শব্দের আড়ালে গল্প: মুদ্রাদোষ

রাজীব কুমার সাহা
আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৪, ১১: ০০
Thumbnail image

অর্থ প্রকাশক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে আমরা বলি শব্দ। শব্দ হলো ভাষার প্রাণ। যে ভাষার শব্দভান্ডার যত বেশি সমৃদ্ধ, সেই ভাষা তত বেশি উন্নত। আর ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের সংগ্রহমূলক গ্রন্থ হলো অভিধান। আমরা অভিধানে শব্দের একটি অর্থ যেমন পাই, তেমনি একটি শব্দের একাধিক অর্থও পাই। শব্দের অর্থ সব সময় একই রকম থাকে না। কালের পরিক্রমায় একটি শব্দ একাধিক নতুন নতুন অর্থ পরিগ্রহ করে। ভুক্তি শব্দের সঙ্গে অর্থের সব সময় যে মিল থাকে, এমনটিও নয়। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারে ভুক্তি শব্দের কখনো আক্ষরিক আবার কখনো আলংকারিক অর্থ প্রধান হয়ে ওঠে। আর এসব অর্থের ঠাঁই হয় অভিধানে। এ জন্যই অভিধান হলো শব্দের রহস্যঘেরা এক বিস্ময়কর জগৎ। এতে অবগাহন করে নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে শব্দের মণিমুক্তা কুড়াতে হয়। ভুক্তি শব্দের সঙ্গে অর্থ গঠনের যে বোঝাপড়া তার পেছনে কাজ করে মানুষের বহু বিচিত্র সব চিন্তাভাবনা। এ সূত্র ধরেই আমরা ধারাবাহিকভাবে জানব কোনো শব্দ বা শব্দবন্ধের অর্থের গল্প।বাংলা ভাষার একটি অতি পরিচিত শব্দ হলো মুদ্রাদোষ। পরিস্থিতির প্রসঙ্গ অনুসারে কমবেশি আমরা সবাই শব্দটি আমাদের যাপিত জীবনে প্রয়োগ করেছি। মুদ্রা শব্দের একাধিক অর্থ থাকা সত্ত্বেও সাধারণত মুদ্রা শব্দটি শুনলে টাকা-পয়সার বিষয়টিই প্রথমে মনে হয়। তাহলে মুদ্রাদোষ মানে কী? টাকা-পয়সা চুরি করার কোনো বাতিক, নাকি প্রচলিত মুদ্রার কোনো ত্রুটি? নাকি অন্য কোনো অর্থে শব্দটি প্রযুক্ত হয়? তবে চলুন আজ জানব মুদ্রাদোষের আদ্যোপান্ত।

‘মুদ্রা’ ও ‘দোষ’ শব্দসহযোগে মুদ্রাদোষ শব্দটি গঠিত। মুদ্রাদোষ বিশেষ্য পদ। ‘মুদ্রা’ শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে; অর্থগুলো হলো তামা, নিকেল, রুপা প্রভৃতি ধাতুর তৈরি খুচরা টাকা-পয়সা; অর্থ; সিলমোহর; ছাপ; নাচের অঙ্গভঙ্গি; উপাসনা বা নৃত্যে হাতের আঙুলের ভঙ্গি প্রভৃতি। প্রাপ্ত অর্থগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মুদ্রাদোষ শব্দে বর্ণিত ‘মুদ্রা’ শব্দটির অর্থ হলো বাচনভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি, বিশেষ চিহ্ন প্রভৃতি।

সাধারণভাবে মুদ্রাদোষ হলো কোনো ব্যক্তির বাচনভঙ্গি, আচরণ বা স্বভাবে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের পৌনঃপুনিক বহিঃপ্রকাশ। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘ইডিওসিনক্রেসি’।

এবার সবিস্তারে বলি। ব্যক্তিবিশেষে কারও কারও কোনো কোনো স্বভাব বা বিশিষ্ট অঙ্গভঙ্গি থাকে, যার কোনো নির্দিষ্ট কারণ বা যুক্তি নেই, এমনকি উপযোগিতাও নেই। কিন্তু তাঁরা সেই অঙ্গভঙ্গি অভ্যাসবশত বারবার করতে থাকেন। এটিই হলো দোষ। এ প্রসঙ্গে, দোষ শব্দের ভাবার্থ হবে ত্রুটি বা ‘ডিফল্ট’। যদি এর কোনো ক্ষতিকারক প্রভাব থাকে, তখন তাকে আমরা বদভ্যাস বলি। অন্যথা তা মুদ্রাদোষ। বলতে পারি ত্রুটিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি। যেমন কেউ চিন্তা করার সময় মাথার চুলে বারবার হাত বোলাতে থাকেন, কেউ কথা বলার সময় ক্রমাগত হাতে হাত ঘষা বা পা নাচাতে থাকেন, কেউ দাঁত দিয়ে ক্রমাগত নখ কাটতে থাকেন, কেউ কথা বলার সময় অস্বাভাবিকভাবে চোখ পিটপিট করতে থাকেন, আবার কেউ কেউ বারবার জিভ বের করে ঠোঁট বা গোঁফে লাগাতে থাকেন, কারও কারও আবার ভ্রু কোঁচকানো বা টানার প্রবণতা রয়েছে, এমনকি কেউ কেউ কথা বলার সময় মুখ এমন পরিমাণ কোঁচকায় মনে হয় যেন প্রচণ্ড ব্যথা লাগছে—প্রভৃতি হলো প্রচলিত অঙ্গভঙ্গিগত মুদ্রাদোষ।

আবার সবার কথা বলার ধরন বা বাচনভঙ্গি এক রকম নয়। প্রায় প্রত্যেকের কথা বলার একটি নিজস্ব মুদ্রা বা ধরন রয়েছে। আবার আমাদের প্রায় সবারই বাচনিক জীবনে কোনো না কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছের প্রতি পক্ষপাত থাকে। দৈনন্দিন কথাবার্তায় অনেকের বাগ্বিন্যাসে কিছু কিছু শব্দ-প্রক্ষেপের অভ্যাস থাকে। সেই নির্দিষ্ট শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের মাত্রাটা কথা বলায় খুব বেশি হলে বক্তা আরাম পেলেও শ্রোতার তাতে শান্তি হারাম হয়ে যায়। এগুলোই হলো ‘মুদ্রাদোষ’। যেমন ভাই, শালা, ধরো, মনে করো, আমার, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রভৃতি বহুল ব্যবহৃত মুদ্রাদোষ। মূলত এসব মুদ্রা বা বাচনভঙ্গির অতিমাত্রায় ব্যবহার অন্যের কাছে হাস্যকর বা দূষণীয় মনে হয়।

মূলত ব্যক্তিবিশেষের বিভিন্ন বাচনভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি, আচরণ, চালচলন কিংবা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের শ্রুতি বা দৃষ্টিকটু এমন আচরণের পুনরাবৃত্তিই হলো মুদ্রাদোষ। সাধারণত দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, গ্লানি, উত্তেজনা, উচ্ছ্বাস প্রভৃতির ভাবাবেগ হলে মুদ্রাদোষের পরিমাণ বেড়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ দোষটি আঠারো বছর বয়সের আগেই শুরু হয়। তবে যথাসময়ে সতর্কতা অবলম্বন করলে অনেক ক্ষেত্রে এ দোষ সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়।

লেখক: রাজীব কুমার সাহা, আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত