজন। আহতের সংখ্যাটাও কম না–১৪ জন। সব মিলিয়ে শুরুতে আগুন নির্বাপণে যাওয়া দুই স্টেশনের ২৬ জনের সবাই হতাহত হয়েছেন। এক সঙ্গে এতজন ফায়ার ফাইটারকে হারিয়ে দুটি ফায়ার স্টেশনজুড়েই এখন এখন শূন্যতা, নীরব আহাজারি। অবশ্য শোক পালনের অবসরটুকু মিলছে কোথায়। নতুন করে কোথাও আগুন লাগলে যেন নির্বাপণে কাজ করা যায়–সে জন্য দুই স্টেশনে ১০ জনকে আপাতত পদায়ন করা হয়েছে।

কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের প্রধান সুলতান মাহমুদ গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এখন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এত সহকর্মীকে হারানো বড় বেদনার। আমরা শোককে শক্তিতে পরিণত করতে চাই। আমাদের মনোবল চাঙা আছে।’

কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের পুড়ে যাওয়া গাড়িটিকে আগ্রাবাদে অবস্থিত বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কার্যালয়ে আনা হয়েছে। গাড়িটির লোহা ছাড়া সবটাই যেন পুড়ে গেছে। গতকাল অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, সবার বুকেই শোকের কালো ব্যাচ। ফায়ার সার্ভিসের অনেক সদস্য পোড়া গাড়িটি দেখছিলেন। বিধ্বস্ত এই গাড়িটিই এখন কাঁদাচ্ছে তাদের। কেউ কেউ বলছিলেন, ‘আমাদের এতগুলো সহকর্মী নাই হয়ে যাবেন, ভাবতেই পারছি না।’

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করি। এরপর নিজের প্রচেষ্টার সব ঢেলে নেভানোর চেষ্টা করি। সেদিন আমাদের সহকর্মীরাও দ্রুত পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। তবে সেখানে যে রাসায়নিক পদার্থ ছিল, সেটি জানানো হয়নি। সে জন্য সাধারণ আগুন মনে করে তাঁরা নেভানোর চেষ্টা করেন। এতে বিস্ফোরণ হলে তাঁরা আর বাঁচতে পারেননি। ফায়ার সার্ভিসের ইতিহাসে এটি খুবই স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত