মামুনুর রশীদ
আমাদের আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী গত হয়েছেন এক বছর আগে ১৯ মে ২০২২। তিনি গত হয়েছেন বটে, কিন্তু বিগত হননি। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, তত দিন তিনি একুশের গানে বেঁচে থাকবেন। কাজেই তাঁর বিগত হওয়ার আশঙ্কা নেই। ভাষা আন্দোলনের সময় তাঁর বয়স ১৮ বছর। কবিতা লিখতেন, ছোটগল্প লিখতেন এবং সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে তাঁর ছিল চলাচল। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছাত্র এবং লড়াকু ছাত্র। ভাষার প্রতি প্রবল আবেগ থেকেই তিনি রচনা করেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারির সেই অমর গান—আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...।
তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায়। তিনি তখন জয়বাংলা পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত। আমরা তখন তাঁর চলাচল দেখতাম, উত্তেজিত বাক্যালাপ শুনতাম আবার অত্যন্ত কোমল স্বরে তরুণদের সঙ্গে কথা বলতেও দেখতাম। জয়বাংলা পত্রিকায় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই প্রকাশ হলো ঢাকায় বাংলাদেশের পতাকা উড়বে। এক ছাত্র নেতা এসে চ্যালেঞ্জ করলেন। গাফ্ফার চৌধুরী শুধু বললেন, ‘আমি যতটুকু জানি, ততটুকুই লিখেছি।’ ছাত্র নেতা এবার ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন, আই উইল সি ইউ।’
গাফ্ফার চৌধুরী ততোধিক উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘ওকে, ইউ মাইন্ড ইউর বিজনেস।’
এরপর শুনেছি সম্পাদকীয় বিভাগটিকে তিনি আরও স্বাধীন করে দিয়েছেন। যদিও বাংলাদেশে এসে ওই পত্রিকার সঙ্গে তিনি আর যুক্ত থাকেননি।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে গল্প থেকে নাটক হতো। বেশ কিছুদিন আমি কিছু বাছাই করা গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছি। নাট্যরূপের সঙ্গে একটু উপস্থাপনাও থাকত। গাফ্ফার ভাইয়ের বহু পুরোনো একটি গল্প খুঁজে বের করলাম। হিংসা এবং লোভের চমৎকার একটি গল্প। সেখানে একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। নাটকটিও বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এর বহুদিন পর যখন লন্ডনে দেখা হয়, তখন বাঙালিদের দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, ‘মামুন আমাকে নাট্যকার বানিয়েছে।’ আমি এত অভিভূত হয়েছিলাম যে আজ অবধি সেটি আমার স্মৃতির পর্দায় রয়ে গেছে। এরপর তিনি ঢাকায় এসেছেন, দেখা হয়েছে, নানান কথাবার্তার মধ্যে তাঁর গল্প নিয়ে তৈরি নাটকের কথা তিনি ভুলতে পারেননি। ২০১২ সালে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা লন্ডনে তিনি নাটক দেখতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়ারের মধ্যে একটি কাল্পনিক সংলাপ ইংরেজি ভাষায়। স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় নাটকটি নিয়ে আমরা ফ্রেঞ্জ ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলাম, ফেরার পথে বাঙালি বন্ধুদের উদ্যোগে ব্রাডি সেন্টারে নাটকটি অভিনীত হয়। নাটক শেষে দর্শকেরা দাঁড়িয়ে সম্মান দেখিয়েছে। এর মধ্যে দেখতে পেলাম গাফ্ফার ভাই বসে আছেন। তাঁর কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথমে বললেন, ‘দুঃখিত মামুন, আমি দাঁড়াতে পারি না। দাঁড়িয়ে তোমাকে সম্মান দেখাতে পারলাম না।’ প্রত্যুত্তরে আমি বলি, ‘আপনি যে নাটকটি দেখতে এসেছেন, এটাই আমার কাছে পরম সম্মানের।’
পরে বাংলাদেশে এসেছেন, নানা কারণেই আর দেখা হয়নি। তাঁর কলামের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম আমি। বেশ কটি পত্রিকায় লিখতেন। তাঁর লেখার ভক্ত হওয়ার কারণ বহু ঐতিহাসিক তথ্য থাকত তাতে। যদিও দুর্জনেরা বলত, গাফ্ফার সাহেবের তথ্যের সাক্ষী হচ্ছে মৃত ব্যক্তিরা। কাজেই ওটা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। কিছু কিছু লেখায় অবশ্য বিষয়টি আছে। গাফ্ফার ভাই গণতন্ত্র এবং ডানপন্থায় বিশ্বাস করতেন। ডানপন্থার কথাটি তাঁর লেখায় তেমন একটা আসত না; তবে গণতন্ত্রের বিষয়টি ছিল খুবই উচ্চকিত। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি লন্ডনে কাটিয়েছেন। প্রথম কারণ স্ত্রীর অসুস্থতা, যার চিকিৎসা এ দেশে অসম্ভব ছিল। তিনি চলে যান এবং ফেরার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও দীর্ঘ ১৫ বছরের সামরিক শাসনের সময় তাঁর দেশে ফেরার কোনো উপায় ছিল না। যখনই দেখেছেন তাঁর ফেরার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তখনই তিনি চলে এসেছেন। একবার শুনেছিলাম তাঁর জন্মভূমি নদীবেষ্টিত মনোরম গ্রাম বরিশালের উলানিয়ায় যাবেন, যেখানে তাঁর পূর্বপুরুষদের শত শত বর্ষের স্মৃতি আছে। শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক-লেখকদের দুটো সুবিধা আছে—একটি বিশাল তথ্যভান্ডার সযত্নে রক্ষিত আছে; দ্বিতীয়ত, স্বাধীনভাবে লেখার সুযোগ। লন্ডনে বসে এত সব কলাম তিনি লিখেছেন, এত সব সাহসী উচ্চারণ তিনি করেছেন, যা স্বদেশে থাকলে হয়তো তিনি করতে পারতেন না। দুহাত ভরে তিনি এই সুযোগ নিয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা পাওয়াও সেখানে খুবই সহজ ছিল। আর এর সঙ্গে চলছিল তাঁর স্ত্রীর দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা। জীবিকার তাগিদে তাঁকে প্রতিদিনই লিখতে হতো। এত তথ্য, শব্দের ভান্ডার এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর প্রাত্যহিক যোগাযোগ—সবটা মিলিয়ে তাঁর লেখার মালমসলার কোনো অসুবিধা হতো না। ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করাও তাঁর লেখার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। একটা সময়ে বদরউদ্দিন উমরের সঙ্গে তাঁর কলাম-যুদ্ধ চলত। দুজনেরই কলাম-যুদ্ধ থেকে আমরা প্রচুর শিখতাম। দুজনের কলাম থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমিও লিখেছি। পৃথিবীর সব দেশেই দেখেছি লেখকেরা নিজের দেশে থাকতে পারেন না। তার নানাবিধ কারণ থাকে। প্রধান কারণ রাজনৈতিক। যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের পছন্দসই লিখতে না পারলে বা বিরোধিতা করলে, সেই লেখকের আর নিজের দেশে থাকা হয় না। নিজ দেশে এই লেখকেরা অনেক নির্যাতন সহ্য করেছেন। জেল খেটে, পুলিশের নিপীড়ন সহ্য করে অনেকেই স্বদেশে থেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার কেউ কেউ সুযোগ বুঝে দেশত্যাগ করেছেন। গাফ্ফার ভাইয়ের সৌভাগ্য যে তিনি পঁচাত্তরের আগেই এ দেশ থেকে চলে যেতে পেরেছিলেন। পঁচাত্তরের পরে তাঁর চলে যাওয়া কঠিন হতো। দেশে থাকলে তাঁকে শাসকগোষ্ঠীর অনুগত হয়ে থাকতে হতো। যাঁদের প্রবাসে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাঁরা হয় নিপীড়ন সহ্য করে থেকেছেন, না হয় লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। ভারতে কোনো না কোনোভাবে লেখকেরা আমাদের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। কারণ সেখানে ১৯৪৭ সালের পর একটা গণতান্ত্রিক আবহ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার লেখকেরা মামলার সম্মুখীন হন, কিন্তু বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতার ফলে তাঁরা বেরিয়ে আসেন। হয়তো আবারও মামলার সম্মুখীন হন। গাফ্ফার ভাই অনেক কাগজে কাজ করেছেন। প্রধানত সম্পাদকীয় বিভাগে এবং সেই সঙ্গে লেখা কলাম। তাঁদের যৌবনে অনেক সমমনা সাংবাদিক, লেখক ও কবি পেয়েছিলেন, তাঁরা সবাই অকুতোভয় এবং মুক্তহস্তে লিখতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনী তাঁদের অনেককে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সে যাত্রায় তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন প্রবাসে থাকার কারণে। অবশ্য প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি প্রচুর কাজ করতে পেরেছিলেন। তবে আগেই বলেছি, তাঁর কার্যক্ষেত্র বারবার পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের কারণ বৈষয়িক নয়, মতপার্থক্য এবং মতপার্থক্যে তাঁর অবিচল থাকার ফলে।
আমার খুব বিস্ময় হয়, তিনি এত লেখালেখির পরেও পড়ার সময় পেতেন কীভাবে? তাঁর বহু কলামে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দসহ অনেক দেশি ও বিদেশি কবির কবিতার উল্লেখ থাকত। তাঁর লেখায় একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল একধরনের আশাবাদ। তিনি বারবার শুভবুদ্ধির জয়ের আশা করতেন। যদিও সে আশা অনেকাংশেই নিরাশায় পরিণত হয়েছে। পৃথিবী ক্রমাগত জটিল হয়ে পড়ছে। এই পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করার জন্য শক্তিশালী লেখক ও চিন্তাবিদের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক একটা দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রয়োজন আছে। গণতন্ত্রের মাতৃভূমি খোদ ইংল্যান্ডে বসে তিনি গণতন্ত্রের সর্বনাশ যেমন দেখেছেন, তেমনি পুঁজিবাদের কুৎসিত চেহারাটাও দেখেছেন। সেসব নিয়ে ছোটখাটো আলোচনা প্রায়ই করতেন। কিন্তু আমরা আশা করতাম যে তিনি একটা বিপুল সম্ভার নিয়ে কখনো আমাদের সামনে হাজির হবেন। আবার উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা লিখবেন। কিন্তু একদিকে জীবনের প্রাত্যহিকতা, অন্যদিকে জীবিকার প্রচণ্ড তাগিদ—এই দুটো মিলিয়ে তিনি স্থিত হতে পারেননি। আসলে মানুষের জীবনটাই একটি অসমাপ্ত নাটকের মতো। হয়তো অনেক কথা বলার থাকে, অনেক দৃশ্যের অবতারণার কথা থাকে, কিন্তু জীবনের সীমাবদ্ধতায় সেসব হয়ে ওঠে না। যতটুকু তিনি দিয়েছেন তা নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকি, সেখানে থেকেই আলো ছড়াক। যে আলো তিনি দীর্ঘ ৬০-৭০ বছরে ছড়িয়েছেন তার দীপ্তি বহুকাল চলবে।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
আমাদের আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী গত হয়েছেন এক বছর আগে ১৯ মে ২০২২। তিনি গত হয়েছেন বটে, কিন্তু বিগত হননি। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, তত দিন তিনি একুশের গানে বেঁচে থাকবেন। কাজেই তাঁর বিগত হওয়ার আশঙ্কা নেই। ভাষা আন্দোলনের সময় তাঁর বয়স ১৮ বছর। কবিতা লিখতেন, ছোটগল্প লিখতেন এবং সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে তাঁর ছিল চলাচল। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছাত্র এবং লড়াকু ছাত্র। ভাষার প্রতি প্রবল আবেগ থেকেই তিনি রচনা করেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারির সেই অমর গান—আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...।
তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায়। তিনি তখন জয়বাংলা পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত। আমরা তখন তাঁর চলাচল দেখতাম, উত্তেজিত বাক্যালাপ শুনতাম আবার অত্যন্ত কোমল স্বরে তরুণদের সঙ্গে কথা বলতেও দেখতাম। জয়বাংলা পত্রিকায় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই প্রকাশ হলো ঢাকায় বাংলাদেশের পতাকা উড়বে। এক ছাত্র নেতা এসে চ্যালেঞ্জ করলেন। গাফ্ফার চৌধুরী শুধু বললেন, ‘আমি যতটুকু জানি, ততটুকুই লিখেছি।’ ছাত্র নেতা এবার ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন, আই উইল সি ইউ।’
গাফ্ফার চৌধুরী ততোধিক উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘ওকে, ইউ মাইন্ড ইউর বিজনেস।’
এরপর শুনেছি সম্পাদকীয় বিভাগটিকে তিনি আরও স্বাধীন করে দিয়েছেন। যদিও বাংলাদেশে এসে ওই পত্রিকার সঙ্গে তিনি আর যুক্ত থাকেননি।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে গল্প থেকে নাটক হতো। বেশ কিছুদিন আমি কিছু বাছাই করা গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছি। নাট্যরূপের সঙ্গে একটু উপস্থাপনাও থাকত। গাফ্ফার ভাইয়ের বহু পুরোনো একটি গল্প খুঁজে বের করলাম। হিংসা এবং লোভের চমৎকার একটি গল্প। সেখানে একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। নাটকটিও বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এর বহুদিন পর যখন লন্ডনে দেখা হয়, তখন বাঙালিদের দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, ‘মামুন আমাকে নাট্যকার বানিয়েছে।’ আমি এত অভিভূত হয়েছিলাম যে আজ অবধি সেটি আমার স্মৃতির পর্দায় রয়ে গেছে। এরপর তিনি ঢাকায় এসেছেন, দেখা হয়েছে, নানান কথাবার্তার মধ্যে তাঁর গল্প নিয়ে তৈরি নাটকের কথা তিনি ভুলতে পারেননি। ২০১২ সালে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা লন্ডনে তিনি নাটক দেখতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়ারের মধ্যে একটি কাল্পনিক সংলাপ ইংরেজি ভাষায়। স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় নাটকটি নিয়ে আমরা ফ্রেঞ্জ ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলাম, ফেরার পথে বাঙালি বন্ধুদের উদ্যোগে ব্রাডি সেন্টারে নাটকটি অভিনীত হয়। নাটক শেষে দর্শকেরা দাঁড়িয়ে সম্মান দেখিয়েছে। এর মধ্যে দেখতে পেলাম গাফ্ফার ভাই বসে আছেন। তাঁর কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথমে বললেন, ‘দুঃখিত মামুন, আমি দাঁড়াতে পারি না। দাঁড়িয়ে তোমাকে সম্মান দেখাতে পারলাম না।’ প্রত্যুত্তরে আমি বলি, ‘আপনি যে নাটকটি দেখতে এসেছেন, এটাই আমার কাছে পরম সম্মানের।’
পরে বাংলাদেশে এসেছেন, নানা কারণেই আর দেখা হয়নি। তাঁর কলামের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম আমি। বেশ কটি পত্রিকায় লিখতেন। তাঁর লেখার ভক্ত হওয়ার কারণ বহু ঐতিহাসিক তথ্য থাকত তাতে। যদিও দুর্জনেরা বলত, গাফ্ফার সাহেবের তথ্যের সাক্ষী হচ্ছে মৃত ব্যক্তিরা। কাজেই ওটা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। কিছু কিছু লেখায় অবশ্য বিষয়টি আছে। গাফ্ফার ভাই গণতন্ত্র এবং ডানপন্থায় বিশ্বাস করতেন। ডানপন্থার কথাটি তাঁর লেখায় তেমন একটা আসত না; তবে গণতন্ত্রের বিষয়টি ছিল খুবই উচ্চকিত। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি লন্ডনে কাটিয়েছেন। প্রথম কারণ স্ত্রীর অসুস্থতা, যার চিকিৎসা এ দেশে অসম্ভব ছিল। তিনি চলে যান এবং ফেরার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও দীর্ঘ ১৫ বছরের সামরিক শাসনের সময় তাঁর দেশে ফেরার কোনো উপায় ছিল না। যখনই দেখেছেন তাঁর ফেরার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তখনই তিনি চলে এসেছেন। একবার শুনেছিলাম তাঁর জন্মভূমি নদীবেষ্টিত মনোরম গ্রাম বরিশালের উলানিয়ায় যাবেন, যেখানে তাঁর পূর্বপুরুষদের শত শত বর্ষের স্মৃতি আছে। শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক-লেখকদের দুটো সুবিধা আছে—একটি বিশাল তথ্যভান্ডার সযত্নে রক্ষিত আছে; দ্বিতীয়ত, স্বাধীনভাবে লেখার সুযোগ। লন্ডনে বসে এত সব কলাম তিনি লিখেছেন, এত সব সাহসী উচ্চারণ তিনি করেছেন, যা স্বদেশে থাকলে হয়তো তিনি করতে পারতেন না। দুহাত ভরে তিনি এই সুযোগ নিয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা পাওয়াও সেখানে খুবই সহজ ছিল। আর এর সঙ্গে চলছিল তাঁর স্ত্রীর দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা। জীবিকার তাগিদে তাঁকে প্রতিদিনই লিখতে হতো। এত তথ্য, শব্দের ভান্ডার এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর প্রাত্যহিক যোগাযোগ—সবটা মিলিয়ে তাঁর লেখার মালমসলার কোনো অসুবিধা হতো না। ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করাও তাঁর লেখার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। একটা সময়ে বদরউদ্দিন উমরের সঙ্গে তাঁর কলাম-যুদ্ধ চলত। দুজনেরই কলাম-যুদ্ধ থেকে আমরা প্রচুর শিখতাম। দুজনের কলাম থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমিও লিখেছি। পৃথিবীর সব দেশেই দেখেছি লেখকেরা নিজের দেশে থাকতে পারেন না। তার নানাবিধ কারণ থাকে। প্রধান কারণ রাজনৈতিক। যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের পছন্দসই লিখতে না পারলে বা বিরোধিতা করলে, সেই লেখকের আর নিজের দেশে থাকা হয় না। নিজ দেশে এই লেখকেরা অনেক নির্যাতন সহ্য করেছেন। জেল খেটে, পুলিশের নিপীড়ন সহ্য করে অনেকেই স্বদেশে থেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার কেউ কেউ সুযোগ বুঝে দেশত্যাগ করেছেন। গাফ্ফার ভাইয়ের সৌভাগ্য যে তিনি পঁচাত্তরের আগেই এ দেশ থেকে চলে যেতে পেরেছিলেন। পঁচাত্তরের পরে তাঁর চলে যাওয়া কঠিন হতো। দেশে থাকলে তাঁকে শাসকগোষ্ঠীর অনুগত হয়ে থাকতে হতো। যাঁদের প্রবাসে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাঁরা হয় নিপীড়ন সহ্য করে থেকেছেন, না হয় লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। ভারতে কোনো না কোনোভাবে লেখকেরা আমাদের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। কারণ সেখানে ১৯৪৭ সালের পর একটা গণতান্ত্রিক আবহ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার লেখকেরা মামলার সম্মুখীন হন, কিন্তু বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতার ফলে তাঁরা বেরিয়ে আসেন। হয়তো আবারও মামলার সম্মুখীন হন। গাফ্ফার ভাই অনেক কাগজে কাজ করেছেন। প্রধানত সম্পাদকীয় বিভাগে এবং সেই সঙ্গে লেখা কলাম। তাঁদের যৌবনে অনেক সমমনা সাংবাদিক, লেখক ও কবি পেয়েছিলেন, তাঁরা সবাই অকুতোভয় এবং মুক্তহস্তে লিখতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনী তাঁদের অনেককে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সে যাত্রায় তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন প্রবাসে থাকার কারণে। অবশ্য প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি প্রচুর কাজ করতে পেরেছিলেন। তবে আগেই বলেছি, তাঁর কার্যক্ষেত্র বারবার পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের কারণ বৈষয়িক নয়, মতপার্থক্য এবং মতপার্থক্যে তাঁর অবিচল থাকার ফলে।
আমার খুব বিস্ময় হয়, তিনি এত লেখালেখির পরেও পড়ার সময় পেতেন কীভাবে? তাঁর বহু কলামে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দসহ অনেক দেশি ও বিদেশি কবির কবিতার উল্লেখ থাকত। তাঁর লেখায় একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল একধরনের আশাবাদ। তিনি বারবার শুভবুদ্ধির জয়ের আশা করতেন। যদিও সে আশা অনেকাংশেই নিরাশায় পরিণত হয়েছে। পৃথিবী ক্রমাগত জটিল হয়ে পড়ছে। এই পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করার জন্য শক্তিশালী লেখক ও চিন্তাবিদের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক একটা দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রয়োজন আছে। গণতন্ত্রের মাতৃভূমি খোদ ইংল্যান্ডে বসে তিনি গণতন্ত্রের সর্বনাশ যেমন দেখেছেন, তেমনি পুঁজিবাদের কুৎসিত চেহারাটাও দেখেছেন। সেসব নিয়ে ছোটখাটো আলোচনা প্রায়ই করতেন। কিন্তু আমরা আশা করতাম যে তিনি একটা বিপুল সম্ভার নিয়ে কখনো আমাদের সামনে হাজির হবেন। আবার উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা লিখবেন। কিন্তু একদিকে জীবনের প্রাত্যহিকতা, অন্যদিকে জীবিকার প্রচণ্ড তাগিদ—এই দুটো মিলিয়ে তিনি স্থিত হতে পারেননি। আসলে মানুষের জীবনটাই একটি অসমাপ্ত নাটকের মতো। হয়তো অনেক কথা বলার থাকে, অনেক দৃশ্যের অবতারণার কথা থাকে, কিন্তু জীবনের সীমাবদ্ধতায় সেসব হয়ে ওঠে না। যতটুকু তিনি দিয়েছেন তা নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকি, সেখানে থেকেই আলো ছড়াক। যে আলো তিনি দীর্ঘ ৬০-৭০ বছরে ছড়িয়েছেন তার দীপ্তি বহুকাল চলবে।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে