নিঝুম দ্বীপের সংরক্ষিত বনাঞ্চল কমছে দখলে

সাইফুল মাসুম, নিঝুম দ্বীপ থেকে ফিরে
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮: ৩৬
আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০: ৫৬

নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যানকে বলা হয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। কিন্তু এখন আর আগের মতো ভালো নেই নিঝুম দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ। বনাঞ্চল উজাড় ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে দিন দিন কমছে সংরক্ষিত বনটির আয়তন। জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। কমেছে দ্বীপটির হরিণের সংখ্যা।

নাম পাল্টে বনের ভূমি বন্দোবস্ত
নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যানের আয়তন ৪০ হাজার ৩৯০ একর। এটি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা ও নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে প্রায় ২১ হাজার একর। তবে এই বনাঞ্চলের কোনো সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সংরক্ষিত বনের অনেক জায়গার নাম পরিবর্তন করে ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে। হরিণের চারণভূমি চর কমলাকে চর মাহিদ নাম দিয়ে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। চর বাহাউদ্দিনকে দমার চর এবং চর কালামের ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে পূর্ব বিরবিরি নাম দিয়ে।

বন বিভাগের জাহাজমারা রেঞ্জ অফিস থেকে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যানের সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল ও উজাড় করার দায়ে ৭৮টি বন মামলায় অন্তত ৪৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জন অপরাধীকে শনাক্ত করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ সময় বেশ কয়েকবার দখলদারদের হামলার শিকার হয়েছেন বন বিভাগের কর্মীরা।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখলের সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুল আফছার দিনাজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘অতীতে অনেক বন উজাড় হয়েছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে উজাড় হয়নি।’

নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস বলেন, ‘লোকাল কোনো কোনো রাজনৈতিক কর্মী এসবের সঙ্গে জড়িত থাকে। তবে বনের সুরক্ষার বিষয়ে আমরা কোনো ছাড় দিই না।’ 

বাড়ছে বসতি ও কৃষিজমি
নিঝুম দ্বীপের নামার বাজারসংলগ্ন ইসলামপুর গ্রাম। ২০০০ সালের দিকে এখানে বন কেটে বসবাস শুরু করে পাঁচ-ছয়টি পরিবার। বর্তমানে ওই গ্রামে প্রায় ১৫০টি পরিবার বাস করছে। গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন (৬৫) বলেন, ‘কেরপাগাছের (কেওড়া) জঙ্গল আছিল। আন্ডা বন সাফ করি বসবাস শুরু করছি। তখন ফরেস্ট (বন বিভাগ) তিন-চারটা মামলা দিছিল। এখন ওই মামলা আর নাই।’ 
শুধু ইসলামপুর নয়, নিঝুম দ্বীপের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশের বনাঞ্চল উজাড় করে বেশ কয়েকটি গ্রাম গড়ে উঠেছে। আবার বনাঞ্চলের কিছু জায়গা দখল করে তৈরি করা হয়েছে কৃষিজমি। আগে নিঝুম দ্বীপ জাহাজমারা ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড থাকলেও, ২০০৮ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করে। বর্তমানে নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।

২০২১ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সমীক্ষাতেও নিঝুম দ্বীপের বনাঞ্চল কমার তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষা অনুসারে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নিঝুম দ্বীপের প্রায় ২৮৫ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ও জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) ব্যবহার করে এই সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত সহকারী অধ্যাপক আশ্রাফ উদ্দিন বলেন, জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপেই বসতি স্থাপনের মাধ্যমে বনাঞ্চল উজাড় হয়েছে।

২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত জাহাজমারা রেঞ্জের বন কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন জাবের হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি যে বন রেখে এসেছি, সেই বন এখন আর নেই।’ 
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিশেষ সংরক্ষিত বনের মর্যাদা না পেলে এই দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে না।

কমছে হরিণের সংখ্যা
নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা বাজারের চার কিলোমিটার পশ্চিমের বনাঞ্চলে একসময় হরিণের অভয়ারণ্য ছিল। ওই এলাকায় এখন গড়ে উঠেছে জনবসতি। হরিণ বাজার নামে একটি বাজারও হয়েছে। ওই বাজারের ব্যবসায়ী আরিয়ান মাহমুদ বলেন, ‘১৫ বছর আগেও হরিণ বাজার থেকে বন অনেক কাছে ছিল। তখন অনেক হরিণ দেখা যেত। এখন আর আগের মতো হরিণ নেই।’

মোহাম্মদ আলী (২৯) নামের এক বাসিন্দা বলেন, কয়েক বছর আগেও হরিণ ছিল কমপক্ষে ৩০-৪০ হাজার। এখন হরিণের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি হবে না।

জাহাজমারা রেঞ্জের বন কর্মকর্তা এস এম সাইফুর রহমান বলেন, ‘হরিণের আবাসভূমি কমে যাচ্ছে। নিঝুম দ্বীপে মিঠাপানির চারটি পুকুর ছিল, তা ভরাট হয়ে গেছে।’

নিঝুম দ্বীপকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানিয়ে বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও প্রাণ প্রকৃতি রক্ষায় সরকারের যে আইন রয়েছে, সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন না করায় নিঝুম দ্বীপের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’

আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই
জনস্বার্থে ফটোসাংবাদিক রফিক উদ্দিন এনায়েতের রিটের পর ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান এলাকায় বন্দোবস্ত ও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। গত দুই বছরে একাধিক জায়গায় ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ার দলিল আজকের পত্রিকার কাছে রয়েছে। তা ছাড়া নিঝুম দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করতে দেখা গেছে।

২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নিঝুম দ্বীপের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমানা নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ছয় মাসের মধ্যে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিবেশসচিব ও বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষককে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি।

জানতে চাইলে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আগে কতটুকু বন্দোবস্ত হয়েছে আমার জানা নেই। তবে আমরা নতুন করে বন্দোবস্ত দিচ্ছি না।’

জবরদখলের কারণে নিঝুম দ্বীপের অনেক জায়গা বেহাত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী। তিনি বলেন, অনেক বন উজাড় হয়েছে। জবরদখলে কিছু জায়গা বেহাত হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসবের সঙ্গে জড়িত। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত