ভাষা নিয়ে ভেসে চলা

মাহমুদুল মাসুদ মুক্তিযোদ্ধা
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭: ৪৬

ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা ভাষা নিয়ে হইচই আর সাদাকালো পোশাক নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। তারপর আবার পরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নীরবতা। মাঝখানে পয়লা বৈশাখে আবার বাঙালিত্ব জেগে ওঠে। লাল-সাদা পোশাক নিয়ে পান্তা-ইলিশ। এতে দোষের কিছু নেই; বরং সংস্কারমুক্ত দুটো বিষয় বাঙালিদের অল্প সময়ের জন্য হলেও এক ও ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলে। আর বাংলা ভাষা থেকেই তো বাংলাদেশের সৃষ্টি। একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ছাব্বিশে মার্চ—এক সুতোয় গাঁথা। আবু হেনা মোস্তফা কামালের অবিস্মরণীয় গানের কথায়, ‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা, সেই থেকে শুরু দিনবদলের পালা’। 

ভাষা নদীর মতো প্রবহমান। ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’—ভাষার বৈশিষ্ট্য। বাংলা ভাষায় যে কেবল ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষার শব্দ ঢুকেছে, তা-ই নয়। ইংরেজিতেও বাংলা শব্দ ঢুকেছে। যেমন পথ, বাংলো, রায়ট, ডিঙ্গি, অবতার, গুরু, পণ্ডিত, মোগল, জঙ্গল, টিপয় (তেপায়া), নার্ড (নারদ), ইয়োগা (যোগ) ইত্যাদি। যদিও সাহেবরা এগুলোকে হিন্দুস্তানি শব্দ বলে অভিধানে উল্লেখ করেছেন। কারণ, কোনো বাঙালি এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি এবং প্রতিবাদ করেনি।

পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাভাষী রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতে বাংলা ভাষা আছে, অনেক ভাষার মধ্যে প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সংখ্যালঘু ভাষা হিসেবে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের দায়িত্ব অনেক। এই ভাষাকে রক্ষা করা এবং সম্মানের সঙ্গে রাখা কঠিন। এটাকে ছেলেখেলা মনে করে হালকাভাবে নেওয়া ঠিক নয়। শুধু মুখে বললেই হবে না যে ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’। ইদানীং অনেক বেসরকারি গণমাধ্যম এই ভাষাকে নিয়ে রীতিমতো ছিনিমিনি খেলছে। কাঁচা পয়সার গরমে ভাষা অতিষ্ঠ। মনে হয় এসব দেখার কেউ নেই। 

পশ্চিমবঙ্গ
পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা এখন ‘বিন্দাস’, আর সেখানকার লোকজন এখন ‘ঝাক্কাস’। তারা এখন ‘কান খুলে শুনে’ যা হলো হিন্দি সিনেমার সংলাপ ‘কান খুল কর সুন্ লো’র বঙ্গানুবাদ। কে কত ভালো হিন্দি বলতে পারে এর প্রতিযোগিতা চলে। এমনকি ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলীর মতো তারকারা নিজের নামটা পর্যন্ত বাংলা টেলিভিশনে হিন্দি কায়দায় বলেন, ‘সাঔরাভ’। বেসরকারি বাংলা টেলিভিশন সিরিয়ালে হিন্দি গান বাংলা ভাষাকে জাতে তুলছে। সেই সত্যজিৎ রায়ের বাঙালি আর নেই।

অথচ বাংলা ব্যাকরণে চলতি ভাষার সংজ্ঞা আমাদের স্কুলের বইয়ে পড়েছি—চলতি ভাষা হলো পশ্চিমবঙ্গের কথ্য ভাষা, বিশেষ করে যা নদীয়ার শান্তিপুর অঞ্চলে বলা হয়। যেমন ‘রিসিভড ইংলিশ’ বা মানসম্পন্ন ইংরেজি হলো যা মূলত দক্ষিণ ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডশায়ার এবং কেমব্রিজশায়ারের শিক্ষিত লোকেরা বলে থাকে। অনেকে তাকে ‘কিংস ইংলিশ’ বা ‘বিবিসি ইংলিশ’ও বলে। পশ্চিমবঙ্গেও চব্বিশ পরগনা এবং অন্যান্য জেলার কথার মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। কলকাতার ক্যালকেশিয়ান, ঢাকাই কুট্টি বা লন্ডনের ককনি স্পষ্টত ভিন্ন ধরনের উচ্চারণে স্থানীয় কথ্য ভাষা। 
 
বাংলাদেশ 
আগের পূর্ব বাংলা এখনকার বাংলাদেশ রাষ্ট্র, যেখানে আগের ১৭ জেলার ১৭ রকমের আঞ্চলিক ভাষা, যার একটি বিশাল অভিধান ভাষাবিজ্ঞানী ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র তত্ত্বাবধানে সংকলিত এবং বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। পূর্ববঙ্গের হরেক রকম আঞ্চলিক ভাষার কারণে ব্রিটিশ আমল থেকেই অবিভক্ত বাংলায় মানসম্পন্ন কথ্য ভাষা হিসেবে চলতি ভাষাকে গ্রহণ করা হয়। লেখ্য ভাষা হিসেবে সাধু এবং চলতি—দুটোই চলছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাধু ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। কেবল অধ্যাপক ডক্টর সলিমুল্লাহ খান এককভাবে একে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর চলতি ভাষা বলতে এখন মনে হয় কিছু নেই। চলতি ভাষা বললে তাতে কেমন ভারতীয় গন্ধ বেরোয়। তাই এখন সব প্রমিত ভাষা!

দুঃখের বিষয়, এখন কিছু বাঙালি টাকার জোরে ভাষা নিয়ে যা খুশি তা-ই করছে। টাকার জোরে গণমাধ্যমের মালিক—তাই ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। যেমন দক্ষিণ না বলে এখন বলে ‘সাউথ’। উত্তরকে বলে ‘নর্থ’। যথা: সাউথ কোরিয়া, সাউথ আফ্রিকা, নর্থ কোরিয়া ইত্যাদি। যোগব্যায়ামকে বলে ইয়োগা। তারিখকে যা ইচ্ছা তা-ই বলে। যেমন সাত জানুয়ারি, এক ফেব্রুয়ারি, একুশ ফেব্রুয়ারি, সাত মার্চ, সতেরো মার্চ, ছাব্বিশ মার্চ, পনেরো আগস্ট, ষোলো ডিসেম্বর ইত্যাদি। সাতই, পয়লা, একুশে, সতেরোই, ছাব্বিশে, পনেরোই, ষোলোই আর বলে না। ওগুলো নাকি সেকেলে! এ বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ভাষাবিদ নরেন বিশ্বাসের উচ্চারণ অভিধান অনুসরণ করার। কিন্তু তারা থোড়াই পরোয়া করে!

আর সাধু-চলতির মিশ্রণ বা গুরুচণ্ডালীর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এখানে অজ্ঞতাই মুখ্য। অনেকের ধারণা কেবল খাইয়া, যাইয়া, চলিয়া, বসিয়া, পড়িয়া ইত্যাদি সাধু। এদের চলতি রূপ (খেয়ে, যেয়ে, চলে, বসে, পড়ে) করলেই সব ঠিক। আর কিছু করার নেই। শিক্ষকও তো সে রকম পেয়েছে তারা! কিন্তু আরও যে অনেক কিছু আছে, তা শেখাবে কে? 

এফএম ব্যান্ডের বেতারে একশ্রেণির অর্বাচীন তরুণ-তরুণীর হাতে পড়ে বাংলা ভাষার ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা, যা ভুঁইফোড় সংস্কৃতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বেসরকারি টেলিভিশনে খবরের মান বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় তলানিতে। কায়দা করে এখন বলা হয় সংবাদ উপস্থাপক। পাঠক নয়। উপস্থাপিকা বা পাঠিকাও নয়। যেন নারী-পুরুষ একাকার হয়ে গেছে। এটা নাকি আধুনিক বাংলা! অনেকে খবর পড়েন, নিজের নামটা পর্যন্ত স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পারেন না। এখানে যোগ্যতার থেকে মালিকদের এবং কর্তাব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন-পরিচিতদের প্রাধান্য বেশি। অথচ পাকিস্তান আমলেও সংবাদপাঠের মানে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের থেকে অনেক ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে ছিলাম।

যাঁদের কথা এখনো মনে পড়ে, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন: নুরুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম সরকার, কাফি খান, দাউদ খান মজলিস, সরকার কবিরুদ্দিন, তাজুল ইসলাম, সিরাজুল মজিদ মামুন, রামেন্দু মজুমদার, রোকেয়া হায়দার, মাসুমা খাতুন, দিলারা হাশেম প্রমুখ। বেতারে অনুষ্ঠান ঘোষণায় এনাম চৌধুরী, ফজলুল কবির, আজমেরী জামান (রেশমা)। আকাশবাণী দিল্লি থেকে খবর পড়তেন বিজন বোস, ইভা নাগ, নীলিমা সান্যাল প্রমুখ। আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠান ঘোষণায় কাজী সব্যসাচী, দিলীপ ঘোষ, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, যার সংবাদ পরিক্রমা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। কাজেই নিছক তোতা পাখির মতো ভুল উচ্চারণে অস্পষ্টভাবে খবর পড়ে গেলেই হলো না। দর্শক-শ্রোতাদের মনে স্থান করে নেওয়া সহজ নয়। 

কিন্তু শুদ্ধ-অশুদ্ধ ভাষা দেখবে কে? তথ্য মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিবের ওপর একসময় কিছুটা দায়িত্ব ছিল নজরদারি করার। কড়াকড়ি কোনো তদারকি ছিল না। এ জন্য বাংলা একাডেমিতে একটি নজরদারি শাখা বা মনিটরিং সেল করা যেতে পারে। শুধু শাখা থাকলেই হবে না; সেখানে উপযুক্ত লোক থাকতে হবে। উদ্দেশ্য হবে শুধু ভাষার শুদ্ধতা দেখা, কোনো নিয়ন্ত্রণ নয়। বর্তমানে বাংলা একাডেমির প্রধান কাজ হয়ে গেছে বইমেলার আয়োজন করা।

বাংলা ভাষা এক ও অভিন্ন, যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন, বলেছেন। এ ভাষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারও নেই। সে জন্যই রেডিও-টেলিভিশনের অনুমোদনের সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া অনেক শর্তের মধ্যে একটি শর্ত থাকে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকৃতি করা যাবে না। শর্ত না মানলে অনুমোদন বাতিল করা যেতে পারে, অর্থাৎ বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে।

শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়, ভাষা ও সংস্কৃতির বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়ে এ ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে হলেও কিছু দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। যারা এ রকম করে, তারা একে রাজনৈতিক হয়রানি, গণতন্ত্রের ওপর আঘাত, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ ইত্যাদি নানা রকম রং দেবে এবং দিনের পর দিন নিজেদের ইচ্ছাকৃত অপরাধ কখনো স্বীকার করবে না। তারা তখন বাঙালি থাকে না, বাংলাদেশি হয়ে যায় দলমত-নির্বিশেষে।

বাংলা ভাষা ও বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার এখন দ্বিখণ্ডিত। নববর্ষ, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ আলাদা, রবীন্দ্রজয়ন্তী আলাদা, নজরুলজয়ন্তী আলাদা। ইউরোপ-আমেরিকায় এত যুদ্ধবিগ্রহ-বিভাজন সত্ত্বেও তারিখ ভাগ হয়নি। পরাধীন বাংলায় পাকিস্তানিরা যা করতে পারেনি, তাদের এদেশীয় প্রেতাত্মারা এখন তা পেরেছে। তাই সময়ের দাবি একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যাতে ধুয়ে-মুছে যাবে নব্য পাকবাংলা আগ্রাসন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ফিরে যাবে একাত্তরের অভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতিতে। অপমানে সেদিন আবার জ্বলে উঠবে বর্ণমালা, আর সেই থেকে শুরু হবে দিনবদলের পালা।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত