ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
ইতিহাস চর্চার ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরোনো হলেও বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত খুব বেশি দিনের নয়। ঔপনিবেশিক শাসনামলেই বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ধারা শুরু হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পর গবেষকদের হাতে যখন ভারতবিদ্যার জ্ঞান বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন থেকেই ইতিহাস চর্চার ধারা শুরু হয়। কোম্পানির স্বার্থে লিখিত এসব বুদ্ধিজীবীর লেখনীর সূত্র ধরে বাঙালি মনীষীরাও এগিয়ে আসেন। প্রথম যিনি ইতিহাস রচনা বা বাংলা ভাষায় ইতিহাস নিবন্ধ রচনা করেছিলেন, তিনি ইতিহাসের ছাত্র নন। কোম্পানির কর্মচারীদের ফারসি ভাষা শেখানোর দায়িত্বে নিয়োজিত রামরাম বসু বাংলা ভাষায় ইতিহাস লেখা শুরু করেন। ১৮০১ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে তাঁর লেখা ‘প্রতাপাদিত্য চরিত’ বইটি প্রকাশিত হয়। এরপর স্থানীয় ব্যক্তিদের চরিত্র বা জীবনী নিয়ে লেখা আরও দু-একটি বই দেখা যায়।
সাহিত্যিকদের হাত ধরে বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ধারা শুরু হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামপুরের প্রেস থেকে জন মার্শম্যানের বাংলায় লেখা ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে জন ক্লার্ক ম্যার্শম্যানের ‘আউটলাইন অব দ্য হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ অবলম্বনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন ‘বাংলার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ’। জীবনচরিত বা ‘বায়োগ্রাফি’ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি চেম্বার্সের ‘বায়োগ্রাফিজ’ অবলম্বনে ‘জীবনচরিত’ লেখেন।
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল শ্রী কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারতবর্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’। চার আনা মূল্যের এই ইতিহাস বইটি গিরিশ চন্দ্র শর্মা কর্তৃক কলকাতা থেকে বিদ্যারত্ন যন্ত্রে মুদ্রিত হয়েছিল। স্কুলের ছাত্রদের উপযোগী করে এই ইতিহাস বই রচিত হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সূত্র ধরে এই সময়ে বেশ কয়েকজন বাঙালি মনীষী বাংলার ইতিহাস চর্চায় এগিয়ে আসেন, যাদের মধ্যে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রজনীকান্ত গুপ্ত, কালী প্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য। উনিশ শতকে প্রকাশিত এই বইগুলো থেকে ইতিহাসের মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করা যায়। পাণ্ডিত্য, বিচক্ষণ বিশ্লেষণশক্তি ও নিপুণ প্রকাশভঙ্গি ছিল তাঁদের ইতিহাস রচনার বিষয়। ১৩১৭ বঙ্গাব্দে কলকাতা থেকে ‘রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদ’ কর্তৃক গৌড়ের ইতিহাস বইটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি প্রকাশের বিষয়ে শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তী তদানীন্তন রংপুরের সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক জমিদার সুরেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন।
সাহিত্যিকদের বাইরে পেশাদারিত্ব নিয়ে বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চা শুরু করেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯১৫ ও ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দুই খণ্ডে রচনা করেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’। বলা যেতে পারে, বাংলা ভাষায় বাংলার ইতিহাস নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লেখা প্রথম দিকের কাজগুলোর একটি। এ জন্য তাঁকে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের অগ্রপথিক হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলা ভাষায় ও বাংলায় ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসনামলের এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি (১৯১০-১৯৬৩) বা বরেন্দ্র গবেষণা সমিতি, যা আমাদের কাছে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর নামে পরিচিত। ১৯১৪ সালে সমিতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই সোসাইটি বাংলার প্রাচীন স্থানগুলোতে অনুসন্ধান, বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা, প্রত্ন নিদর্শনাবলি, প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন গবেষণাকর্ম ও বিরল পাণ্ডুলিপি প্রকাশনার কাজ হাতে নেয়।
বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি বাংলার ইতিহাস রচনায় নতুনরূপে লেখনী ধারণ করে এগিয়ে আসেন শরৎ কুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দ। বাংলার শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণায় তাঁদের অভিন্ন আগ্রহ ছিল। মানুষ ও প্রকৃতির ধ্বংসলীলা এড়িয়ে যেসব সৌধ এখনো টিকে আছে, সেগুলোর তথ্য উদ্ঘাটন করে অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরাই ছিল তাঁদের আজীবন প্রয়াস। ফলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ইতিহাস চেতনার সঞ্চার নতুনরূপে দেখা দেয়। এই সমিতির অন্যতম কর্ণধার রমাপ্রসাদ চন্দ ১৯১২ সালে গৌড় মালা প্রকাশ করে বাংলার ইতিহাস চর্চাকে উচ্চস্তরে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেন। ১৯১২ সালে গৌড় রাজমালা বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রমাপ্রসাদ চন্দের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি আরও ছড়িয়ে পড়ে। ‘গৌড় রাজমালা’ ও ‘গৌড় লেখমালা’ গ্রন্থ দুটি প্রকাশের পর প্রবাসী পত্রিকায় প্রাচ্য পণ্ডিত বিজয় চন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইতিহাস সংগ্রহ সংকল্পে যে সকল উদ্যোগ চলিতেছে, তাহা অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য।’
বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক গবেষণার আরেক নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হয় অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র হাত ধরে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত গৌড় লেখমালায় তিনি কয়েকটি পাল তাম্রশাসন ও লিপিমালার যে বাংলা অনুবাদ করেছিলেন, তা বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই প্রকাশনাগুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ যে অদ্যাবধি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস থেকে তথ্যাবলি সংগ্রহের একমাত্র প্রামাণিক সূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। ঔপনিবেশিক আমলের এসব মনীষী বা যাঁরা ইতিহাসচর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন, তাঁরা শুধু শিক্ষিত ভদ্রলোকই ছিলেন না, পশ্চিমা ভাবধারার সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন, পশ্চিমা ইতিহাসতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। নৈতিকতা, প্রগতিবাদ ও ইতিহাসে বীরপুরুষদের জীবনী বাঙালি ইতিহাসবিদদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রত্নতত্ত্ব ধারার বাইরে এসে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় জীবনীমূলক ইতিহাস রচনা শুরু করেন। তাঁর লেখা সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাসিম, রাণী ভবানী—এসব ছিল উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে আরও বেশ কিছু জীবনীমূলক ইতিহাস অন্যরাও রচনা করেন। ব্রিটিশ অফিসারদের মতো বাঙালিরাও ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে ইতিহাস রচনা করেছেন। সামাজিক ইতিহাস রচনার এই ধারায় ঘটনাবলি ও জনসাধারণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে তাঁরা জড়িত ছিলেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইটি ১৯২৮ সালের ১ জুন কলকাতার কমলা বুক ডিপো থেকে প্রকাশিত হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর লেখায় সাহিত্যকে ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেছেন বলে দাবি করেন। এ কারণে ইতিহাস রচনায় বাস্তবতার স্পর্শ উপলব্ধি করা যায়। সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ এগুলোর অন্যতম। রামতনু লাহিড়ীর ইতিহাসচর্চা উনিশ শতকের বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতি-রাষ্ট্রনীতির এক উৎকৃষ্ট নির্ভরযোগ্য দলিলরূপে পরিচিত। স্বভাবতই রামতনু লাহিড়ীর জীবনীসূত্রে উনিশ শতকের যেসব মনীষী নবজাগরণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁরাও এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছেন। জীবনীগ্রন্থ হিসেবে রচিত হলেও বইটির মূল যে এর ঐতিহাসিকতায়, সে সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন।
আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেও ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালি ইতিহাসবিদেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’, কেদারনাথ মজুমদারের ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’, যামিনী মোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ ইত্যাদি। ব্রিটিশদের গেজেটিয়ারের আদলে বাঙালিরাই এরকমভাবে লিখতে থাকেন স্থানীয় ইতিহাস, যা আজও যেকোনো অঞ্চলের ইতিহাসের আলোচনায় অধিকাংশ ঐতিহাসিক আকরগ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। ইতিহাস দর্শন ইতিহাসের মতোই পরিবর্তনশীল। নতুন চিন্তার আলোকে ইতিহাস যুগে যুগে নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। গোটা উনিশ শতকে পজিটিভিজম ইতিহাসচর্চাকে প্রভাবিত করেছিল। ক্যামব্রিজ বা অক্সফোর্ড হিস্ট্রি চর্চার ঢেউ বাঙালি ইতিহাসবিদদের আকর্ষণ করেছিল।
ব্রিটিশ শাসনামলের শেষের দিকে বাঙালি ঐতিহাসিকেরা ইতিহাস দর্শনের এদিকটায় ঝুঁকে পড়েন। নীহার রঞ্জন রায়, যদুনাথ সরকার, রমেশ চন্দ্র মজুমদার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার যে ধারা শুরু হয়েছিল, তার ফলে আজ বাংলা ভাষায় লেখা ইতিহাসচর্চা অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে। পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার জন্য পেশাদারিত্ব সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে, যাদের উদ্দেশ্য বাংলা ভাষায় ইতিহাসবিষয়ক সম্মেলনের আয়োজন করা, বাংলা ভাষায় ইতিহাসের বই ও সাময়িকী এবং গবেষণা প্রকাশ করা ইত্যাদি; যেন ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করা যায়।
ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম,অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইতিহাস চর্চার ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরোনো হলেও বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত খুব বেশি দিনের নয়। ঔপনিবেশিক শাসনামলেই বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ধারা শুরু হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পর গবেষকদের হাতে যখন ভারতবিদ্যার জ্ঞান বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন থেকেই ইতিহাস চর্চার ধারা শুরু হয়। কোম্পানির স্বার্থে লিখিত এসব বুদ্ধিজীবীর লেখনীর সূত্র ধরে বাঙালি মনীষীরাও এগিয়ে আসেন। প্রথম যিনি ইতিহাস রচনা বা বাংলা ভাষায় ইতিহাস নিবন্ধ রচনা করেছিলেন, তিনি ইতিহাসের ছাত্র নন। কোম্পানির কর্মচারীদের ফারসি ভাষা শেখানোর দায়িত্বে নিয়োজিত রামরাম বসু বাংলা ভাষায় ইতিহাস লেখা শুরু করেন। ১৮০১ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে তাঁর লেখা ‘প্রতাপাদিত্য চরিত’ বইটি প্রকাশিত হয়। এরপর স্থানীয় ব্যক্তিদের চরিত্র বা জীবনী নিয়ে লেখা আরও দু-একটি বই দেখা যায়।
সাহিত্যিকদের হাত ধরে বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ধারা শুরু হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামপুরের প্রেস থেকে জন মার্শম্যানের বাংলায় লেখা ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে জন ক্লার্ক ম্যার্শম্যানের ‘আউটলাইন অব দ্য হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ অবলম্বনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন ‘বাংলার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ’। জীবনচরিত বা ‘বায়োগ্রাফি’ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি চেম্বার্সের ‘বায়োগ্রাফিজ’ অবলম্বনে ‘জীবনচরিত’ লেখেন।
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল শ্রী কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারতবর্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’। চার আনা মূল্যের এই ইতিহাস বইটি গিরিশ চন্দ্র শর্মা কর্তৃক কলকাতা থেকে বিদ্যারত্ন যন্ত্রে মুদ্রিত হয়েছিল। স্কুলের ছাত্রদের উপযোগী করে এই ইতিহাস বই রচিত হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সূত্র ধরে এই সময়ে বেশ কয়েকজন বাঙালি মনীষী বাংলার ইতিহাস চর্চায় এগিয়ে আসেন, যাদের মধ্যে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রজনীকান্ত গুপ্ত, কালী প্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য। উনিশ শতকে প্রকাশিত এই বইগুলো থেকে ইতিহাসের মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করা যায়। পাণ্ডিত্য, বিচক্ষণ বিশ্লেষণশক্তি ও নিপুণ প্রকাশভঙ্গি ছিল তাঁদের ইতিহাস রচনার বিষয়। ১৩১৭ বঙ্গাব্দে কলকাতা থেকে ‘রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদ’ কর্তৃক গৌড়ের ইতিহাস বইটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি প্রকাশের বিষয়ে শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তী তদানীন্তন রংপুরের সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক জমিদার সুরেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন।
সাহিত্যিকদের বাইরে পেশাদারিত্ব নিয়ে বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চা শুরু করেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯১৫ ও ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দুই খণ্ডে রচনা করেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’। বলা যেতে পারে, বাংলা ভাষায় বাংলার ইতিহাস নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লেখা প্রথম দিকের কাজগুলোর একটি। এ জন্য তাঁকে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের অগ্রপথিক হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলা ভাষায় ও বাংলায় ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসনামলের এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি (১৯১০-১৯৬৩) বা বরেন্দ্র গবেষণা সমিতি, যা আমাদের কাছে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর নামে পরিচিত। ১৯১৪ সালে সমিতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই সোসাইটি বাংলার প্রাচীন স্থানগুলোতে অনুসন্ধান, বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা, প্রত্ন নিদর্শনাবলি, প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন গবেষণাকর্ম ও বিরল পাণ্ডুলিপি প্রকাশনার কাজ হাতে নেয়।
বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি বাংলার ইতিহাস রচনায় নতুনরূপে লেখনী ধারণ করে এগিয়ে আসেন শরৎ কুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দ। বাংলার শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণায় তাঁদের অভিন্ন আগ্রহ ছিল। মানুষ ও প্রকৃতির ধ্বংসলীলা এড়িয়ে যেসব সৌধ এখনো টিকে আছে, সেগুলোর তথ্য উদ্ঘাটন করে অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরাই ছিল তাঁদের আজীবন প্রয়াস। ফলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ইতিহাস চেতনার সঞ্চার নতুনরূপে দেখা দেয়। এই সমিতির অন্যতম কর্ণধার রমাপ্রসাদ চন্দ ১৯১২ সালে গৌড় মালা প্রকাশ করে বাংলার ইতিহাস চর্চাকে উচ্চস্তরে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেন। ১৯১২ সালে গৌড় রাজমালা বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রমাপ্রসাদ চন্দের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি আরও ছড়িয়ে পড়ে। ‘গৌড় রাজমালা’ ও ‘গৌড় লেখমালা’ গ্রন্থ দুটি প্রকাশের পর প্রবাসী পত্রিকায় প্রাচ্য পণ্ডিত বিজয় চন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইতিহাস সংগ্রহ সংকল্পে যে সকল উদ্যোগ চলিতেছে, তাহা অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য।’
বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক গবেষণার আরেক নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হয় অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র হাত ধরে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত গৌড় লেখমালায় তিনি কয়েকটি পাল তাম্রশাসন ও লিপিমালার যে বাংলা অনুবাদ করেছিলেন, তা বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই প্রকাশনাগুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ যে অদ্যাবধি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস থেকে তথ্যাবলি সংগ্রহের একমাত্র প্রামাণিক সূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। ঔপনিবেশিক আমলের এসব মনীষী বা যাঁরা ইতিহাসচর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন, তাঁরা শুধু শিক্ষিত ভদ্রলোকই ছিলেন না, পশ্চিমা ভাবধারার সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন, পশ্চিমা ইতিহাসতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। নৈতিকতা, প্রগতিবাদ ও ইতিহাসে বীরপুরুষদের জীবনী বাঙালি ইতিহাসবিদদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রত্নতত্ত্ব ধারার বাইরে এসে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় জীবনীমূলক ইতিহাস রচনা শুরু করেন। তাঁর লেখা সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাসিম, রাণী ভবানী—এসব ছিল উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে আরও বেশ কিছু জীবনীমূলক ইতিহাস অন্যরাও রচনা করেন। ব্রিটিশ অফিসারদের মতো বাঙালিরাও ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে ইতিহাস রচনা করেছেন। সামাজিক ইতিহাস রচনার এই ধারায় ঘটনাবলি ও জনসাধারণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে তাঁরা জড়িত ছিলেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইটি ১৯২৮ সালের ১ জুন কলকাতার কমলা বুক ডিপো থেকে প্রকাশিত হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর লেখায় সাহিত্যকে ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেছেন বলে দাবি করেন। এ কারণে ইতিহাস রচনায় বাস্তবতার স্পর্শ উপলব্ধি করা যায়। সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ এগুলোর অন্যতম। রামতনু লাহিড়ীর ইতিহাসচর্চা উনিশ শতকের বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতি-রাষ্ট্রনীতির এক উৎকৃষ্ট নির্ভরযোগ্য দলিলরূপে পরিচিত। স্বভাবতই রামতনু লাহিড়ীর জীবনীসূত্রে উনিশ শতকের যেসব মনীষী নবজাগরণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁরাও এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছেন। জীবনীগ্রন্থ হিসেবে রচিত হলেও বইটির মূল যে এর ঐতিহাসিকতায়, সে সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন।
আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেও ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালি ইতিহাসবিদেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’, কেদারনাথ মজুমদারের ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’, যামিনী মোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ ইত্যাদি। ব্রিটিশদের গেজেটিয়ারের আদলে বাঙালিরাই এরকমভাবে লিখতে থাকেন স্থানীয় ইতিহাস, যা আজও যেকোনো অঞ্চলের ইতিহাসের আলোচনায় অধিকাংশ ঐতিহাসিক আকরগ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। ইতিহাস দর্শন ইতিহাসের মতোই পরিবর্তনশীল। নতুন চিন্তার আলোকে ইতিহাস যুগে যুগে নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। গোটা উনিশ শতকে পজিটিভিজম ইতিহাসচর্চাকে প্রভাবিত করেছিল। ক্যামব্রিজ বা অক্সফোর্ড হিস্ট্রি চর্চার ঢেউ বাঙালি ইতিহাসবিদদের আকর্ষণ করেছিল।
ব্রিটিশ শাসনামলের শেষের দিকে বাঙালি ঐতিহাসিকেরা ইতিহাস দর্শনের এদিকটায় ঝুঁকে পড়েন। নীহার রঞ্জন রায়, যদুনাথ সরকার, রমেশ চন্দ্র মজুমদার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার যে ধারা শুরু হয়েছিল, তার ফলে আজ বাংলা ভাষায় লেখা ইতিহাসচর্চা অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে। পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার জন্য পেশাদারিত্ব সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে, যাদের উদ্দেশ্য বাংলা ভাষায় ইতিহাসবিষয়ক সম্মেলনের আয়োজন করা, বাংলা ভাষায় ইতিহাসের বই ও সাময়িকী এবং গবেষণা প্রকাশ করা ইত্যাদি; যেন ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করা যায়।
ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম,অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে