জাহীদ রেজা নূর
আমাদের দেশে নির্বাচনী মাঠে প্রতিপক্ষকে দমননিপীড়ন করার ঐতিহ্য আজকের নয়। আইয়ুব খানের আমল থেকে ধরলে দেখা যায়, ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বিরোধীপক্ষের কর্মীদের তুমুলভাবে দমননিপীড়ন করা হয়েছিল। তাতে ভোটের মাঠে নিজেদের কর্তৃত্ব রাখার পথ সুগম হয়েছিল।
আইয়ুব খানের বিচিত্র সৃষ্টি মৌলিক গণতন্ত্রীরাই তৎকালীন দুই পাকিস্তানে ভোট দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি এবং পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আইয়ুব খানের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। এতে ভীষণ রকম খেপে গিয়েছিলেন আইয়ুবশাহি। করাচির বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ইত্যাদি চালানো হয়েছিল স্বয়ং আইয়ুব খানের ছেলে গওহর আইয়ুবের নেতৃত্বে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার জনকও বোধ হয় আইয়ুব খান। খুবই অবাক করা বিষয় হলো, এই নির্বাচনে মিস ফাতেমা জিন্নাহর হয়ে ন্যাপের পক্ষ থেকে মাওলানা ভাসানীর প্রচারণা চালানোর কথা ছিল উত্তরবঙ্গে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হয়েছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামে। কেন আওয়ামী লীগকে পূর্ববঙ্গের দুটো বিভাগে প্রচারণা চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এ নিয়ে ভাসানী সাহেবের দলের আপত্তি ছিল। তাই তিনি একবারের জন্যও উত্তরবঙ্গে গিয়ে মিস ফাতেমা জিন্নাহর হয়ে ভোট চাননি। এতে আইয়ুব খানের সঙ্গে মাওলানা ভাসানীর কোনো আঁতাত হয়েছিল কি না, তা নিয়ে একধরনের জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় যদি সম্মিলিত বিরোধী দলের ঐক্য বজায় থাকত, তাহলে আইয়ুব খানের প্রতি অনাস্থার বিষয়টি সহজেই প্রমাণিত হতে পারত বলে অনেকে মনে করেন। আইয়ুব খানের তৈরি মৌলিক গণতন্ত্রীদের অনেকেই তখন ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দিয়েছিলেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাতে জনগণের ভোট দেওয়ার পথ সুগম হয়। এবার আর মৌলিক গণতন্ত্রীরা ভোট দেননি; বরং সাধারণ জনগণ তার নিজের ভোট প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। ইদানীং কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে সেই নির্বাচনেও কারচুপি হয়েছিল। এই হঠাৎ ‘হয়ে ওঠা’ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচন-পরবর্তীকালে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, এ রকম অভিযোগ কোনো পক্ষ থেকেই করা হয়নি। নির্বাচনের ফলাফল এ রকম হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল এই, জাতি তত দিনে ঠিক করে ফেলেছিল, কে হবে তাদের মূল নেতা। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে ভাসানী ন্যাপ যে দোদুল্যমানতার পরিচয় দিয়েছে, সেখানেও ভাসানী-ইয়াহিয়ার মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন উঠেছিল। আওয়ামী লীগ ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানে ভাসানী ন্যাপের জনপ্রিয়তা ছিল। কেন তারা নির্বাচনে অংশ নিল না, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার।
১৯৭৩ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে কারচুপির বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল বলে লেখালেখি হয়েছে। জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন বিরোধী দলকে এক শর মতো আসন ছেড়ে দিতে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল সংসদে বিরোধীদের প্রায় ঠাঁই নেই বললেই চলে। সে সময় গণতন্ত্র পোক্ত করার একটি সুযোগ সৃষ্টি হতে পারত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে।কিন্তু সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নানা ধরনের অব্যবস্থা, সরকারের পিঠে ছুরি মারার ষড়যন্ত্র ইত্যাদির মিশেলে যে নির্বাচন হয়েছে, তা খুব গণতান্ত্রিক উপায়ে হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। গণতন্ত্র তাতে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতায় ছিলেন ৮২ দিন। এই সময়কালে তিনি দেশের পাকিস্তানীকরণের ক্ষেত্রে যে দুটি বড় কাজ করেছিলেন, তার একটি হলো জেল হত্যা এবং অপরটি হলো ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচার করা যাবে না—এই মর্মে একটি ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তির অধ্যাদেশ জারি করা।
এরপর বেশ কিছু ঘটনার মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল হতে হতে একসময় জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি শেখ মুজিবের মতো তাঁর চারপাশে কোনো ফাঁকফোকর রাখেননি। তিনি সে সময় ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, ছিলেন সেনাপ্রধান, ছিলেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ; অর্থাৎ মোট চারটি গুরুত্বপূর্ণ পথ দখল করে রাখলেন তিনি।
১৯৭৭ সালের মে মাসে তিনি আন্তর্জাতিক অনুমোদনের জন্য একটি গণভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই গণভোটে তিনি পেয়েছিলেন শতকরা ৯৮.৯ ভাগ ভোট। এটা যে স্বয়ং জিয়াউর রহমানের জন্য বিব্রতকর ছিল সে কথা বলার অপেক্ষায় রাখে না। কর্মকর্তাদের বলা হয়েছিল ভোটদাতার সংখ্যা যেন মোট ভোটদাতার শতকরা ৭০ ভাগের বেশি না হয়। কিন্তু অতি উৎসাহী কর্মকর্তারা নিজেদের উৎসাহ এবং দক্ষতা প্রমাণ করার জন্য ভেলকি দেখিয়েছিলেন। শতকরা ৮৮.৫ ভাগ ভোট পড়েছিল এই সুপরিকল্পিত নির্বাচনে।
১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ওসমানীকে দেওয়া হয় ২১.৭ ভাগ ভোট আর জিয়াউর রহমানের ভাগে পড়ে ৭৬.৭ ভাগ ভোট। কারচুপি হয়েছিল কি না, সে কথা না বলে আমরা বরং বলতে পারি ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছিল বিকেল ৫টায়, আর কেরানীগঞ্জের একটি ভোটকেন্দ্রের ফলাফল বেতারে প্রচারিত হয়েছিল সাড়ে ৫টার আগেই।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, তিনি যে গণভোটের আয়োজন করেছিলেন, তার সঙ্গে আইয়ুব খানের নির্বাচনী মেজাজের বেশ মিল আছে। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি আইয়ুব খানের দেখানো পথ ধরে হেঁটেছেন। শেখ মুজিবের সমাজবাদী অর্থনীতির জায়গায় তিনি ব্যক্তিমালিকানা বা ফ্রি এন্টারপ্রাইজের জয়গান করলেন।
এরশাদ আমলের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার কোনো মানে নেই। এরশাদ তাঁর স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা এমনভাবে চালিয়েছিলেন যে তাঁর আমলে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
এরশাদ-পরবর্তী গণতন্ত্রের যুগে বিএনপি আমলের একটি নির্বাচনের উল্লেখ করাই যথেষ্ট। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই নির্বাচন প্রমাণ করেছে, কারচুপির সুযোগ পেলে বিএনপি তা হাতছাড়া করে না। সেই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২১ শতাংশ। বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে ২৭৮টি আসন লাভ করেছিল। আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করেছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের নির্বাচনগুলোই বরং অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি যে নির্বাচনী পরিকল্পনা করেছিল, তাতে এই ব্যবস্থায় সত্যিই আর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। এরপর ক্ষমতায় থেকে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচন করেছিল, সেই নির্বাচনকেও প্রহসনের নির্বাচন বললে অত্যুক্তি হবে না।
২. নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজন রয়েছে। বিগত সময়ে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করে তুলতে পেরেছি বলে মনে হয় না। জোর যার মুল্লুক তার—এই প্রবাদবাক্যই হয়ে উঠেছে আমাদের গণতন্ত্রের একধরনের সংজ্ঞা। তাই মুখে যতই গণতন্ত্রের বুলি কপচানো হোক না কেন, আদতে আমাদের দলের মধ্যেই গণতন্ত্র নেই, তাই ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্রের লালন-পালন করার যে স্বপ্ন দেখা হয়, তার মধ্যে সত্য রয়েছে কম।
এ রকম একটা বাস্তবতা নিয়েই বারবার নির্বাচন আসে। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়, তারা প্রত্যেকেই জয়ী হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে। যে দল পরাজিত হয়, সেই দল অবধারিতভাবেই নির্বাচনে কারচুপির কথা বলে। যে দল জয়ী হয় তারা বলে যে জনতার জয় হয়েছে।এর ব্যত্যয় ঘটে না।
রাজনীতি যখন থেকে আখের গোছানোর বড় মাধ্যম হয়ে পড়েছে, তখন থেকে রাজনীতির মাধ্যমে জনসেবা নয়, নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দিকেই মন দিয়েছেন জননেতারা। ফলে আত্মত্যাগী নেতারা রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ধীরে ধীরে নির্বাসিত হয়েছেন এবং তাঁদের জায়গায় উঠে এসেছেন সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী এবং পেশিশক্তির অধিকারীরা। এ রকম একটা জায়গায় যখন রাজনীতি এসে দাঁড়ায়, তখন সুষ্ঠু নির্বাচন তার গুরুত্ব হারায়।
শুধু ভোটের ব্যাপারেই চিন্তা-ভাবনা না করে নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময় দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কীভাবে জনকল্যাণে ব্যয় করা যাবে—সেটা নিয়েই আলোচনায় বসা দরকার।
খেয়াল করলেই দেখা যাবে, দেশ আজ নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছে। যে নেতাদের পেছনে একসময় দাঁড়াত মানুষ, তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন কিংবা রাজনৈতিকভাবে আর ততটা সক্রিয় নন। নতুন যাঁরা নেতৃত্ব উঠে এসেছেন, তাঁরা কতটা জনসম্পৃক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাই একদলকে ক্ষমতাচ্যুত করে আরেক দল ক্ষমতায় এলে জনগণের খুব লাভ হবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।
এই যে রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্ধকারের অতলান্ত দেখতে পাচ্ছি আমরা, তা থেকে মুক্ত হতে হলে যে রাজনীতির প্রয়োজন, সেই রাজনীতির সন্ধান আমরা কবে পেতে পারি, সে আশঙ্কা এখনো কাটেনি।
গণতন্ত্রমনা হওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি থাকা দরকার, তার কোনো চর্চা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। তাই সামনে যে নির্বাচন আসছে, তাতে কোন দল অংশ নিল আর কোন দল নিল না, কোন দল নির্বাচনে জয়ী হলো আর কোন দল হলো না, সেটা সাধারণ মানুষের জীবনে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। গণতন্ত্রের চর্চা শুধু মুখে মুখে থাকলে দেশের জনগণ তাতে উপকৃত হবে না।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আমাদের দেশে নির্বাচনী মাঠে প্রতিপক্ষকে দমননিপীড়ন করার ঐতিহ্য আজকের নয়। আইয়ুব খানের আমল থেকে ধরলে দেখা যায়, ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বিরোধীপক্ষের কর্মীদের তুমুলভাবে দমননিপীড়ন করা হয়েছিল। তাতে ভোটের মাঠে নিজেদের কর্তৃত্ব রাখার পথ সুগম হয়েছিল।
আইয়ুব খানের বিচিত্র সৃষ্টি মৌলিক গণতন্ত্রীরাই তৎকালীন দুই পাকিস্তানে ভোট দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি এবং পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আইয়ুব খানের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। এতে ভীষণ রকম খেপে গিয়েছিলেন আইয়ুবশাহি। করাচির বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ইত্যাদি চালানো হয়েছিল স্বয়ং আইয়ুব খানের ছেলে গওহর আইয়ুবের নেতৃত্বে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার জনকও বোধ হয় আইয়ুব খান। খুবই অবাক করা বিষয় হলো, এই নির্বাচনে মিস ফাতেমা জিন্নাহর হয়ে ন্যাপের পক্ষ থেকে মাওলানা ভাসানীর প্রচারণা চালানোর কথা ছিল উত্তরবঙ্গে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হয়েছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামে। কেন আওয়ামী লীগকে পূর্ববঙ্গের দুটো বিভাগে প্রচারণা চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এ নিয়ে ভাসানী সাহেবের দলের আপত্তি ছিল। তাই তিনি একবারের জন্যও উত্তরবঙ্গে গিয়ে মিস ফাতেমা জিন্নাহর হয়ে ভোট চাননি। এতে আইয়ুব খানের সঙ্গে মাওলানা ভাসানীর কোনো আঁতাত হয়েছিল কি না, তা নিয়ে একধরনের জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় যদি সম্মিলিত বিরোধী দলের ঐক্য বজায় থাকত, তাহলে আইয়ুব খানের প্রতি অনাস্থার বিষয়টি সহজেই প্রমাণিত হতে পারত বলে অনেকে মনে করেন। আইয়ুব খানের তৈরি মৌলিক গণতন্ত্রীদের অনেকেই তখন ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দিয়েছিলেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাতে জনগণের ভোট দেওয়ার পথ সুগম হয়। এবার আর মৌলিক গণতন্ত্রীরা ভোট দেননি; বরং সাধারণ জনগণ তার নিজের ভোট প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। ইদানীং কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে সেই নির্বাচনেও কারচুপি হয়েছিল। এই হঠাৎ ‘হয়ে ওঠা’ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচন-পরবর্তীকালে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, এ রকম অভিযোগ কোনো পক্ষ থেকেই করা হয়নি। নির্বাচনের ফলাফল এ রকম হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল এই, জাতি তত দিনে ঠিক করে ফেলেছিল, কে হবে তাদের মূল নেতা। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে ভাসানী ন্যাপ যে দোদুল্যমানতার পরিচয় দিয়েছে, সেখানেও ভাসানী-ইয়াহিয়ার মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন উঠেছিল। আওয়ামী লীগ ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানে ভাসানী ন্যাপের জনপ্রিয়তা ছিল। কেন তারা নির্বাচনে অংশ নিল না, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার।
১৯৭৩ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে কারচুপির বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল বলে লেখালেখি হয়েছে। জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন বিরোধী দলকে এক শর মতো আসন ছেড়ে দিতে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল সংসদে বিরোধীদের প্রায় ঠাঁই নেই বললেই চলে। সে সময় গণতন্ত্র পোক্ত করার একটি সুযোগ সৃষ্টি হতে পারত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে।কিন্তু সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নানা ধরনের অব্যবস্থা, সরকারের পিঠে ছুরি মারার ষড়যন্ত্র ইত্যাদির মিশেলে যে নির্বাচন হয়েছে, তা খুব গণতান্ত্রিক উপায়ে হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। গণতন্ত্র তাতে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতায় ছিলেন ৮২ দিন। এই সময়কালে তিনি দেশের পাকিস্তানীকরণের ক্ষেত্রে যে দুটি বড় কাজ করেছিলেন, তার একটি হলো জেল হত্যা এবং অপরটি হলো ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচার করা যাবে না—এই মর্মে একটি ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তির অধ্যাদেশ জারি করা।
এরপর বেশ কিছু ঘটনার মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল হতে হতে একসময় জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি শেখ মুজিবের মতো তাঁর চারপাশে কোনো ফাঁকফোকর রাখেননি। তিনি সে সময় ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, ছিলেন সেনাপ্রধান, ছিলেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ; অর্থাৎ মোট চারটি গুরুত্বপূর্ণ পথ দখল করে রাখলেন তিনি।
১৯৭৭ সালের মে মাসে তিনি আন্তর্জাতিক অনুমোদনের জন্য একটি গণভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই গণভোটে তিনি পেয়েছিলেন শতকরা ৯৮.৯ ভাগ ভোট। এটা যে স্বয়ং জিয়াউর রহমানের জন্য বিব্রতকর ছিল সে কথা বলার অপেক্ষায় রাখে না। কর্মকর্তাদের বলা হয়েছিল ভোটদাতার সংখ্যা যেন মোট ভোটদাতার শতকরা ৭০ ভাগের বেশি না হয়। কিন্তু অতি উৎসাহী কর্মকর্তারা নিজেদের উৎসাহ এবং দক্ষতা প্রমাণ করার জন্য ভেলকি দেখিয়েছিলেন। শতকরা ৮৮.৫ ভাগ ভোট পড়েছিল এই সুপরিকল্পিত নির্বাচনে।
১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ওসমানীকে দেওয়া হয় ২১.৭ ভাগ ভোট আর জিয়াউর রহমানের ভাগে পড়ে ৭৬.৭ ভাগ ভোট। কারচুপি হয়েছিল কি না, সে কথা না বলে আমরা বরং বলতে পারি ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছিল বিকেল ৫টায়, আর কেরানীগঞ্জের একটি ভোটকেন্দ্রের ফলাফল বেতারে প্রচারিত হয়েছিল সাড়ে ৫টার আগেই।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, তিনি যে গণভোটের আয়োজন করেছিলেন, তার সঙ্গে আইয়ুব খানের নির্বাচনী মেজাজের বেশ মিল আছে। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি আইয়ুব খানের দেখানো পথ ধরে হেঁটেছেন। শেখ মুজিবের সমাজবাদী অর্থনীতির জায়গায় তিনি ব্যক্তিমালিকানা বা ফ্রি এন্টারপ্রাইজের জয়গান করলেন।
এরশাদ আমলের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার কোনো মানে নেই। এরশাদ তাঁর স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা এমনভাবে চালিয়েছিলেন যে তাঁর আমলে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
এরশাদ-পরবর্তী গণতন্ত্রের যুগে বিএনপি আমলের একটি নির্বাচনের উল্লেখ করাই যথেষ্ট। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই নির্বাচন প্রমাণ করেছে, কারচুপির সুযোগ পেলে বিএনপি তা হাতছাড়া করে না। সেই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২১ শতাংশ। বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে ২৭৮টি আসন লাভ করেছিল। আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করেছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের নির্বাচনগুলোই বরং অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি যে নির্বাচনী পরিকল্পনা করেছিল, তাতে এই ব্যবস্থায় সত্যিই আর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। এরপর ক্ষমতায় থেকে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচন করেছিল, সেই নির্বাচনকেও প্রহসনের নির্বাচন বললে অত্যুক্তি হবে না।
২. নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজন রয়েছে। বিগত সময়ে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করে তুলতে পেরেছি বলে মনে হয় না। জোর যার মুল্লুক তার—এই প্রবাদবাক্যই হয়ে উঠেছে আমাদের গণতন্ত্রের একধরনের সংজ্ঞা। তাই মুখে যতই গণতন্ত্রের বুলি কপচানো হোক না কেন, আদতে আমাদের দলের মধ্যেই গণতন্ত্র নেই, তাই ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্রের লালন-পালন করার যে স্বপ্ন দেখা হয়, তার মধ্যে সত্য রয়েছে কম।
এ রকম একটা বাস্তবতা নিয়েই বারবার নির্বাচন আসে। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়, তারা প্রত্যেকেই জয়ী হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে। যে দল পরাজিত হয়, সেই দল অবধারিতভাবেই নির্বাচনে কারচুপির কথা বলে। যে দল জয়ী হয় তারা বলে যে জনতার জয় হয়েছে।এর ব্যত্যয় ঘটে না।
রাজনীতি যখন থেকে আখের গোছানোর বড় মাধ্যম হয়ে পড়েছে, তখন থেকে রাজনীতির মাধ্যমে জনসেবা নয়, নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দিকেই মন দিয়েছেন জননেতারা। ফলে আত্মত্যাগী নেতারা রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ধীরে ধীরে নির্বাসিত হয়েছেন এবং তাঁদের জায়গায় উঠে এসেছেন সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী এবং পেশিশক্তির অধিকারীরা। এ রকম একটা জায়গায় যখন রাজনীতি এসে দাঁড়ায়, তখন সুষ্ঠু নির্বাচন তার গুরুত্ব হারায়।
শুধু ভোটের ব্যাপারেই চিন্তা-ভাবনা না করে নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময় দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কীভাবে জনকল্যাণে ব্যয় করা যাবে—সেটা নিয়েই আলোচনায় বসা দরকার।
খেয়াল করলেই দেখা যাবে, দেশ আজ নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছে। যে নেতাদের পেছনে একসময় দাঁড়াত মানুষ, তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন কিংবা রাজনৈতিকভাবে আর ততটা সক্রিয় নন। নতুন যাঁরা নেতৃত্ব উঠে এসেছেন, তাঁরা কতটা জনসম্পৃক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাই একদলকে ক্ষমতাচ্যুত করে আরেক দল ক্ষমতায় এলে জনগণের খুব লাভ হবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।
এই যে রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্ধকারের অতলান্ত দেখতে পাচ্ছি আমরা, তা থেকে মুক্ত হতে হলে যে রাজনীতির প্রয়োজন, সেই রাজনীতির সন্ধান আমরা কবে পেতে পারি, সে আশঙ্কা এখনো কাটেনি।
গণতন্ত্রমনা হওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি থাকা দরকার, তার কোনো চর্চা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। তাই সামনে যে নির্বাচন আসছে, তাতে কোন দল অংশ নিল আর কোন দল নিল না, কোন দল নির্বাচনে জয়ী হলো আর কোন দল হলো না, সেটা সাধারণ মানুষের জীবনে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। গণতন্ত্রের চর্চা শুধু মুখে মুখে থাকলে দেশের জনগণ তাতে উপকৃত হবে না।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪দেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২০ নভেম্বর ২০২৪আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪