চিররঞ্জন সরকার
এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ইরানের জেলবন্দী মানবাধিকারকর্মী নারগিস মোহাম্মদি। নারগিস ইরানে খুবই পরিচিত নাম। সারা বিশ্বেই হালে তিনি বেশি করে প্রচার পেয়েছেন। ইরানের এই নারী বহু বছর ধরে মানবাধিকার নিয়ে লড়াই করে চলেছেন। এ জন্য তিনি সীমাহীন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
তিনি আরাম-আয়েশ, শান্তির জীবন বিসর্জন দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন এক প্রতিবাদী জীবন। ধর্মের নামে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া জবরদস্তিমূলক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়েছেন। আর তাতেই তিনি ক্ষমতাসীন মৌলবাদী চক্রের রোষানলে পড়েছেন বারবার।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অদম্য প্রাণশক্তির অধিকারী এক ব্যক্তিত্ব। ইমাম খোমেনি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন নারগিস। সেখানে তিনি পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজে পড়াকালেই তিনি সমতা এবং নারীর অধিকারের পক্ষে একজন বলিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন। পড়াশোনা শেষ করার পরে তিনি প্রকৌশলী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিয়ে প্রকৌশলী হিসেবেই কর্মজীবন শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সংস্কার-মনোভাবাপন্ন সংবাদপত্রের জন্য কলামও লিখেছিলেন।
২০০৩ সালে তিনি তেহরানের ডিফেন্ডারস অব হিউম্যান রাইটস সেন্টারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এটি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শিরিন এবাদির প্রতিষ্ঠা করা একটি সংস্থা। ২০১১ সালে নারগিসকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেই সময়ে কারাবন্দী মানবাধিকারকর্মী ও তাঁদের পরিবারকে সহায়তা করার প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে বহু বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
২০১৩ সালে জামিন পাওয়ার পর নারগিস মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ২০১৫ সালে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারে থাকাকালে তিনি রাজনৈতিক বন্দীদের, বিশেষ করে নারীর বিরুদ্ধে সরকারের পদ্ধতিগত নির্যাতন এবং যৌন হেনস্তার বিরোধিতা করেন।
গত বছর ইরানি নীতি পুলিশের হেফাজতে কুর্দি যুবতী মাহশা আমিনির মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পরই তিনি বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন জানান এবং তাঁর সহবন্দীদের সংগঠিত করেন। তাঁর এই কাজের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। নারগিসের ফোনে কথা বলা এবং ভিজিটরের সঙ্গে দেখা করা বন্ধ করা হয়েছিল। তবু তিনি জেল থেকে একটি নিবন্ধ পাচার করতে সক্ষম হন, যা নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করেছিল মাহশা আমিনির হত্যার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে।
তিনি গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। একই সঙ্গে নারীর অধিকার আদায় ও নারীমুক্তির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার ব্রত নিয়েছেন। তাই তো তিনি অজস্রবার আটক হয়েছেন। চাকরি হারিয়েছেন। রক্ষণশীল ইরানে নারীদের অধিকারের জন্য লড়াই করার কারণে তাঁকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়েছে ১৩ বার। ৫ বার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে ৩১ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। তাঁকে দোররা মারা হয়েছিল ১৫৪ বার। তিনি স্বামী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁরা প্রবাসী। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
ব্যক্তিগত সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আর এ কারণে তাঁর সুখ গেছে, স্বাস্থ্য গেছে, মুক্ত জীবনযাপনের অধিকার গেছে। তবু তিনি লক্ষ্য ও সংকল্প থেকে সরে আসেননি। ইরানের মতো একটি কট্টর ধর্মবাদীদের দেশে তিনি প্রতিবাদের মশাল জ্বালিয়ে পথ চলেছেন।
ইরানের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ডিফেন্ডার্স অব হিউম্যান রাইটস সেন্টার’ দীর্ঘদিন ধরেই ইরানে মানবাধিকার, মূলত নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে। এই সংস্থার সহকারী প্রধান নারগিস। এই সংস্থার প্রধান শিরিন এবাদি ২০০৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।
ইরানের ধর্মীয় মৌলবাদী শাসনে নারীদের অধিকার খর্ব করার অভিযোগ উঠেছে বারবার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশি হেফাজতে সে দেশের তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর হিজাব-বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অভিযোগ ওঠে, সঠিকভাবে হিজাব না পরার জন্যই ‘চরম শাস্তি’ পেতে হয়েছে তাঁকে। এরপরই ইরানজুড়ে চুল কেটে, হিজাব খুলে প্রতিবাদে নামে নারীদের এক বড় অংশ।
ওই সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর অভিযোগও উঠেছিল। তাতে প্রাণ হারান বহু মানুষ। ২০২২-এ ইরানের হিজাববিরোধী গণ-আন্দোলন দাঁড়িয়ে ছিল তিনটি শব্দের ওপরে। তা হলো, ‘নারী-জীবন-স্বাধীনতা’। নারগিস মোহাম্মদির সারা জীবনের কাজের বিষয়বস্তুও ছিল তা-ই।
আজ থেকে তিন দশক আগেও হিজাব পরিধান করা নিয়ে তটস্থ থাকতে হতো না ইরানের নারীদের। ইরানে তখন নারীরা তাঁদের ইচ্ছেমতো পোশাক পরতেন। ১৯৭৯ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী বিপ্লবের সাক্ষী হন ইরানের মানুষ। পাহলভি রাজবংশের শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে সরিয়ে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে ইসলামিক রিপাবলিক সরকার। ইরান থেকে রাজপরিবারকে উৎখাত করার এই আন্দোলনকে তখন সমর্থন জুগিয়েছিল বিভিন্ন বামপন্থী ও ইসলামপন্থী সংগঠন। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা ইরানি বিপ্লব বা ইসলামিক বিপ্লব নামেও পরিচিত। রাজপরিবারের উৎখাতের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে যায় ইরানের সামাজিক পরিস্থিতি ও রীতিনীতি।
ক্ষমতায় আসার পরই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি আদেশ দেন, জাতি-ধর্মনির্বিশেষে দেশের সব নারীকে হিজাব পরে থাকতে হবে। এর বিরুদ্ধে সেই সময়েও পথে নামতে দেখা গিয়েছিল সে দেশের নারীদের। ইরানের রাজবংশের পতনের পর বহু বছর পেরিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও কমেছে সে দেশের নারীদের সামাজিক অধিকার।
তারপরও অবশ্য স্বাধীনচেতা প্রতিবাদী মানুষের বিক্ষোভ থেমে নেই। কখনো শিরিন এবাদি, কখনো নারগিস মোহাম্মদি হয়েছেন প্রতিবাদী মুখের প্রতীক।
এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভের পর নারগিস মোহাম্মদি লিখেছেন, তিনি জেলখানার জানালা দিয়ে তেহরানের উত্তর দিকের পাহাড়ের গায়ে গাছ ও ফুলদের দেখেন। ওই জানালার ফাঁকটুকুই তাঁর বিশ্ব। মুক্ত এক ইরানের কথা ভাবার জন্য ওই দৃশ্যটিই সম্বল। তিনি বলেন, ‘আরও শাস্তি দিক ওরা আমাকে, আরও কেড়ে নিক আমার স্বাধীনতা, তত আমি হয়ে উঠব আরও বেশি বদ্ধপরিকর। গণতন্ত্র আনতেই হবে ইরানে। স্বাধীনতা চাই ইরানে।’
নারগিসের পুরস্কারপ্রাপ্তি কয়েক বছর ধরে নারী অধিকারের পক্ষে সংগঠিত প্রতিবাদ ও সরকারপক্ষের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে যোগ্য প্রত্যুত্তর। লন্ডনে বসবাসকারী ইরানি সাংবাদিক মারিয়াম ফুমামি, ‘এক্স’-এ (টুইটার) লিখেছেন, ‘এ জয় আমাদেরই জয়।’ জেলখানার বাইরে আর ভেতরে, অজস্র মৃতের কবরখানায় নারগিসের নাম অনুরণিত হচ্ছে। যে লড়াই চলছে আমাদের সবার, ইরানের মেয়েদের, তারই যেন একটা স্বীকৃতি মিলল নারগিসের জয়ে। পৃথিবী ইরানের ভেতরের গণ-আন্দোলনের কণ্ঠস্বর নতুন করে শুনতে পেল।
বর্তমান যুগে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে খাদ্য কিংবা পোশাক পছন্দ করা, ধর্ম পালন করা বা না-করার অধিকার ব্যক্তির রয়েছে। যদি কেউ ধর্মীয়ভাবে অনাবশ্যক কিন্তু পছন্দের সংস্কৃতি অনুযায়ী পোশাক পরতে চান, তা যেমন পরতে পারেন, একইভাবে যদি কেউ ধর্মসম্প্রদায়ের নির্দেশ সত্ত্বেও সেই পোশাক না পরতে চান, তা-ও তিনি করতে পারেন। গণতান্ত্রিক দেশে এটাই বিধান; অর্থাৎ বিশেষ কোনো পোশাক পরা বা না-পরা রাষ্ট্রের মাথাব্যথার বিষয় নয়। ধর্ম কিংবা অন্য কোনো বিধানের নামে রাষ্ট্র তা নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। ব্যক্তির পছন্দ বা সিদ্ধান্তই এ ক্ষেত্রে প্রধান।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, একজন ব্যক্তি প্রাথমিকভাবে একজন একক সত্তা। তারপর সে সামাজিক সত্তা। এরপর সে এক রাষ্ট্রীয় পরিচিতি, যাকে আইডি কার্ড, পাসপোর্ট দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু সেই ব্যক্তি হিজাব পরবে কি না, ছবি আঁকবে কি না, গান গাইবে কি না, আমিষ ভোজন করবে কি না ইত্যাদি বহুতর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা থাকে না। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাজও তার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হ্রস্বতর করেছে। শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ব্যক্তিস্বাধীনতা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ।
তবে শাসকগোষ্ঠীর রক্ষণশীল ও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে গত কয়েক বছরের প্রবল আন্দোলনের পরও অবশ্য ইরানে নারীদের অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়নি। মানুষ যত বেশি প্রতিবাদী হয়েছে, ক্ষমতাসীনেরা তত বেশি কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সে দেশের নারীদের প্রতি। তবু নারগিসদের লড়াই চলেছে। সেই লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়েছে নোবেল কমিটি। তবে নারগিসদের এ লড়াই শুধু নারীদের নয়, হাজার হাজার বছর ধরে লালিত পুরুষতন্ত্র নামের দৈত্যের বিরুদ্ধে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের লড়াই। শাসকেরা এই সহজ কথাটা আজ না বুঝলে সমূহ বিপদ। ধর্ম বা অন্য কোনো বিধিনিষেধের দোহাই দিয়ে মানুষের অধিকার কখনো পদানত রাখা যায় না।
এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ইরানের জেলবন্দী মানবাধিকারকর্মী নারগিস মোহাম্মদি। নারগিস ইরানে খুবই পরিচিত নাম। সারা বিশ্বেই হালে তিনি বেশি করে প্রচার পেয়েছেন। ইরানের এই নারী বহু বছর ধরে মানবাধিকার নিয়ে লড়াই করে চলেছেন। এ জন্য তিনি সীমাহীন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
তিনি আরাম-আয়েশ, শান্তির জীবন বিসর্জন দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন এক প্রতিবাদী জীবন। ধর্মের নামে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া জবরদস্তিমূলক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়েছেন। আর তাতেই তিনি ক্ষমতাসীন মৌলবাদী চক্রের রোষানলে পড়েছেন বারবার।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অদম্য প্রাণশক্তির অধিকারী এক ব্যক্তিত্ব। ইমাম খোমেনি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন নারগিস। সেখানে তিনি পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজে পড়াকালেই তিনি সমতা এবং নারীর অধিকারের পক্ষে একজন বলিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন। পড়াশোনা শেষ করার পরে তিনি প্রকৌশলী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিয়ে প্রকৌশলী হিসেবেই কর্মজীবন শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সংস্কার-মনোভাবাপন্ন সংবাদপত্রের জন্য কলামও লিখেছিলেন।
২০০৩ সালে তিনি তেহরানের ডিফেন্ডারস অব হিউম্যান রাইটস সেন্টারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এটি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শিরিন এবাদির প্রতিষ্ঠা করা একটি সংস্থা। ২০১১ সালে নারগিসকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেই সময়ে কারাবন্দী মানবাধিকারকর্মী ও তাঁদের পরিবারকে সহায়তা করার প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে বহু বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
২০১৩ সালে জামিন পাওয়ার পর নারগিস মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ২০১৫ সালে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারে থাকাকালে তিনি রাজনৈতিক বন্দীদের, বিশেষ করে নারীর বিরুদ্ধে সরকারের পদ্ধতিগত নির্যাতন এবং যৌন হেনস্তার বিরোধিতা করেন।
গত বছর ইরানি নীতি পুলিশের হেফাজতে কুর্দি যুবতী মাহশা আমিনির মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পরই তিনি বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন জানান এবং তাঁর সহবন্দীদের সংগঠিত করেন। তাঁর এই কাজের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। নারগিসের ফোনে কথা বলা এবং ভিজিটরের সঙ্গে দেখা করা বন্ধ করা হয়েছিল। তবু তিনি জেল থেকে একটি নিবন্ধ পাচার করতে সক্ষম হন, যা নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করেছিল মাহশা আমিনির হত্যার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে।
তিনি গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। একই সঙ্গে নারীর অধিকার আদায় ও নারীমুক্তির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার ব্রত নিয়েছেন। তাই তো তিনি অজস্রবার আটক হয়েছেন। চাকরি হারিয়েছেন। রক্ষণশীল ইরানে নারীদের অধিকারের জন্য লড়াই করার কারণে তাঁকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়েছে ১৩ বার। ৫ বার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে ৩১ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। তাঁকে দোররা মারা হয়েছিল ১৫৪ বার। তিনি স্বামী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁরা প্রবাসী। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
ব্যক্তিগত সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আর এ কারণে তাঁর সুখ গেছে, স্বাস্থ্য গেছে, মুক্ত জীবনযাপনের অধিকার গেছে। তবু তিনি লক্ষ্য ও সংকল্প থেকে সরে আসেননি। ইরানের মতো একটি কট্টর ধর্মবাদীদের দেশে তিনি প্রতিবাদের মশাল জ্বালিয়ে পথ চলেছেন।
ইরানের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ডিফেন্ডার্স অব হিউম্যান রাইটস সেন্টার’ দীর্ঘদিন ধরেই ইরানে মানবাধিকার, মূলত নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে। এই সংস্থার সহকারী প্রধান নারগিস। এই সংস্থার প্রধান শিরিন এবাদি ২০০৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।
ইরানের ধর্মীয় মৌলবাদী শাসনে নারীদের অধিকার খর্ব করার অভিযোগ উঠেছে বারবার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশি হেফাজতে সে দেশের তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর হিজাব-বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অভিযোগ ওঠে, সঠিকভাবে হিজাব না পরার জন্যই ‘চরম শাস্তি’ পেতে হয়েছে তাঁকে। এরপরই ইরানজুড়ে চুল কেটে, হিজাব খুলে প্রতিবাদে নামে নারীদের এক বড় অংশ।
ওই সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর অভিযোগও উঠেছিল। তাতে প্রাণ হারান বহু মানুষ। ২০২২-এ ইরানের হিজাববিরোধী গণ-আন্দোলন দাঁড়িয়ে ছিল তিনটি শব্দের ওপরে। তা হলো, ‘নারী-জীবন-স্বাধীনতা’। নারগিস মোহাম্মদির সারা জীবনের কাজের বিষয়বস্তুও ছিল তা-ই।
আজ থেকে তিন দশক আগেও হিজাব পরিধান করা নিয়ে তটস্থ থাকতে হতো না ইরানের নারীদের। ইরানে তখন নারীরা তাঁদের ইচ্ছেমতো পোশাক পরতেন। ১৯৭৯ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী বিপ্লবের সাক্ষী হন ইরানের মানুষ। পাহলভি রাজবংশের শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে সরিয়ে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে ইসলামিক রিপাবলিক সরকার। ইরান থেকে রাজপরিবারকে উৎখাত করার এই আন্দোলনকে তখন সমর্থন জুগিয়েছিল বিভিন্ন বামপন্থী ও ইসলামপন্থী সংগঠন। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা ইরানি বিপ্লব বা ইসলামিক বিপ্লব নামেও পরিচিত। রাজপরিবারের উৎখাতের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে যায় ইরানের সামাজিক পরিস্থিতি ও রীতিনীতি।
ক্ষমতায় আসার পরই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি আদেশ দেন, জাতি-ধর্মনির্বিশেষে দেশের সব নারীকে হিজাব পরে থাকতে হবে। এর বিরুদ্ধে সেই সময়েও পথে নামতে দেখা গিয়েছিল সে দেশের নারীদের। ইরানের রাজবংশের পতনের পর বহু বছর পেরিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও কমেছে সে দেশের নারীদের সামাজিক অধিকার।
তারপরও অবশ্য স্বাধীনচেতা প্রতিবাদী মানুষের বিক্ষোভ থেমে নেই। কখনো শিরিন এবাদি, কখনো নারগিস মোহাম্মদি হয়েছেন প্রতিবাদী মুখের প্রতীক।
এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভের পর নারগিস মোহাম্মদি লিখেছেন, তিনি জেলখানার জানালা দিয়ে তেহরানের উত্তর দিকের পাহাড়ের গায়ে গাছ ও ফুলদের দেখেন। ওই জানালার ফাঁকটুকুই তাঁর বিশ্ব। মুক্ত এক ইরানের কথা ভাবার জন্য ওই দৃশ্যটিই সম্বল। তিনি বলেন, ‘আরও শাস্তি দিক ওরা আমাকে, আরও কেড়ে নিক আমার স্বাধীনতা, তত আমি হয়ে উঠব আরও বেশি বদ্ধপরিকর। গণতন্ত্র আনতেই হবে ইরানে। স্বাধীনতা চাই ইরানে।’
নারগিসের পুরস্কারপ্রাপ্তি কয়েক বছর ধরে নারী অধিকারের পক্ষে সংগঠিত প্রতিবাদ ও সরকারপক্ষের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে যোগ্য প্রত্যুত্তর। লন্ডনে বসবাসকারী ইরানি সাংবাদিক মারিয়াম ফুমামি, ‘এক্স’-এ (টুইটার) লিখেছেন, ‘এ জয় আমাদেরই জয়।’ জেলখানার বাইরে আর ভেতরে, অজস্র মৃতের কবরখানায় নারগিসের নাম অনুরণিত হচ্ছে। যে লড়াই চলছে আমাদের সবার, ইরানের মেয়েদের, তারই যেন একটা স্বীকৃতি মিলল নারগিসের জয়ে। পৃথিবী ইরানের ভেতরের গণ-আন্দোলনের কণ্ঠস্বর নতুন করে শুনতে পেল।
বর্তমান যুগে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে খাদ্য কিংবা পোশাক পছন্দ করা, ধর্ম পালন করা বা না-করার অধিকার ব্যক্তির রয়েছে। যদি কেউ ধর্মীয়ভাবে অনাবশ্যক কিন্তু পছন্দের সংস্কৃতি অনুযায়ী পোশাক পরতে চান, তা যেমন পরতে পারেন, একইভাবে যদি কেউ ধর্মসম্প্রদায়ের নির্দেশ সত্ত্বেও সেই পোশাক না পরতে চান, তা-ও তিনি করতে পারেন। গণতান্ত্রিক দেশে এটাই বিধান; অর্থাৎ বিশেষ কোনো পোশাক পরা বা না-পরা রাষ্ট্রের মাথাব্যথার বিষয় নয়। ধর্ম কিংবা অন্য কোনো বিধানের নামে রাষ্ট্র তা নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। ব্যক্তির পছন্দ বা সিদ্ধান্তই এ ক্ষেত্রে প্রধান।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, একজন ব্যক্তি প্রাথমিকভাবে একজন একক সত্তা। তারপর সে সামাজিক সত্তা। এরপর সে এক রাষ্ট্রীয় পরিচিতি, যাকে আইডি কার্ড, পাসপোর্ট দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু সেই ব্যক্তি হিজাব পরবে কি না, ছবি আঁকবে কি না, গান গাইবে কি না, আমিষ ভোজন করবে কি না ইত্যাদি বহুতর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা থাকে না। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাজও তার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হ্রস্বতর করেছে। শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ব্যক্তিস্বাধীনতা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ।
তবে শাসকগোষ্ঠীর রক্ষণশীল ও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে গত কয়েক বছরের প্রবল আন্দোলনের পরও অবশ্য ইরানে নারীদের অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়নি। মানুষ যত বেশি প্রতিবাদী হয়েছে, ক্ষমতাসীনেরা তত বেশি কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সে দেশের নারীদের প্রতি। তবু নারগিসদের লড়াই চলেছে। সেই লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়েছে নোবেল কমিটি। তবে নারগিসদের এ লড়াই শুধু নারীদের নয়, হাজার হাজার বছর ধরে লালিত পুরুষতন্ত্র নামের দৈত্যের বিরুদ্ধে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের লড়াই। শাসকেরা এই সহজ কথাটা আজ না বুঝলে সমূহ বিপদ। ধর্ম বা অন্য কোনো বিধিনিষেধের দোহাই দিয়ে মানুষের অধিকার কখনো পদানত রাখা যায় না।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে