মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের আলোচনা-সমালোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তবে এর শুরুটা বছর দুই আগে থেকেই লক্ষ করা গেছে। বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কিছু বাস্তব কারণ তখন ছিল। প্রথমত, করোনার অতিমারিতে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কায় পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। তৃতীয়ত, বর্তমানে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধও বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট বাড়িয়ে তোলে।
বাংলাদেশ প্রধানত আমদানিনির্ভর দেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক এই সংকটের কালে চরম মুদ্রাস্ফীতি, ডলারসংকট, টাকার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি কারণে আমদানি করা পণ্যের দাম ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের দাম আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে। আমাদের বাজারব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নিয়মনীতিতে পরিচালিত হয় না। সে কারণে আজ একটি পণ্যের দাম বাড়ছে তো কাল অন্যটির দামও বাড়ানো হচ্ছে। পণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে নানা অজুহাত, ডান হাত, বাম হাত, কালো হাত ও সিন্ডিকেটের হাতের কথা সবারই জানা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে আগে যেটুকু নীতি মেনে চলা হতো, এখন সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। লাভ এবং লোভ কী পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে আমাদের বাজারব্যবস্থায় জায়গা করে নিয়েছে তা সবার জানা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে কোনোভাবেই তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নিম্ন এবং সীমিত আয়ের মানুষদের কেনাকাটায় বড় ধরনের টান পড়ে গেছে। এ নিয়ে সাধারণ এমনকি মধ্যবিত্ত ঘরেও একধরনের চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা সহজে মেটানোর কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
সরকার এক-দেড় বছর থেকে টিসিবির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ন্যায্যমূল্যে কয়েকটি পণ্য সরবরাহ করছে। যার সুফলভোগী প্রায় এক কোটি পরিবার। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ—এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অতি ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে এমন সহায়তাও যেন যথেষ্ট নয়। সরকারের পক্ষে এভাবে সব মানুষকে ন্যায্যমূল্যে পণ্যসামগ্রী কেনাকাটার ব্যবস্থা করাও মোটের ওপর অসম্ভব ব্যাপার। সরকার দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্য নানাভাবে নানা উদ্যোগ নিলেও খুব একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এই সংকটে অনেক দেশ এখন বেশ অস্থিরতার ভেতর দিয়ে সময় পার করছে। আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি গত পনেরো বছরে যথেষ্ট সবল হওয়ায় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক আচরণকে এখনো মানুষ হজম করে চলতে পারছে। মানুষের মধ্যে বাজার নিয়ে অস্বস্তি ও ক্ষোভ আছে, কিন্তু না খেয়ে থাকার মতো কোনো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। এর কারণ হচ্ছে প্রায় দেড় দশক ধরে খাদ্য উৎপাদনে আমাদের বড় ধরনের সফলতা অর্জিত হয়েছে। সে কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরও নিয়মিত মুখে অন্ন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় কেনাকাটা অনেকের পক্ষেই করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থার মধ্যে একদিকে যেমন কিছু বাস্তবতা আছে, অন্যদিকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির প্রবণতাও গোটা বাজারব্যবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে। এখন প্রয়োজন হচ্ছে বাজারব্যবস্থা থেকে অব্যবস্থাপনা, মজুতদারি, কারসাজি, চাঁদাবাজি এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সূক্ষ্ম বিষয়গুলো রোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
গত দেড়-দুই বছরের বাজারের অস্বাভাবিক আচরণ দেখেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্যকে নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়টি এক নম্বর তালিকায় স্থান দিয়েছে। নির্বাচনে জয়লাভের পরপরই দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের চ্যালেঞ্জ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের কথা জানিয়েছেন। সরকার গঠনেও এবার তিনি বেশ কিছু নতুন মুখ মন্ত্রিসভায় এনেছেন।
যাঁরা এরই মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নানাভাবে উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিদিনই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নামিয়ে আনার বিষয়ে তাঁর অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন; বিশেষ করে যেসব কৃষিজ পণ্য দেশে উৎপাদিত হয়, সেগুলো আরও কীভাবে বেশি বেশি উৎপাদন করা যায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। দেশের এক ইঞ্চি জমিও যাতে পতিত না থাকে, সে জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছেন। অবশ্য তিনি অনেক আগে থেকেই এ কথাগুলো বলে আসছেন। বঙ্গবন্ধুও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একই কথা বলতেন। শেখ হাসিনা সরকার কৃষির ওপর শুরু থেকেই জোর দিয়েছিল বলেই দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন অনেক গুণ বেড়েছে।
আমাদের জনসংখ্যা একদিকে যেমন দ্রুতগতিতে বাড়ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও উন্নয়ন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাসস্থান নির্মাণের জন্য জমি ব্যবহার করছে। গ্রামাঞ্চলে খাল-বিল, পুকুর ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। চাষাবাদের জমিতেও রাস্তাঘাট, বসতি, এলাকা, বাজার, ইটভাটাসহ নানা স্থাপনা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে চাষাবাদযোগ্য জমি যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি খাল-বিল ও পুকুরে মাছ উৎপাদন ভয়ানকভাবে কমে গেছে। প্রয়োজনীয় তরিতরকারি, খাদ্যশস্য উৎপাদনের জায়গা অনেক এলাকাতেই ভয়ানকভাবে কমে গেছে।
আমাদের গ্রামীণ সমাজে অপরিকল্পিতভাবে উর্বর জমি নষ্ট করার ফলে এখন অনেক এলাকাতেই চাষাবাদের পরিসর কমে গেছে। মানুষ শহরের মতো বাজার থেকে কেনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাজারের চাহিদা মোতাবেক তরিতরকারি, শাকসবজি, মাছ, মাংস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় শস্য কেনাকাটার ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে তাদের। তবে চাহিদা মোতাবেক গ্রামীণ বাজারগুলোতে এখন আর সরবরাহ হচ্ছে না। ফলে খাদ্যশস্য, মাছ-মাংস, তরিতরকারিসহ কাঁচামালের দাম শহরের মতোই সরবরাহের ওপর নির্ভর করছে, দামও সারা দেশেই মোবাইল এবং মিডিয়ার কল্যাণে গ্রাম-শহরভেদে একই রকম।
অন্যদিকে দেশের যেসব অঞ্চলে এসব পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হয়, সেখানকার উৎপাদকদের চেয়ে ফড়িয়া এবং আড়তদারেরা নিজেদের সুবিধামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন, অধিক মুনাফা তুলে নেওয়ার ফন্দি-ফিকির করে যাচ্ছেন। প্রকৃত কৃষক এবং পণ্য উৎপাদনকারীরা দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির সময়েও ফড়িয়া, মহাজন, আড়তদারদের কারসাজির কারণে খুব একটা লাভ ঘরে তুলে নিতে পারছেন না। অনেকেই কৃষিজ জমি এখন ফসল উৎপাদনে খরচের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না। ফলে চাষবাস করার যোগ্য জমি অনেক এলাকায় পতিত থেকে যাচ্ছে। জমি এখন কেনাবেচার লাভজনক পণ্যে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু খাদ্যশস্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় তরিতরকারি উৎপাদনে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের কাঁচাবাজারে। সুতরাং সরকারকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যশস্য, তরিতরকারি, কাঁচামাল উৎপাদনের বাস্তব চিত্রটি আগে জরিপ করে দেখতে হবে। এরপর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহায়তায় দেশে চাষযোগ্য ভূমির পরিকল্পনা এবং কার্যকর ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জমির অপব্যবহার, বেচাকেনা, পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা রোধ করতে হবে। স্থানীয় সরকার এবং উপজেলা প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্তভাবে কৃষিজ জমির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বহুমুখী সমবায় সমিতি বা ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করার কোনো বিকল্প নেই।
ভারতে কয়েক যুগ ধরে বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি বিশেষ কমিশন কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। সে কারণে কোনো পণ্যের দামই যথেচ্ছভাবে সেখানে ওঠানামা করতে পারে না। আমাদের দেশে ২০১২ সালে কমপিটিশন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এর কোনো কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর সঙ্গে যেসব সমস্যা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে, সেগুলো দূর করতে হবে। কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় আইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পণ্য উৎপাদিত অঞ্চল থেকে কোথায়
কোথায় সরবরাহ করা যাবে দেশব্যাপী, এর একটি নেটওয়ার্কও কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
মধ্যস্বত্বভোগীর অবস্থান তুলে দিয়ে বাজার পর্যন্ত সমিতির মাধ্যমে সরবরাহের ব্যবস্থা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেগুলোর ব্যাপারেও তথ্যভিত্তিক আমদানি সচল রাখতে হবে। একচেটিয়া কারবারি ও করপোরেট হাউসগুলোর আধিপত্য বিস্তার, বাজার মেনুপুলেট করার সব কারসাজি বন্ধ করতে হবে। এরপরই কেবল বাজার ব্যবস্থাপনা তৈরি হতে পারে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া বাজার থেকে সরানোর বিকল্প কেবলই চাহিদা মোতাবেক পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ ও মূল্যব্যবস্থা নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করবে।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের আলোচনা-সমালোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তবে এর শুরুটা বছর দুই আগে থেকেই লক্ষ করা গেছে। বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কিছু বাস্তব কারণ তখন ছিল। প্রথমত, করোনার অতিমারিতে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কায় পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। তৃতীয়ত, বর্তমানে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধও বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট বাড়িয়ে তোলে।
বাংলাদেশ প্রধানত আমদানিনির্ভর দেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক এই সংকটের কালে চরম মুদ্রাস্ফীতি, ডলারসংকট, টাকার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি কারণে আমদানি করা পণ্যের দাম ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের দাম আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে। আমাদের বাজারব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নিয়মনীতিতে পরিচালিত হয় না। সে কারণে আজ একটি পণ্যের দাম বাড়ছে তো কাল অন্যটির দামও বাড়ানো হচ্ছে। পণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে নানা অজুহাত, ডান হাত, বাম হাত, কালো হাত ও সিন্ডিকেটের হাতের কথা সবারই জানা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে আগে যেটুকু নীতি মেনে চলা হতো, এখন সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। লাভ এবং লোভ কী পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে আমাদের বাজারব্যবস্থায় জায়গা করে নিয়েছে তা সবার জানা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে কোনোভাবেই তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নিম্ন এবং সীমিত আয়ের মানুষদের কেনাকাটায় বড় ধরনের টান পড়ে গেছে। এ নিয়ে সাধারণ এমনকি মধ্যবিত্ত ঘরেও একধরনের চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা সহজে মেটানোর কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
সরকার এক-দেড় বছর থেকে টিসিবির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ন্যায্যমূল্যে কয়েকটি পণ্য সরবরাহ করছে। যার সুফলভোগী প্রায় এক কোটি পরিবার। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ—এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অতি ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে এমন সহায়তাও যেন যথেষ্ট নয়। সরকারের পক্ষে এভাবে সব মানুষকে ন্যায্যমূল্যে পণ্যসামগ্রী কেনাকাটার ব্যবস্থা করাও মোটের ওপর অসম্ভব ব্যাপার। সরকার দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্য নানাভাবে নানা উদ্যোগ নিলেও খুব একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এই সংকটে অনেক দেশ এখন বেশ অস্থিরতার ভেতর দিয়ে সময় পার করছে। আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি গত পনেরো বছরে যথেষ্ট সবল হওয়ায় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক আচরণকে এখনো মানুষ হজম করে চলতে পারছে। মানুষের মধ্যে বাজার নিয়ে অস্বস্তি ও ক্ষোভ আছে, কিন্তু না খেয়ে থাকার মতো কোনো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। এর কারণ হচ্ছে প্রায় দেড় দশক ধরে খাদ্য উৎপাদনে আমাদের বড় ধরনের সফলতা অর্জিত হয়েছে। সে কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরও নিয়মিত মুখে অন্ন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় কেনাকাটা অনেকের পক্ষেই করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থার মধ্যে একদিকে যেমন কিছু বাস্তবতা আছে, অন্যদিকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির প্রবণতাও গোটা বাজারব্যবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে। এখন প্রয়োজন হচ্ছে বাজারব্যবস্থা থেকে অব্যবস্থাপনা, মজুতদারি, কারসাজি, চাঁদাবাজি এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সূক্ষ্ম বিষয়গুলো রোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
গত দেড়-দুই বছরের বাজারের অস্বাভাবিক আচরণ দেখেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্যকে নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়টি এক নম্বর তালিকায় স্থান দিয়েছে। নির্বাচনে জয়লাভের পরপরই দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের চ্যালেঞ্জ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের কথা জানিয়েছেন। সরকার গঠনেও এবার তিনি বেশ কিছু নতুন মুখ মন্ত্রিসভায় এনেছেন।
যাঁরা এরই মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নানাভাবে উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিদিনই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নামিয়ে আনার বিষয়ে তাঁর অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন; বিশেষ করে যেসব কৃষিজ পণ্য দেশে উৎপাদিত হয়, সেগুলো আরও কীভাবে বেশি বেশি উৎপাদন করা যায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। দেশের এক ইঞ্চি জমিও যাতে পতিত না থাকে, সে জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছেন। অবশ্য তিনি অনেক আগে থেকেই এ কথাগুলো বলে আসছেন। বঙ্গবন্ধুও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একই কথা বলতেন। শেখ হাসিনা সরকার কৃষির ওপর শুরু থেকেই জোর দিয়েছিল বলেই দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন অনেক গুণ বেড়েছে।
আমাদের জনসংখ্যা একদিকে যেমন দ্রুতগতিতে বাড়ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও উন্নয়ন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাসস্থান নির্মাণের জন্য জমি ব্যবহার করছে। গ্রামাঞ্চলে খাল-বিল, পুকুর ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। চাষাবাদের জমিতেও রাস্তাঘাট, বসতি, এলাকা, বাজার, ইটভাটাসহ নানা স্থাপনা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে চাষাবাদযোগ্য জমি যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি খাল-বিল ও পুকুরে মাছ উৎপাদন ভয়ানকভাবে কমে গেছে। প্রয়োজনীয় তরিতরকারি, খাদ্যশস্য উৎপাদনের জায়গা অনেক এলাকাতেই ভয়ানকভাবে কমে গেছে।
আমাদের গ্রামীণ সমাজে অপরিকল্পিতভাবে উর্বর জমি নষ্ট করার ফলে এখন অনেক এলাকাতেই চাষাবাদের পরিসর কমে গেছে। মানুষ শহরের মতো বাজার থেকে কেনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাজারের চাহিদা মোতাবেক তরিতরকারি, শাকসবজি, মাছ, মাংস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় শস্য কেনাকাটার ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে তাদের। তবে চাহিদা মোতাবেক গ্রামীণ বাজারগুলোতে এখন আর সরবরাহ হচ্ছে না। ফলে খাদ্যশস্য, মাছ-মাংস, তরিতরকারিসহ কাঁচামালের দাম শহরের মতোই সরবরাহের ওপর নির্ভর করছে, দামও সারা দেশেই মোবাইল এবং মিডিয়ার কল্যাণে গ্রাম-শহরভেদে একই রকম।
অন্যদিকে দেশের যেসব অঞ্চলে এসব পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হয়, সেখানকার উৎপাদকদের চেয়ে ফড়িয়া এবং আড়তদারেরা নিজেদের সুবিধামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন, অধিক মুনাফা তুলে নেওয়ার ফন্দি-ফিকির করে যাচ্ছেন। প্রকৃত কৃষক এবং পণ্য উৎপাদনকারীরা দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির সময়েও ফড়িয়া, মহাজন, আড়তদারদের কারসাজির কারণে খুব একটা লাভ ঘরে তুলে নিতে পারছেন না। অনেকেই কৃষিজ জমি এখন ফসল উৎপাদনে খরচের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না। ফলে চাষবাস করার যোগ্য জমি অনেক এলাকায় পতিত থেকে যাচ্ছে। জমি এখন কেনাবেচার লাভজনক পণ্যে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু খাদ্যশস্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় তরিতরকারি উৎপাদনে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের কাঁচাবাজারে। সুতরাং সরকারকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যশস্য, তরিতরকারি, কাঁচামাল উৎপাদনের বাস্তব চিত্রটি আগে জরিপ করে দেখতে হবে। এরপর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহায়তায় দেশে চাষযোগ্য ভূমির পরিকল্পনা এবং কার্যকর ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জমির অপব্যবহার, বেচাকেনা, পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা রোধ করতে হবে। স্থানীয় সরকার এবং উপজেলা প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্তভাবে কৃষিজ জমির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বহুমুখী সমবায় সমিতি বা ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করার কোনো বিকল্প নেই।
ভারতে কয়েক যুগ ধরে বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি বিশেষ কমিশন কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। সে কারণে কোনো পণ্যের দামই যথেচ্ছভাবে সেখানে ওঠানামা করতে পারে না। আমাদের দেশে ২০১২ সালে কমপিটিশন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এর কোনো কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর সঙ্গে যেসব সমস্যা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে, সেগুলো দূর করতে হবে। কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় আইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পণ্য উৎপাদিত অঞ্চল থেকে কোথায়
কোথায় সরবরাহ করা যাবে দেশব্যাপী, এর একটি নেটওয়ার্কও কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
মধ্যস্বত্বভোগীর অবস্থান তুলে দিয়ে বাজার পর্যন্ত সমিতির মাধ্যমে সরবরাহের ব্যবস্থা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেগুলোর ব্যাপারেও তথ্যভিত্তিক আমদানি সচল রাখতে হবে। একচেটিয়া কারবারি ও করপোরেট হাউসগুলোর আধিপত্য বিস্তার, বাজার মেনুপুলেট করার সব কারসাজি বন্ধ করতে হবে। এরপরই কেবল বাজার ব্যবস্থাপনা তৈরি হতে পারে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া বাজার থেকে সরানোর বিকল্প কেবলই চাহিদা মোতাবেক পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ ও মূল্যব্যবস্থা নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করবে।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে