এ কে এম শামসুদ্দিন
আমরা বাল্যকাল থেকেই শুনে এসেছি, শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ রূপকার। ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা ভেঙে শিক্ষকেরাই পারেন নতুন সমাজ গড়তে। শিক্ষকদের বলা হয় জীবনের চরিত্র গঠনের প্রথম গুরু, মানুষ গড়ার শ্রেষ্ঠ কারিগর। তাঁদের অসাধারণ পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক মাধুর্য ও স্নেহময় মধুর ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে ওঠেন আদর্শের প্রতীক। শিক্ষকেরাই জাতির বিবেক বলে বিবেচিত হন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু শিক্ষকের চরিত্র স্খলনের যে কিচ্ছা-কাহিনি শোনা যাচ্ছে, তা গোটা শিক্ষকসমাজের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঘটনা এত দিনের চেনা শিক্ষকদের আদর্শগত চরিত্রের ওপর কলঙ্কের কালিমা লেপন করে দিচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ—বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একের পর এক যে ঘটনা ঘটছে, তাতে শুধু নারী শিক্ষার্থীরাই নন, কখনো কখনো নারী শিক্ষকেরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গত দুই বছরে দেশের শীর্ষ ৫ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭টি যৌন হয়রানির ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু এমন অনেক ঘটনা আছে, যা সবার দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। হয়রানি কিংবা কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভুক্তভোগীরা অনেক ঘটনাই গোপন রাখেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অভিযোগ করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা আড়াল করে রাখে। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যা ও কাজী ফারজানা মীমের ধারাবাহিক হয়রানির ঘটনা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
অবন্তিকা ও মীম দুজনই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করে বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ফলে অবন্তিকা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এবং মীম জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ডিবির আশ্রয় চেয়েছেন। অবন্তিকার অভিযোগ, তাঁর যৌন হেনস্তাকারী সহপাঠী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধে। ওদিকে মীমের অভিযোগ, তাঁর শিক্ষক তাঁকে যৌন হয়রানি করেছেন। অভিযোগ দেওয়ায় তিনি নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ভীতসন্ত্রস্ত এই শিক্ষার্থী বলেন, অভিযোগ দেওয়ার পর তাঁকে অন্যায়ভাবে মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ দেওয়ার পর বিভাগীয় প্রধান যৌন নিপীড়কের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং তিনি মীমকে সেই অভিযোগ তুলে নিতে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। তাতে রাজি না হওয়ায়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে ভয় দেখানো হয়। শুধু তা-ই নয়, তাঁর জীবনহানির হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে মীমের অভিযোগ।
অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনার মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন হয়রানির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এসব তথ্য ধারাবাহিকভাবেই পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রক্টর অফিসের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক হয়রানির বিস্তর অভিযোগের কথা উল্লেখ আছে। এই চিত্র শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমন আরও অনেক অভিযোগ আছে। দেখা গেছে, শিক্ষক নামের এসব দুশ্চরিত্রের ব্যক্তি প্রথমে পছন্দের নারী শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে অনৈতিক প্রস্তাব দেন। প্রথমে বিভিন্ন ছলচাতুরীর মাধ্যমে ওই শিক্ষার্থীকে তাঁর প্রস্তাবে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। রাজি না হলে ভয়ভীতি দেখান, পরীক্ষার খাতায় কম নম্বর দেন। তারপরও রাজি না হলে ফেল করে দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো শিক্ষার্থী বাধ্য হন শিক্ষকের অনৈতিক প্রস্তাবে আত্মসমর্পণ করতে। অনেকে সে পথে পা না বাড়িয়ে প্রতিবাদী হন, তারপরও কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা না পেলে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো। শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের সহমর্মিতার মনোভাব থাকবে। তাঁদের মধ্যে একধরনের আত্মিক বন্ধন থাকতে হবে। শিক্ষককে হতে হবে সুব্যক্তিত্বের অধিকারী। শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁর আচরণ হবে প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। শিক্ষকও শিক্ষার্থীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মেলামেশা করবেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের মাধুর্যে যেন শিক্ষার্থী সহজেই আকৃষ্ট হন। তিনি হবেন সুবিবেচক, বিচক্ষণ ও পথপ্রদর্শক। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর কাছে প্রথমেই শিক্ষক হবেন এবং শেষেও তিনি শিক্ষকই থাকবেন। এ দেশের সমাজ সব সময়ই একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীর সহায়কের ভূমিকায় দেখতে চায়, নিপীড়কের ভূমিকায় নয়। শিক্ষক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘উত্তম শিক্ষক হবেন উত্তম ছাত্র, শিক্ষকের ছাত্রত্ব গ্রহণে তার মনের তারুণ্য নষ্ট হতে পারে না; বরং তিনি সব সময় ছাত্রের সুবিধা-অসুবিধা ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হবেন।’
২০০৯ সালে উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীকে অশালীন মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি, সাংকেতিক চিহ্ন প্রদর্শনসহ ইন্টারনেট ও মোবাইলে হয়রানিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ (ক) ধারায় যৌন হয়রানির সংজ্ঞার আওতাভুক্ত করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে যৌন হয়রানির বিচার শেষ করতে বলা হয়েছে। ব্যর্থ হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা আছে। উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠনের নির্দেশও দিয়েছিলেন। দেশের ৫৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৫টি এবং ১১৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৭টিতে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা সেল নামেও পরিচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এই সেল থাকা সত্ত্বেও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিচার চাইতে গিয়েও নারী শিক্ষার্থীরা নিজ শিক্ষকদের কাছ থেকেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দেখা যায়, যৌন হয়রানির বিচার যাঁরা করবেন, তাঁরাই অনেক সময় পক্ষপাতমূলক আচরণ করে থাকেন। এই সব শিক্ষক সহকর্মীদের রক্ষা করতে গিয়ে বিচারের নামে প্রহসন করে থাকেন। যখন এসব নিয়ে মিডিয়ায় হইচই পড়ে যায়, তখন কর্তৃপক্ষ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। কিন্তু এ ধরনের কয়টি ঘটনা মিডিয়ায় আসে। ফলে অধিকাংশ ঘটনারই কোনো বিচার হয় না। তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ভুক্তভোগীরা অধিকাংশ সময়েই যৌন হয়রানির প্রত্যাশিত বিচার পান না। বিচারহীনতা যৌন হয়রানি বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ। আমাদের দেশে আইন থাকলেও এর প্রয়োগের অভাবে যৌন হয়রানি দিন দিন বেড়েই চলেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনিই একসময় বলেছিলেন, ‘স্কুল-কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন নতুন কিছু নয়। আমরা এখনো যেসব পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে কাজ করছি বা যেসব পুরুষ শিক্ষক ছাত্রীদের পড়াচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ছাত্রীকে ছাত্রী হিসেবে দেখেন না। ফলে তাঁদের হাতে ছাত্রীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।’ অথচ একজন শিক্ষককে হতে হবে উচ্চ নৈতিক মানসম্পন্ন। তাঁকে এ ধরনের মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। তিনি থাকবেন সব প্রলোভনের ঊর্ধ্বে। এ জন্যই তিনি শিক্ষক। একসময় এ দেশের মুক্তি ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে বেরিয়ে আসতেন, শিক্ষক সমাজ তখন শিক্ষার্থীদের পাশেই থাকতেন। এসব আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের মুখে তখন তীব্র প্রতিবাদের স্লোগান শোনা গেছে। বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক এত তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে যে সেই শিক্ষার্থীরাই এখন শিক্ষকদের নামে কখনো ধর্ষক, কখনো নিপীড়ক, কখনো দালাল বলে স্লোগান দিচ্ছেন। অথচ ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক এমন হওয়ার কথা ছিল না।
যৌন হয়রানির বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যকরী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে তা নেই। যৌন হয়রানির সংজ্ঞায়ন, তদন্তপদ্ধতি, শাস্তি এবং নারী নির্যাতন দমন আইন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ কিংবা প্রচারণাও নেই। আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র প্রায় একই। এ ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বও কম নয়। উচ্চ আদালতের বেঁধে দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। যৌন হয়রানির শিকার শিক্ষার্থী যাতে অতি সহজেই কর্তৃপক্ষের কাছে নির্ভয়ে অভিযোগ করতে পারেন, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর প্রতি অসহযোগিতার মনোভাব পরিলক্ষিত হলেও যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, কতিপয় যৌন নিপীড়কের জন্য গোটা শিক্ষক সমাজকে কলঙ্কিত করার অধিকার কারও নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব সবারই। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব আরও বেশি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
আমরা বাল্যকাল থেকেই শুনে এসেছি, শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ রূপকার। ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা ভেঙে শিক্ষকেরাই পারেন নতুন সমাজ গড়তে। শিক্ষকদের বলা হয় জীবনের চরিত্র গঠনের প্রথম গুরু, মানুষ গড়ার শ্রেষ্ঠ কারিগর। তাঁদের অসাধারণ পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক মাধুর্য ও স্নেহময় মধুর ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে ওঠেন আদর্শের প্রতীক। শিক্ষকেরাই জাতির বিবেক বলে বিবেচিত হন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু শিক্ষকের চরিত্র স্খলনের যে কিচ্ছা-কাহিনি শোনা যাচ্ছে, তা গোটা শিক্ষকসমাজের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঘটনা এত দিনের চেনা শিক্ষকদের আদর্শগত চরিত্রের ওপর কলঙ্কের কালিমা লেপন করে দিচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ—বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একের পর এক যে ঘটনা ঘটছে, তাতে শুধু নারী শিক্ষার্থীরাই নন, কখনো কখনো নারী শিক্ষকেরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গত দুই বছরে দেশের শীর্ষ ৫ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭টি যৌন হয়রানির ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু এমন অনেক ঘটনা আছে, যা সবার দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। হয়রানি কিংবা কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভুক্তভোগীরা অনেক ঘটনাই গোপন রাখেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অভিযোগ করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা আড়াল করে রাখে। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যা ও কাজী ফারজানা মীমের ধারাবাহিক হয়রানির ঘটনা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
অবন্তিকা ও মীম দুজনই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করে বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ফলে অবন্তিকা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এবং মীম জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ডিবির আশ্রয় চেয়েছেন। অবন্তিকার অভিযোগ, তাঁর যৌন হেনস্তাকারী সহপাঠী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধে। ওদিকে মীমের অভিযোগ, তাঁর শিক্ষক তাঁকে যৌন হয়রানি করেছেন। অভিযোগ দেওয়ায় তিনি নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ভীতসন্ত্রস্ত এই শিক্ষার্থী বলেন, অভিযোগ দেওয়ার পর তাঁকে অন্যায়ভাবে মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ দেওয়ার পর বিভাগীয় প্রধান যৌন নিপীড়কের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং তিনি মীমকে সেই অভিযোগ তুলে নিতে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। তাতে রাজি না হওয়ায়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে ভয় দেখানো হয়। শুধু তা-ই নয়, তাঁর জীবনহানির হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে মীমের অভিযোগ।
অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনার মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন হয়রানির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এসব তথ্য ধারাবাহিকভাবেই পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রক্টর অফিসের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক হয়রানির বিস্তর অভিযোগের কথা উল্লেখ আছে। এই চিত্র শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমন আরও অনেক অভিযোগ আছে। দেখা গেছে, শিক্ষক নামের এসব দুশ্চরিত্রের ব্যক্তি প্রথমে পছন্দের নারী শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে অনৈতিক প্রস্তাব দেন। প্রথমে বিভিন্ন ছলচাতুরীর মাধ্যমে ওই শিক্ষার্থীকে তাঁর প্রস্তাবে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। রাজি না হলে ভয়ভীতি দেখান, পরীক্ষার খাতায় কম নম্বর দেন। তারপরও রাজি না হলে ফেল করে দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো শিক্ষার্থী বাধ্য হন শিক্ষকের অনৈতিক প্রস্তাবে আত্মসমর্পণ করতে। অনেকে সে পথে পা না বাড়িয়ে প্রতিবাদী হন, তারপরও কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা না পেলে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো। শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের সহমর্মিতার মনোভাব থাকবে। তাঁদের মধ্যে একধরনের আত্মিক বন্ধন থাকতে হবে। শিক্ষককে হতে হবে সুব্যক্তিত্বের অধিকারী। শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁর আচরণ হবে প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। শিক্ষকও শিক্ষার্থীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মেলামেশা করবেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের মাধুর্যে যেন শিক্ষার্থী সহজেই আকৃষ্ট হন। তিনি হবেন সুবিবেচক, বিচক্ষণ ও পথপ্রদর্শক। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর কাছে প্রথমেই শিক্ষক হবেন এবং শেষেও তিনি শিক্ষকই থাকবেন। এ দেশের সমাজ সব সময়ই একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীর সহায়কের ভূমিকায় দেখতে চায়, নিপীড়কের ভূমিকায় নয়। শিক্ষক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘উত্তম শিক্ষক হবেন উত্তম ছাত্র, শিক্ষকের ছাত্রত্ব গ্রহণে তার মনের তারুণ্য নষ্ট হতে পারে না; বরং তিনি সব সময় ছাত্রের সুবিধা-অসুবিধা ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হবেন।’
২০০৯ সালে উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীকে অশালীন মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি, সাংকেতিক চিহ্ন প্রদর্শনসহ ইন্টারনেট ও মোবাইলে হয়রানিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ (ক) ধারায় যৌন হয়রানির সংজ্ঞার আওতাভুক্ত করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে যৌন হয়রানির বিচার শেষ করতে বলা হয়েছে। ব্যর্থ হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা আছে। উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠনের নির্দেশও দিয়েছিলেন। দেশের ৫৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৫টি এবং ১১৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৭টিতে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা সেল নামেও পরিচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এই সেল থাকা সত্ত্বেও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিচার চাইতে গিয়েও নারী শিক্ষার্থীরা নিজ শিক্ষকদের কাছ থেকেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দেখা যায়, যৌন হয়রানির বিচার যাঁরা করবেন, তাঁরাই অনেক সময় পক্ষপাতমূলক আচরণ করে থাকেন। এই সব শিক্ষক সহকর্মীদের রক্ষা করতে গিয়ে বিচারের নামে প্রহসন করে থাকেন। যখন এসব নিয়ে মিডিয়ায় হইচই পড়ে যায়, তখন কর্তৃপক্ষ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। কিন্তু এ ধরনের কয়টি ঘটনা মিডিয়ায় আসে। ফলে অধিকাংশ ঘটনারই কোনো বিচার হয় না। তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ভুক্তভোগীরা অধিকাংশ সময়েই যৌন হয়রানির প্রত্যাশিত বিচার পান না। বিচারহীনতা যৌন হয়রানি বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ। আমাদের দেশে আইন থাকলেও এর প্রয়োগের অভাবে যৌন হয়রানি দিন দিন বেড়েই চলেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনিই একসময় বলেছিলেন, ‘স্কুল-কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন নতুন কিছু নয়। আমরা এখনো যেসব পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে কাজ করছি বা যেসব পুরুষ শিক্ষক ছাত্রীদের পড়াচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ছাত্রীকে ছাত্রী হিসেবে দেখেন না। ফলে তাঁদের হাতে ছাত্রীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।’ অথচ একজন শিক্ষককে হতে হবে উচ্চ নৈতিক মানসম্পন্ন। তাঁকে এ ধরনের মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। তিনি থাকবেন সব প্রলোভনের ঊর্ধ্বে। এ জন্যই তিনি শিক্ষক। একসময় এ দেশের মুক্তি ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে বেরিয়ে আসতেন, শিক্ষক সমাজ তখন শিক্ষার্থীদের পাশেই থাকতেন। এসব আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের মুখে তখন তীব্র প্রতিবাদের স্লোগান শোনা গেছে। বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক এত তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে যে সেই শিক্ষার্থীরাই এখন শিক্ষকদের নামে কখনো ধর্ষক, কখনো নিপীড়ক, কখনো দালাল বলে স্লোগান দিচ্ছেন। অথচ ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক এমন হওয়ার কথা ছিল না।
যৌন হয়রানির বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যকরী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে তা নেই। যৌন হয়রানির সংজ্ঞায়ন, তদন্তপদ্ধতি, শাস্তি এবং নারী নির্যাতন দমন আইন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ কিংবা প্রচারণাও নেই। আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র প্রায় একই। এ ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বও কম নয়। উচ্চ আদালতের বেঁধে দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। যৌন হয়রানির শিকার শিক্ষার্থী যাতে অতি সহজেই কর্তৃপক্ষের কাছে নির্ভয়ে অভিযোগ করতে পারেন, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর প্রতি অসহযোগিতার মনোভাব পরিলক্ষিত হলেও যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, কতিপয় যৌন নিপীড়কের জন্য গোটা শিক্ষক সমাজকে কলঙ্কিত করার অধিকার কারও নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব সবারই। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব আরও বেশি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে