অভ্যুত্থানের ছায়া

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৩, ০৭: ৫৭

জিয়াউর রহমান তখন উপসেনাপ্রধান। তাঁর কাছে জুনিয়র অফিসার ফারুক যেতে পারেন না। কিন্তু তিনি গেলেন। কারণ, শেখ মুজিবকে হটিয়ে দিতে গেলে তাঁর জায়গায় তো কাউকে না কাউকে বসাতে হবে। তিনি জিয়াউর রহমানের শরণাপন্ন হলেন।

এ ব্যাপারে মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথা ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’ বইয়ে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ফারুকের সাক্ষাৎকারের কথা লিখেছেন। ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে জিয়াউর রহমান আর মইনুল হোসেন চৌধুরী স্কোয়াশ খেলে জিয়ার 
বাড়ির সামনের লনে বসে গল্প করছিলেন। কথা শেষে উঠে গেলেন মইনুল হোসেন চৌধুরী।

বাইরের গেটের কাছে এসে দেখেন, সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন মেজর ফারুক। মইনুল জানতে চাইলেন, এখানে তিনি কী করছেন? ফারুক জবাব দিলেন, তিনি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

বিষয়টি নিয়ে মইনুল পরদিন জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। জিয়া জানান, ফারুক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তবে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী অফিসারদের বলে দিয়েছেন, এভাবে জুনিয়র অফিসাররা যেন তাঁর বাড়িতে না আসেন।

ফারুক অবশ্য একেবারে তারিখসহ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ জিয়া-ফারুকের সাক্ষাৎ হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট যুক্তরাজ্যের গ্রানাডা টেলিভিশনের ‘ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই হত্যাকারী ফারুক আর রশীদের। সে অনুষ্ঠানেই কথাগুলো বলেন ফারুক।

ফারুক সেদিন যা বলেছিলেন, তা থেকে স্পষ্ট হয়, দেশের সেনাবাহিনীর উপপ্রধানকে তিনি সরাসরি দেশের রাষ্ট্রপতিকে উচ্ছেদের কথা বলেননি। তবে চাতুর্যের সঙ্গে তিনি দেশে দুর্নীতি, অরাজকতা ইত্যাদির কথা জানিয়ে একসময় বলেছিলেন, দেশে একটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

এ কথা শোনার পর জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘চলো, আমরা লনে গিয়ে আলাপ করি।’

সেনাবাহিনী, শাসনব্যবস্থা, সরকার—সবই অধঃপাতে যাচ্ছে বলে মনে করেন ফারুক। তাই একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। সে পরিকল্পনাও জুনিয়র অফিসাররা করে ফেলেছেন। এর উত্তরে জিয়াউর রহমান কী করলেন? একজন সিনিয়র অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান সরাসরি সরকার উচ্ছেদে জড়িত হতে চাননি। তবে তিনি বলেছিলেন, জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু করতে চান, তবে তা করতে পারেন। তাঁকে যেন এসবের মধ্যে না টানা হয়।

এ রকম একটি ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়ার পরও উপসেনাপ্রধান এ ব্যাপারে কাউকে কিছু জানাননি। রাষ্ট্রপতির কাছে খবর পাঠাননি। অথচ সে সময় বাকশালের সদস্য হওয়ার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন!

আরেকটা কথা এখানে বলা দরকার, ফারুক-রশীদকে মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়ে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের সংযুক্তি খুবই রহস্যময়। মেজর রশীদ ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে ঢাকায় এসেছিলেন ‘ছুটিতে’। এরপর মুক্তিযুদ্ধে তার যোগদান। মেজর ফারুকের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান আরও রহস্যঘন ঘটনা। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের বাইরে, মধ্যপ্রাচ্যে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের প্রথম ৮ মাস তার শীতনিদ্রা কাটেনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের কথা তখন ভাবেননি। কখন ভেবেছেন? ভেবেছেন তখন, যখন মোটামুটি বিশ্ব বুঝে গেছে, একটা নতুন দেশের বিজয় সন্নিকটে। ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি যশোরে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। সে ক্ষেত্রে তাদের দুজনকে সত্যিই কি মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবে?

মইনুল হোসেন চৌধুরী যখন সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল ছিলেন, তখন ফারুককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রসঙ্গটি আসে। সব দিক বিবেচনা করে তিনি কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ফারুককে স্বীকৃতি দেননি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত