মামুনুর রশীদ
বহু বছর আর বহু শতাব্দী অতিক্রম করে একটি শব্দ ভারতবর্ষে চালু হয়েছে তা হলো, দালাল। দালাল শব্দটি সম্ভবত ফারসি অথবা আরবি। সংস্কৃত, হিন্দি বা বাংলা নয়। প্রথম দিকে শব্দটি হয়তো ছিল একটু ইতিবাচক, তাতে অর্থ দাঁড়ায় কারও মালিকানার অংশ না হয়ে তার পক্ষে কাজ করা। বিনিময়ে কিছু অর্থপ্রাপ্তি এবং নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া।
আমাদের এই অঞ্চলে প্রথমে বহুলভাবে শব্দটির প্রয়োগ হয় পাটের দালাল হিসেবে। এই দালালেরা সাধারণ চাষিদের কাছ থেকে পাট কিনে বড় বড় কোম্পানির কাছে বিক্রি করত। শব্দটি পাকিস্তান আমলে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। পূর্ব বাংলার জনগণ থেকে বিযুক্ত পাকিস্তানের স্বার্থে কাজ করার অভিধা হিসেবে। যারাই পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলত, তাদের বলা হতো দালাল। এই দালাল শব্দটি ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এই দালালেরা পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে নরঘাতক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চর হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিজাতীয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর খুব প্রয়োজনীয় একটি অংশ হয়ে পড়ে তারা। বহু দেশপ্রেমিককে হত্যা করার পেছনে এদের কারসাজি ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে তাদের বিচারও শুরু হয়। সেই বিচার কয়েক বছর আগে কার্যকর হতে থাকে। কিন্তু দালালির অবসান হয় না।
বর্তমানে দেশে অনেকেই কোনো রাজনৈতিক দল না করেও দালাল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভিন্ন পরিচয়ে এবং ভিন্ন কর্মকাণ্ডের এই দালালদের পুনরায় আবির্ভাব হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে দালালের প্রয়োজন হয় এবং এই দালালেরা এত সক্রিয় যে যেকোনো জায়গায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা মাঠে নেমে পড়ে। চাকরির নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে তাদের ধাপে ধাপে পরিচয়। বিপুল অর্থের বিনিময়ে সরকারি চাকরির নিয়োগে তারা নিশ্চয়তা দেয়। তাদের পরীক্ষা দিতে হয় না, দিলে খাতা সাদা রেখে এলেও হয়, মানে কোনো কিছু লিখতে হয় না। এই দালালেরা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে। আগাম টাকা নিয়ে তারা কাজে নেমে পড়ে এবং কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে টাকা ফেরত দিয়ে দেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে টাকা ফেরত দেয়ও না।
আরেক ধরনের দালাল আছে যারা বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামে অগ্রিম অনেক টাকা নিয়ে নেমে পড়ে। তারা বিদেশে কর্মী পাঠানোর লোভ দেখিয়ে নানা ধরনের প্রতারণা করে অনেক পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আর আছে জায়গা-জমি, বাড়িঘর বিক্রির দালাল। তারাও বেশ ভালো অঙ্কের টাকা নিয়ে এ কাজটি করে থাকে এবং এদের ছাড়া বড় ধরনের কোনো বিক্রিবাট্টা সম্ভব নয়।
এরপর আছে গাড়ির দালালি। গাড়ি বেচাকেনার জন্যও একটা দালাল বাহিনী সব সময় সক্রিয় আছে। একটা বড় অমানবিক দালালি চলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে। রোগী ভর্তি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা—এ রকম পদে পদে এই দালালেরা সক্রিয়। সবচেয়ে দুর্ধর্ষ দালালি হচ্ছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। এ এক বিশাল ব্যবসা। মফস্বল শহরগুলোতে মোটরসাইকেল নিয়ে এই দালালেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। সুস্থ মানুষকে রোগী বানিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ক্লিনিকে নিয়ে আসে। ডাক্তাররা রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য প্রেসক্রিপশন দিয়ে দেন এবং বিনিময়ে তারা সরাসরি একটা কমিশন পেয়ে থাকে। এতে এখন আর কোনো রাখঢাক নেই, কোনো গোপনীয়তা নেই। হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং সেই সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোও ব্যবসার দিক থেকে সবার ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে।
আরেক ধরনের উচ্চমার্গের দালাল আছে সরকারি কাজ বাগানোর জন্য, আর তাদের কোনো অফিস নেই। তবে আছে দামি গাড়ি এবং বিনোদনের জায়গা। তারা সব রকম কায়দায় ক্ষমতাবানদের প্রভাবিত করে থাকে এবং তাদের কমিশনের টাকা বিদেশে বসে পাওয়ারও ব্যবস্থা করে দেয়। বিদেশে এই দালালদের একটা সম্মানজনক নামও দেওয়া হয়েছে তা হলো, লবিং গ্রুপ। আর দেশি দালালেরা এখনো লবিং গ্রুপে উঠতে পারেনি। তবে কাজের দিক থেকে ওই লবিং গ্রুপের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী দেশি দালালেরা।
দালালদের প্রধান অস্ত্র দুর্নীতি। রাষ্ট্রের অর্থ তাদের মাধ্যমে প্রতিদিন বিদেশে চলে যাচ্ছে। তারা শিক্ষাব্যবস্থাটাকে নিয়োগ ও ভর্তি-বাণিজ্যের মাধ্যমে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে। এই দালালির সূচনা সাধারণত হয়ে থাকে জবাবদিহিবিহীন সরকারের সময়ে। পাকিস্তানে সামরিক শাসনের সময়ে এগুলো শেখানো হয়েছিল। আমাদের দেশেও পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে এসব হয়েছে। কিন্তু নব্বইয়ের পর দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলেও এই দালালদের অবসান তো হয়ইনি; বরং আরও সক্রিয় হয়ে নতুন নতুন পথে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে বল্গাহীন ঊর্ধ্বগতি, তার পেছনেও এই দালালদের ভূমিকা সর্বাগ্রে। কৃষকের কাছ থেকে যে মূল্যে তারা খাদ্যশস্য, শাকসবজি কেনে, তা বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে শহরের বাজারগুলোতে বিক্রি করে। মহাশক্তিশালী এই ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে যেমন দালালেরা আছে, তেমনি আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন এবং বর্তমানের ব্যবসায়ী সমৃদ্ধ শাসকগোষ্ঠী।
আমাদের জাতীয় সংসদে যেখানে অধিকাংশ সংসদ সদস্যই ব্যবসায়ী, সেখানে রাষ্ট্রটা ব্যবসায়ীদের খপ্পরে জিম্মি। যে দালালদের কথা এতক্ষণ বলছিলাম, তাদের শ্রেণিবিন্যাসও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামপর্যায়ের দালালটি অতিসাধারণ। উপজেলায় সে আরেকটু ক্ষমতাবান। জেলায় তার ক্ষমতা আরও বেশি এবং রাজধানীতে সে এক বিরাট ব্যাপার। তার জীবনযাপন, ওঠা-বসা সবই একেবারে উচ্চশ্রেণির সঙ্গে। তারা রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে, কিন্তু এর অংশ হবে না। এই দালালেরাই একদা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে মিলে দেশটাকে শ্মশানে পরিণত করেছিল। বহুবার দুর্ভিক্ষে বাংলা, বিহার উড়িষ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ দিয়েছে।
মন্ত্রী-আমলারা রমজান আসার আগেই বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন, যেন জিনিসপত্রের দাম না বাড়ে। ব্যবসায়ীরা জানে এ শুধু কাগুজে বাঘের হুংকার। দালালেরা মুচকি মুচকি হাসে, সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে বলে, কত দেখলাম! দালালদের একটা সুবর্ণ সময় যাচ্ছে। করোনার সময়ে চাকরিবাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এসব অবরুদ্ধ হয়েছিল। এখন তা খুলতে শুরু করেছে। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ঢাকা শহরে কোটি টাকার ওপরে গাড়ি। রাস্তাঘাট সংকীর্ণ হলেও মুড়ি-মুড়কির মতো গাড়ি বিক্রি হচ্ছে এবং যথারীতি বিদেশে টাকা পাচারও বন্ধ হচ্ছে না। আমাদের গীতিকবিরা একটা সুবিধা করে দিয়েছেন যে দেশকে ভালোবাসা মানে প্রকৃতির জয়গান করা। দেশকে ভালোবাসা যে মানুষকে ভালোবাসা, দেশের সম্পদ রক্ষা করা এবং মানুষের জীবনকে কল্যাণকর করে তোলা, তা কোনো দেশাত্মবোধক গানে প্রকাশ হয় না। কাজেই মানুষকে বোকা বানানো এখানে সবচেয়ে সহজ।
অসহায় মানুষ জানে যে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তাই একমাত্র উপায় অর্থ। আর এই অর্থ উপার্জনের এক তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছেন রাজনীতিক, আমলা, এনজিওর মালিকসহ সবাই। বহুদিন ধরেই, বিশেষ করে সামরিক শাসক এরশাদের সময় থেকে রাজনীতির জন্য অর্থ একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সর্বত্রই যেন তাদের টাকার তীব্র প্রয়োজন। সেই টাকা তারা আংশিক ভোগও করে, বাকিটা পিঁপড়ে খেয়ে নেয়। চাটার দল সব চেটেপুটে খেয়েদেয়ে দেশটাকে নিঃস্ব করে দেয়। আমরা যখন ঢাকা শহরের কোনো অভিজাত এলাকার স্থাপনাগুলো লক্ষ করি, দেখতে পাই অনেক অজানা-অচেনা মালিকদের হাতে বিশাল বিশাল ঘরবাড়ি ও টাওয়ার রয়েছে। এসব টাওয়ারের মালিকেরা রাজনীতিক, আমলা, দালাল এবং একেবারেই নাম-পরিচয়হীন ব্যক্তিরা। আদিতে ডিআইটি এবং পরে রাজউক তাদের সেবাদাস হয়ে বড় বড় প্লট হস্তান্তর করেছে। এর মধ্যে একটা বড় অংশের আয়ের উৎস অজানা। ছোটখাটো পিয়নের চাকরি করেও বহু বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক তারা। দুঃসাহসিক এসব চক্র একেবারেই ভিজে বিড়াল হয়ে দেশের সম্পদের একটা বড় অংশকে লুটপাট করে খাচ্ছে। কখনো কখনো তারা হঠাৎ করে নীতিনির্ধারণীর মতো কাজে চলে যায়।
আমাদের দেশটা আয়তনে ছোট হলেও, সম্পদের দিক থেকে অত্যন্ত প্রাচুর্যপূর্ণ। কিন্তু মানুষ দরিদ্র। দেশ ধনী কিন্তু মানুষ দরিদ্র। একদা আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার দেশগুলো দেখলে বিদেশিরা বলত, ‘রিচ কান্ট্রি বাট পুওর পিপল’, তখন ঔপনিবেশিক শক্তিকে দায়ী করা হতো। সেটা সত্যও ছিল। এই পূর্ব বাংলা থেকে আওরঙ্গজেব বছরে এক কোটি টাকা রাজস্ব নিয়ে যুদ্ধ চালাত। একদা পূর্ব বাংলার একটি শহরের সমান সম্পদ ইংল্যান্ডে ছিল না। অথচ পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের একটি বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের সম্পদের সমান সম্পদ সারা বাংলায় ছিল না।
আমরা নির্বিবাদে এখনো লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিচ্ছি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে কি এই দুঃস্বপ্ন নিয়েই দেশ স্বাধীন করার ব্রত গ্রহণ করা হয়েছিল?
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
বহু বছর আর বহু শতাব্দী অতিক্রম করে একটি শব্দ ভারতবর্ষে চালু হয়েছে তা হলো, দালাল। দালাল শব্দটি সম্ভবত ফারসি অথবা আরবি। সংস্কৃত, হিন্দি বা বাংলা নয়। প্রথম দিকে শব্দটি হয়তো ছিল একটু ইতিবাচক, তাতে অর্থ দাঁড়ায় কারও মালিকানার অংশ না হয়ে তার পক্ষে কাজ করা। বিনিময়ে কিছু অর্থপ্রাপ্তি এবং নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া।
আমাদের এই অঞ্চলে প্রথমে বহুলভাবে শব্দটির প্রয়োগ হয় পাটের দালাল হিসেবে। এই দালালেরা সাধারণ চাষিদের কাছ থেকে পাট কিনে বড় বড় কোম্পানির কাছে বিক্রি করত। শব্দটি পাকিস্তান আমলে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। পূর্ব বাংলার জনগণ থেকে বিযুক্ত পাকিস্তানের স্বার্থে কাজ করার অভিধা হিসেবে। যারাই পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলত, তাদের বলা হতো দালাল। এই দালাল শব্দটি ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এই দালালেরা পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে নরঘাতক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চর হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিজাতীয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর খুব প্রয়োজনীয় একটি অংশ হয়ে পড়ে তারা। বহু দেশপ্রেমিককে হত্যা করার পেছনে এদের কারসাজি ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে তাদের বিচারও শুরু হয়। সেই বিচার কয়েক বছর আগে কার্যকর হতে থাকে। কিন্তু দালালির অবসান হয় না।
বর্তমানে দেশে অনেকেই কোনো রাজনৈতিক দল না করেও দালাল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভিন্ন পরিচয়ে এবং ভিন্ন কর্মকাণ্ডের এই দালালদের পুনরায় আবির্ভাব হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে দালালের প্রয়োজন হয় এবং এই দালালেরা এত সক্রিয় যে যেকোনো জায়গায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা মাঠে নেমে পড়ে। চাকরির নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে তাদের ধাপে ধাপে পরিচয়। বিপুল অর্থের বিনিময়ে সরকারি চাকরির নিয়োগে তারা নিশ্চয়তা দেয়। তাদের পরীক্ষা দিতে হয় না, দিলে খাতা সাদা রেখে এলেও হয়, মানে কোনো কিছু লিখতে হয় না। এই দালালেরা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে। আগাম টাকা নিয়ে তারা কাজে নেমে পড়ে এবং কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে টাকা ফেরত দিয়ে দেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে টাকা ফেরত দেয়ও না।
আরেক ধরনের দালাল আছে যারা বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামে অগ্রিম অনেক টাকা নিয়ে নেমে পড়ে। তারা বিদেশে কর্মী পাঠানোর লোভ দেখিয়ে নানা ধরনের প্রতারণা করে অনেক পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আর আছে জায়গা-জমি, বাড়িঘর বিক্রির দালাল। তারাও বেশ ভালো অঙ্কের টাকা নিয়ে এ কাজটি করে থাকে এবং এদের ছাড়া বড় ধরনের কোনো বিক্রিবাট্টা সম্ভব নয়।
এরপর আছে গাড়ির দালালি। গাড়ি বেচাকেনার জন্যও একটা দালাল বাহিনী সব সময় সক্রিয় আছে। একটা বড় অমানবিক দালালি চলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে। রোগী ভর্তি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা—এ রকম পদে পদে এই দালালেরা সক্রিয়। সবচেয়ে দুর্ধর্ষ দালালি হচ্ছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। এ এক বিশাল ব্যবসা। মফস্বল শহরগুলোতে মোটরসাইকেল নিয়ে এই দালালেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। সুস্থ মানুষকে রোগী বানিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ক্লিনিকে নিয়ে আসে। ডাক্তাররা রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য প্রেসক্রিপশন দিয়ে দেন এবং বিনিময়ে তারা সরাসরি একটা কমিশন পেয়ে থাকে। এতে এখন আর কোনো রাখঢাক নেই, কোনো গোপনীয়তা নেই। হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং সেই সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোও ব্যবসার দিক থেকে সবার ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে।
আরেক ধরনের উচ্চমার্গের দালাল আছে সরকারি কাজ বাগানোর জন্য, আর তাদের কোনো অফিস নেই। তবে আছে দামি গাড়ি এবং বিনোদনের জায়গা। তারা সব রকম কায়দায় ক্ষমতাবানদের প্রভাবিত করে থাকে এবং তাদের কমিশনের টাকা বিদেশে বসে পাওয়ারও ব্যবস্থা করে দেয়। বিদেশে এই দালালদের একটা সম্মানজনক নামও দেওয়া হয়েছে তা হলো, লবিং গ্রুপ। আর দেশি দালালেরা এখনো লবিং গ্রুপে উঠতে পারেনি। তবে কাজের দিক থেকে ওই লবিং গ্রুপের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী দেশি দালালেরা।
দালালদের প্রধান অস্ত্র দুর্নীতি। রাষ্ট্রের অর্থ তাদের মাধ্যমে প্রতিদিন বিদেশে চলে যাচ্ছে। তারা শিক্ষাব্যবস্থাটাকে নিয়োগ ও ভর্তি-বাণিজ্যের মাধ্যমে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে। এই দালালির সূচনা সাধারণত হয়ে থাকে জবাবদিহিবিহীন সরকারের সময়ে। পাকিস্তানে সামরিক শাসনের সময়ে এগুলো শেখানো হয়েছিল। আমাদের দেশেও পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে এসব হয়েছে। কিন্তু নব্বইয়ের পর দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলেও এই দালালদের অবসান তো হয়ইনি; বরং আরও সক্রিয় হয়ে নতুন নতুন পথে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে বল্গাহীন ঊর্ধ্বগতি, তার পেছনেও এই দালালদের ভূমিকা সর্বাগ্রে। কৃষকের কাছ থেকে যে মূল্যে তারা খাদ্যশস্য, শাকসবজি কেনে, তা বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে শহরের বাজারগুলোতে বিক্রি করে। মহাশক্তিশালী এই ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে যেমন দালালেরা আছে, তেমনি আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন এবং বর্তমানের ব্যবসায়ী সমৃদ্ধ শাসকগোষ্ঠী।
আমাদের জাতীয় সংসদে যেখানে অধিকাংশ সংসদ সদস্যই ব্যবসায়ী, সেখানে রাষ্ট্রটা ব্যবসায়ীদের খপ্পরে জিম্মি। যে দালালদের কথা এতক্ষণ বলছিলাম, তাদের শ্রেণিবিন্যাসও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামপর্যায়ের দালালটি অতিসাধারণ। উপজেলায় সে আরেকটু ক্ষমতাবান। জেলায় তার ক্ষমতা আরও বেশি এবং রাজধানীতে সে এক বিরাট ব্যাপার। তার জীবনযাপন, ওঠা-বসা সবই একেবারে উচ্চশ্রেণির সঙ্গে। তারা রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে, কিন্তু এর অংশ হবে না। এই দালালেরাই একদা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে মিলে দেশটাকে শ্মশানে পরিণত করেছিল। বহুবার দুর্ভিক্ষে বাংলা, বিহার উড়িষ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ দিয়েছে।
মন্ত্রী-আমলারা রমজান আসার আগেই বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন, যেন জিনিসপত্রের দাম না বাড়ে। ব্যবসায়ীরা জানে এ শুধু কাগুজে বাঘের হুংকার। দালালেরা মুচকি মুচকি হাসে, সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে বলে, কত দেখলাম! দালালদের একটা সুবর্ণ সময় যাচ্ছে। করোনার সময়ে চাকরিবাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এসব অবরুদ্ধ হয়েছিল। এখন তা খুলতে শুরু করেছে। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ঢাকা শহরে কোটি টাকার ওপরে গাড়ি। রাস্তাঘাট সংকীর্ণ হলেও মুড়ি-মুড়কির মতো গাড়ি বিক্রি হচ্ছে এবং যথারীতি বিদেশে টাকা পাচারও বন্ধ হচ্ছে না। আমাদের গীতিকবিরা একটা সুবিধা করে দিয়েছেন যে দেশকে ভালোবাসা মানে প্রকৃতির জয়গান করা। দেশকে ভালোবাসা যে মানুষকে ভালোবাসা, দেশের সম্পদ রক্ষা করা এবং মানুষের জীবনকে কল্যাণকর করে তোলা, তা কোনো দেশাত্মবোধক গানে প্রকাশ হয় না। কাজেই মানুষকে বোকা বানানো এখানে সবচেয়ে সহজ।
অসহায় মানুষ জানে যে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তাই একমাত্র উপায় অর্থ। আর এই অর্থ উপার্জনের এক তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছেন রাজনীতিক, আমলা, এনজিওর মালিকসহ সবাই। বহুদিন ধরেই, বিশেষ করে সামরিক শাসক এরশাদের সময় থেকে রাজনীতির জন্য অর্থ একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সর্বত্রই যেন তাদের টাকার তীব্র প্রয়োজন। সেই টাকা তারা আংশিক ভোগও করে, বাকিটা পিঁপড়ে খেয়ে নেয়। চাটার দল সব চেটেপুটে খেয়েদেয়ে দেশটাকে নিঃস্ব করে দেয়। আমরা যখন ঢাকা শহরের কোনো অভিজাত এলাকার স্থাপনাগুলো লক্ষ করি, দেখতে পাই অনেক অজানা-অচেনা মালিকদের হাতে বিশাল বিশাল ঘরবাড়ি ও টাওয়ার রয়েছে। এসব টাওয়ারের মালিকেরা রাজনীতিক, আমলা, দালাল এবং একেবারেই নাম-পরিচয়হীন ব্যক্তিরা। আদিতে ডিআইটি এবং পরে রাজউক তাদের সেবাদাস হয়ে বড় বড় প্লট হস্তান্তর করেছে। এর মধ্যে একটা বড় অংশের আয়ের উৎস অজানা। ছোটখাটো পিয়নের চাকরি করেও বহু বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক তারা। দুঃসাহসিক এসব চক্র একেবারেই ভিজে বিড়াল হয়ে দেশের সম্পদের একটা বড় অংশকে লুটপাট করে খাচ্ছে। কখনো কখনো তারা হঠাৎ করে নীতিনির্ধারণীর মতো কাজে চলে যায়।
আমাদের দেশটা আয়তনে ছোট হলেও, সম্পদের দিক থেকে অত্যন্ত প্রাচুর্যপূর্ণ। কিন্তু মানুষ দরিদ্র। দেশ ধনী কিন্তু মানুষ দরিদ্র। একদা আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার দেশগুলো দেখলে বিদেশিরা বলত, ‘রিচ কান্ট্রি বাট পুওর পিপল’, তখন ঔপনিবেশিক শক্তিকে দায়ী করা হতো। সেটা সত্যও ছিল। এই পূর্ব বাংলা থেকে আওরঙ্গজেব বছরে এক কোটি টাকা রাজস্ব নিয়ে যুদ্ধ চালাত। একদা পূর্ব বাংলার একটি শহরের সমান সম্পদ ইংল্যান্ডে ছিল না। অথচ পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের একটি বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের সম্পদের সমান সম্পদ সারা বাংলায় ছিল না।
আমরা নির্বিবাদে এখনো লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিচ্ছি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে কি এই দুঃস্বপ্ন নিয়েই দেশ স্বাধীন করার ব্রত গ্রহণ করা হয়েছিল?
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে