Ajker Patrika

স্মৃতি সতত সুখকর এবং সুখময়

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
স্মৃতি সতত সুখকর এবং সুখময়

আজকের পত্রিকা ৩ বছর পেরিয়ে এল। এর মধ্যেই পত্রিকাটি পাঠকদের মনে ঠাঁই করে নিতে পেরেছে। দেশে পত্রপত্রিকার সংখ্যা কম নয়। এর মধ্যে নতুন কাগজ বাজারে এসে জায়গা করে নিতে পারাটা কম কথা নয়। আজকের পত্রিকার সাফল্য কামনা করে আজ আমি বদলে যাওয়া ঢাকা নিয়ে এই লেখাটি লিখছি। 

আপনি কি ফেরত যেতে চাইবেন সেই অত্যাশ্চর্য শহরে, যেখানে এক পয়সায় একটা বাকরখানি ও বারো আনায় এক শ ডিম পাওয়া যেত, এক টাকার বাজার করলে ঝাঁকা উপচে পড়ত? না, আমি চাই না। চাইব না। আমি জানি, আপনিও চাইবেন না। অনেক কষ্টে ওখান থেকে এখানে এসেছি, বেড়াতে যেতে চাইতে পারি, ফেরত যাব না, ভয় আছে ফেরত গেলে আর উঠে আসতে পারব না। নবদ্বীপ বসাক লেন কিংবা আবদুল আজিজ লেনের ঐতিহ্যবাহী অন্ধকার বন্ধুর মতো জাপটে ধরবে, আসতে দেবে না। সেবার পেরেছিলাম, এবার হয়তো পারব না, ওখানেই রয়ে যাব। দুর্বিষহ। 

আমার প্রয়াত সহপাঠী আবিদ হুসেন বিলেতে থাকত, চার দশক আগে বলেছিল কথাটা। ‘দোস্ত, পুরান ঢাকাতে কি মানুষ থাকে না? যাকে জিজ্ঞেস করি সেই বলে ধানমন্ডি, নয়তো গুলশান। হলো কী?’ আজ জীবিত থাকলে আবিদ কী বলত কে জানে। কী হয়েছে, জানি আমরা। চলে এসেছি, যারা পারেনি তারাই পড়ে রয়েছে, নিতান্ত বাধ্য হয়ে। পারলে আমরা দূরে যাই, বিদেশে, আরও বড় শহরে। আমাকে বলছেন ফেরত যেতে! 

স্মৃতি সতত সুখকর এবং সুখময়। চালনির মতো, ভাঙাগুলো ফেলে দেয়, আস্তগুলো ধরে রাখে। নইলে ছাপ্পান্ন বছর আগের ঢাকা শহর বাস্তবে মোটেই রোমান্টিক ছিল না, ধারেকাছে নয়। ছাদপেটার গানই বলুন কিংবা কাওয়ালি, অথবা হিজড়াদের নৃত্য—তাতে উচ্চ সাংস্কৃতিক মানের পরিচয় মেলে না। ঘোড়ার গাড়িতে বন্ধ দশায় চলাচলের বিরুদ্ধে বলার জন্য বেগম রোকেয়ার দরকার হবে না, যে কেউ বলবে। আমাদের মেয়েরা, গৃহিণীরা কেউ রাজি হবে না। আমার মা-ও নন। বলবেন, আবারও? কবি নবীন সেন অতিশয় নোংরা এক শহর দেখে গেছেন ঢাকায় এসে। বীভৎস। মাইকেল মধুসূদনও খুশি হননি। অনেক পরের মানুষ আবু জাফর শামসুদ্দীন, তিনিও উৎফুল্ল ছিলেন না, যখন ঢাকায় ছিলেন, কিশোরকালে। বুদ্ধদেব বসু? হ্যাঁ, কিন্তু সে ঢাকা তো ঢাকা নয়, যেকোনো শহর। নোয়াখালী হতে পারত, রাজশাহী হলেও অসুবিধে নেই। সে থাকে মনের ভেতর, বন্ধুদের সান্নিধ্যে, বইপত্রের বাৎসল্যে, রয়েছে অনুভবে, কল্পনায়, তাকে বাস্তবে খুঁজতে নেই। হ্যাঁ, এক পয়সায় বাকরখানি পাওয়া যেত ঠিকই, কিন্তু ওই এক পয়সা জোটানোও কঠিন ছিল অনেকের পক্ষে; ডিম অনেকেই খেত না। দুর্লভ ছিল। 

আমি ঢাকারই ছেলে। বাবার সঙ্গে মফস্বলে ঘুরেফিরে কলকাতা হয়ে ঢাকায় এসেছিলাম একদিন। সেই বাল্যকালে। না, রোমাঞ্চিত হইনি মোটেই। বড় স্তিমিত মনে হয়েছিল এই শহরকে, ধুলোয় আকীর্ণ। মশা ডেকেছে, বাতি জ্বলেনি। বাসা পাওয়া যায়নি। আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম। তবু কপাল ভালো আমাদের, সে বাড়িতে বড় দুটো কামরা ছিল, খোলামেলা একটা উঠান ছিল। অনেকে অতটুকুও পাননি। 

নদীর ওই পারে বাড়ি আমাদের। পিতৃপুরুষের। কিন্তু আমার পিতাকে শুনিনি আগে কখনো ঢাকায় এসেছেন বলতে। না, আসেননি। আসতেন না। তাঁরা যেতেন কলকাতায়। স্টিমারে চেপে, ট্রেনে চড়ে। চাকরি বলুন, ব্যবসা বলুন, কিংবা লেখাপড়া—সবই তো কলকাতায়। সেখানে মেসে থাকা যায়, আত্মীয়স্বজন সাহায্য ও আশ্রয় দেয়। ঢাকায় কে আসে তখন? আসার রাস্তাও ছিল না। চারদিকে পানি তার। লঞ্চ পর্যন্ত ছিল না, ছিল গয়নার নৌকা। একবারই চেপেছিলাম তাতে আমি, কাকার সঙ্গে, দেখার জন্য। ওই দেখাই শেষ দেখা আমার, দ্বিতীয়বার ওমুখো হওয়ার সাহস হয়নি। ভয়ংকর। ওসব স্মৃতি রোমাঞ্চিত করে না। মানবিক প্রত্নতত্ত্ব মানবিক নয়, অধিকাংশ সময়ে। 

কী ছিল ঢাকা শহরে, যা নিয়ে বুক ফুলানো যেতে পারে? আহসান মঞ্জিল? সে তো আমার নয়। রেসকোর্সের মাঠ? সে তো গরিব মানুষকে ফতুর করার বড়লোকি ষড়যন্ত্র। জন্মাষ্টমীর মিছিল? যেটুকু বুঝেছি, সে তো স্থূলতার চলমানতা। থিয়েটার? ভদ্রলোকেরা যেতেন না। ভদ্রলোকেরা ছিলেন অবশ্যই। শিক্ষাজীবন ছিল একটা। কিন্তু আদি বাসিন্দা যাঁরা, খান্দান, বাকরখানি ও শামি কাবাবের সনাতন সেবক তাঁদের জন্য নয়, অন্যদের জন্য। অন্যরা ছিলেন, চাকরিবাকরি করতেন, ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু কিছু ছিল। আর ছিলেন পেশাজীবীরা; শিক্ষক, চিকিৎসক, উকিল-মোক্তাররা। তাঁরা বাড়ি করেছেন। থেকেছেন। কিন্তু আলো দিয়ে উজ্জ্বল করে তুলতে পারেননি এই শহরকে। হারিকেনের টিমটিমে বাতি দাঁড়িয়ে ছিল আদিম অন্ধকারের পথে পথে সঞ্চয় সম্মুখযাত্রা বিপক্ষে। তাতে অন্ধকার দূর হয়নি, পড়ার টেবিলটা কিছুটা উজ্জ্বল হয়েছে শুধু। সঙ্গে বিপক্ষে চলতে হয়েছে তাকে, ওই হারিকেনকে। অন্ধকার অন্ধকারই রয়ে গেল। বিশাল ও বিপুল। 

চুয়াত্তর বছর আগে বিজলি বাতি তেমন ছিল না। ওই হারিকেনই সম্বল ছিল। অথবা আরও জনপ্রিয় সেই কুপি। ঢাকার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে জাদুঘরে সেমিনার হচ্ছে, তাতে বক্তাদের একজন সুন্দর কথা বলেছেন। তখন লোকে ভয় পেত রাত নয়টায় রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত দেখে, এখন ভয় পায় লোকের আধিক্য দেখে। ওই ভয়টাই সত্য, আর সব মিথ্যা। ঢাকা হচ্ছে সন্ত্রস্ত শহর, তখনো ছিল, এখনো আছে। নাগরিক জীবনের প্রধান গুণই হচ্ছে অবাধে চলাফেরা করার সুযোগ ও স্বাধীনতা। ঢাকাতে সেটা নেই। একসময়ে মুড়ির টিনের বাস ছিল, এখন দোতলা বাস এসেছে কিছু কিছু, মেট্রোরেল এসেছে, কিন্তু ওই যে ঢাকা দৌড় দিয়েছে নানা দিকে, আদতে দক্ষিণপন্থী এই শহর; কিন্তু উত্তর দিকে সে ছুটেছে, পৌঁছে গেছে উত্তরায় এবং তারও পরে। সেসব জায়গা থেকে আপনি যে সদরঘাটে একটানা, নির্বিঘ্নে ও অল্প সময়ে পৌঁছাবেন, তার কোনো ব্যবস্থাই নেই। জনসংখ্যায় এই শহর পৃথিবীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কিন্তু যানবাহনে? এত রিকশা কোনো শহরে পাবেন আপনি? কিন্তু তবু ভাগ্যিস রিকশা ছিল, নইলে কিসে যাতায়াত করতেন? উন্নতি? হ্যাঁ, ওইটুকুই, ঘোড়ার গাড়ির বদলে রিকশা। আগে ঘোড়ায় টানত, এখন মানুষে টানে। মানুষের দাম কমেছে কি বেড়েছে, হিসাব করুন। পঞ্চাশের দশকের শেষে ষাটের দশকের শুরুতে আমার বন্ধু মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ ‘পূবালী’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, তাতে ‘ঢাকায় থাকি’ নামে কটুকাটব্যের একটি লেখা লিখতাম, লেখকের নাম ছিল নাগরিক। 

‘পূবালী’ নামের পত্রিকায় নাগরিকের অভ্যুদয়-ব্যাপারটায় অসংগতি ছিল এবং সেই সময়ে তরুণ লেখকদের একটি গোষ্ঠী, যারা বিদ্রোহী ছিল কিসের বিরুদ্ধে ঠিক মনে নেই, তবে ‘পূবালীর’ নাগরিক সম্বন্ধে তাদের একজন মন্তব্য করেছিল যে এর পা-ভরা ধানখেতের এঁটেল মাটির উৎপাত, সেটা মনে আছে। বড় সংগত মনে হয়েছিল সেই মন্তব্য। তবে বললে ঠিক হতো যে মাটিটা ধানখেতের নয়, নর্দমার। এখনো সেই নোংরা কাদাই আমাদের পায়ে, রেহাই পাব কী করে?

এখনো, এই যে এত দিন চলে গেল, সময় বহিয়া গেল, স্বাধীন হওয়ার মাশা আল্লাহ পার হলাম পাঁচ দশক, এখনো নিশ্চিত নই আমি নাগরিক হয়েছি কি হইনি এই বিষয়ে। ঢাকার নগর কোথায়? গ্রাম রয়েছে কতকগুলো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন, স্তিমিত, অপরিকল্পিত। বাতি জ্বলে না নিয়মিত, না রাস্তায়, না মনের ভেতরে। মশামাছি ভিক্ষুকদের ছাড়িয়ে যায়—ঘ্যান-ঘ্যানানিতে। ভিক্ষা নয়, রক্ত চায়। দুর্গন্ধ স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে যেখানে-সেখানে, আবর্জনার আকারে। পানি আসে না, রাস্তা নেই; নিষ্কাশন তথৈবচ। আর নিরাপত্তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ এখন। এই শহরের বর্তমান নারকীয়, ভবিষ্যৎ আরও বেশি। তাই বুঝি অতীতকে সাজাতে হয় সুন্দর করে। মনোহর রূপে। কিন্তু সাজানো বড় কঠিন ভাই, যা-ই বলুন। নিরাপত্তার সূত্র ধরে বলতে হয়, কোথায় আমাদের নাগরিক অধিকার?

লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারতে তোলপাড়

বাংলাদেশের ১৮ বছরের সেই অপেক্ষা তবে ফুরোচ্ছে

খাবারে চেতনানাশক মিশিয়ে সিঁধ কেটে চুরির সময় গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ

জুলাই আন্দোলনের নারীদের সম্মাননা নিয়ে প্রশ্নে যা বলল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর

চোর সন্দেহে যুবককে পিটুনি, প্রতিবাদ করায় দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত