রিলস ও ইনস্টাগ্রামের তোলপাড়!

ড. মো. গোলাম রহমান
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৪, ০৮: ১৭

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছে আজ নতুন মাত্রায় এসে হাজির হয়েছে রিলস। ২০০৪ সালে ফেসবুক ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর পর থেকে ফেসবুকে নানা বিষয় যুক্ত হয়েছে, তবে সেগুলো সাধারণের কাছে সাড়া জাগালেও এমন কোনো বিপ্লবী কাণ্ড বলে মনে হয়নি। ব্যবহারকারীরা নতুন ফিচারগুলো স্বাভাবিকভাবে তাঁদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে রপ্ত করে নিয়েছেন। কিন্তু ইনস্টাগ্রাম এবং রিলস ব্যাপকভাবে তোলপাড় করে তুলেছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের।

ইনস্টাগ্রাম ও রিলস আজকের মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের কাছে এক অপার আনন্দের নাম। তাঁরা মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করতে ভুলে যাচ্ছেন। মেইল চেক করা কিংবা প্রয়োজনীয় ফোন করতে গিয়ে রিলসে নজর পড়তেই দেখা শুরু করে দিচ্ছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় দ্রুত যোগাযোগ স্থাপনের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আজকের প্রযুক্তিবান্ধব মানুষ কাজকর্মের এক নতুন বলয় সৃষ্টি করে চলেছেন।

২০০৪ সালে মার্ক জাকারবার্গ এবং তাঁর চার সহপাঠীকে নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালানোর জন্য। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এডুয়ারডো সাভেরিন, অ্যান্ড্রিউ ম্যাককলাম, ক্রিস হিউস এবং ডাস্টিন মস্কোভিটজ। এই নেটওয়ার্ক ফেসবুক নামে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই নেটওয়ার্কের ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকে। এটি হার্ভার্ডের ছাত্রদের জন্য সীমিত থাকলেও পরে উত্তর আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যবহার হতে থাকে। এটি এই দশকের সর্ববৃহৎ ব্যবহারকারী মোবাইল অ্যাপ হিসেবে পরিগণিত হয়। ২০১০ সালে এটি সর্ববৃহৎ মোবাইল অ্যাপ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০২৩ সালে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ব্যবহৃত ওয়েবসাইট হিসেবে পরিচিত হয়। ফেসবুক ইন্টারনেটের মাধ্যমে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিচিত-অপরিচিত, ব্যক্তি পর্যায়ে অথবা বিভিন্ন জোটবদ্ধ হয়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

কিন্তু ফেসবুকের শুরুটা খুব সুখকর ছিল না। উইকিপিডিয়া বলছে, জাকারবার্গ এটি চালু করতে গিয়ে বহিষ্কারের মুখে পড়েছিলেন এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্ন হওয়া ও কপিরাইট ভঙ্গের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। প্রচুর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এই ফেসবুক এবং অনেক দেশে ফেসবুক নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন রকম সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। কোনো কোনো দেশে ফেসবুককে আংশিকভাবে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশেও এটি চলার পথে বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে। এমন উদাহরণ রয়েছে সিরিয়া,
চীন ও ইরানে।

রিলস দেখতে হলে মোবাইলের উলম্ব স্ক্রিনে কিংবা ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ডেস্কটপের স্ক্রিনে দেখতে হয়। এটি সাধারণত সর্বোচ্চ ৯০ সেকেন্ড ব্যাপ্তি হয়ে থাকে। এদিকে ইনস্টাগ্রাম একই প্রকৃতির হলেও বিভিন্ন সময়সীমার হয়ে থাকে।

যাঁরা এখনো ফেসবুকে থেকেও রিলস বা ইনস্টাগ্রাম দেখে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি, তাঁরা শুরু করতে পারেন। দেখে বলুন কিংবা ভাবুন, কীভাবে তাঁরা সময়ের ব্যবস্থাপনা করবেন। তবে কেউ কেউ হয়তো রিলস দেখে প্রায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁদের জীবন ও জীবিকায় যথেষ্ট টানাপোড়েন শুরু হয়েছে, তাঁরা কীভাবে সময়কে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারেন, সেসব নিয়ে এখন চিন্তাভাবনার সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার যাঁদের কাছে স্বীকৃত এবং যাঁরা সামাজিক মাধ্যম আজকের দিনে সামাজিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেখছেন, তাঁদের কাছে এসব হচ্ছে নতুন কাজের ক্ষেত্র কিংবা সময়কে ব্যবহার করার জন্য কৌশলমাত্র। একটা সময় আমরা গ্রামগঞ্জে কিংবা শহরেও লোকজনকে তাস খেলতে দেখতাম। কথায় ছিল, ‘যে খেলে তাস, তার হয় সর্বনাশ!’ সমাজে তাস খেলাকে খুব একটা সম্মানীয় বলে দেখা হয় না। কারণ তাসের সঙ্গে জুয়া খেলার একটা সম্পর্ক আছে এবং জুয়া খেলে বহু লোকের সর্বনাশ হয়েছে। সংসার-ধর্ম সব উচ্ছন্নে গেছে অনেক জুয়াড়ির। তাই আমাদের সমাজে এসব বদভ্যাসকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে স্টাটিস্টা ডটকমের এক গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইনস্টাগ্রাম দেখার প্রবণতা এ রকম: ১৩ থেকে ১৭ বছরের ছেলেমেয়েরা শতকরা ৮ ভাগ; ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে প্রায় ৩১ ভাগ; ২৫ থেকে ৩৪ বছরের প্রায় ৩০ ভাগ; ৩৫ থেকে ৪৪ বছরের ১৫ দশমিক ৭ ভাগ; ৪৫ থেকে ৫৪ বছরের প্রায় ৮ দশমিক ৪ ভাগ; ৫৫ থেকে ৬৪ বছরের প্রায় ৪ ভাগ এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ২ দশমিক ৬ ভাগ। ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মানুষের মধ্যে ইনস্টাগ্রাম দেখার প্রবণতা বেশি। বিভিন্ন গবেষণায় সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব নিয়ে নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়।

তরুণ বয়সের নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব প্রায় সমানভাবে বিদ্যমান। ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কের মৌলিক প্রবৃদ্ধি ঘটে থাকে ১০ থেকে ১৯ বছরের বয়সটাতে। এই সময়টাতে বিভিন্ন রকমের ঝুঁকি এবং ভালোমন্দ বোঝার সুযোগ তৈরি হয়। আবার মানসিক স্বাস্থ্য ও ডিপ্রেশনের মতো সমস্যাও এই সময়টাতেই বেশি হয়ে থাকে। এই সময়ে ছেলেমেয়েদের সংবেদনশীলতা ও আবেগ হ্রাস-বৃদ্ধির একটা পরিস্থিতি দেখা যায় এবং মনে ও মস্তিষ্কে বয়ঃসন্ধির মতো জটিলতা ও এ-সংক্রান্ত নানা কিছুর সন্নিবেশ ঘটে।

রিলস দেখে সর্বনাশ ঘটে যাবে—বিষয়টা এমন না। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে সব সমাজেই একধরনের তদারকির ব্যবস্থা চালু আছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করার যে সাবধানতা প্রয়োজন, রিলস বা ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদেরও একই রকম সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। যে কারণে বলা হচ্ছে, শিশু ও তরুণদের মধ্যে ‘রিয়েল ফ্রেন্ড’-এর পরিবর্তে ইদানীং তৈরি হচ্ছে ‘রিলস ফ্রেন্ড’।

যাঁরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের ‘কনটেন্ট’ বা বিষয়বস্তু তৈরি করেন, তাঁরা নিজেদের সৃজনশীলতা এবং প্রতিভা দেখাতে পারেন। তাঁরা আনন্দদায়ক রিলস ও ভিডিও বিশেষ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নানা দিক বিস্তারিতভাবে দেখিয়ে, অনেকগুলো পৃথক ভিডিওতে উপস্থাপন করতে পারেন। বিনোদনমূলক রিলস এবং ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করে তাদের নিজেদের কমিউনিটিতে দেখানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে এবং একটা পর্যায়ে সেটি শুধু সেই কমিউনিটিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বৃহৎ বাজারের পণ্য হয়ে উঠবে।

এসব রিলস এবং ভিডিও বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষামূলক হতে পারে আবার উপদেশমূলকও হতে পারে। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য এবং নির্মাণ কুশলতার কারণে এই সব রিলস এবং ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের ব্যাপক কাজে লাগতে পারে। তবে এসব তৈরির জন্য পড়াশোনা, জ্ঞানের চর্চা থাকা জরুরি। আজকাল বাজার বলতে গেলে বিশ্ব বাজারই বোঝায়। শুধু শখ করে তৈরি নয়, একই সঙ্গে এগুলো আয়-রোজগারের পথ হতে পারে। গণমাধ্যমের কাজ প্রধানত তথ্য দেওয়া, শিক্ষা দেওয়া এবং বিনোদন দেওয়া। তবে আজকাল তথ্য ও শিক্ষার সীমা পেরিয়ে গণমাধ্যম বিনোদনকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে এবং সব গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেই এ কথাগুলো প্রযোজ্য, শুধু রিলস বা ইনস্টাগ্রাম এর ব্যতিক্রম নয়।

ড. মো. গোলাম রহমান, সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত