জাবিতে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ পরিকল্পিত, নেপথ্যে মাদকের কারবার

সৌগত বসু, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯: ৪০
আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১: ৩৬

স্বামীকে হলে আটকে রেখে স্ত্রীকে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় উত্তপ্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এ নিয়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলন হচ্ছে দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন স্থানে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং সংশ্লিষ্ট হলের প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করেছেন আন্দোলনকারীরা।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও হলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ধর্ষণের এই ঘটনার সঙ্গে মাদকের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাদকের টাকা আদায় করার জন্য পরিকল্পনা করেই ওই ধর্ষণকাণ্ড ঘটানো হয় বলে জানা গেছে।

গত শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে এক ব্যক্তিকে আটকে রেখে তাঁর স্ত্রীকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। মামলার পর রোববার অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে সাভার মডেল ও আশুলিয়া থানা-পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, একই বিভাগের শিক্ষার্থী সাগর সিদ্দিকী, হাসানুজ্জামান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান।

এ মামলায় পলাতক রয়েছেন ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত মো. মামুনুর রশীদ ওরফে মামুন এবং স্বামীকে আটকে রাখায় সহায়তা ও মারধর করা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মুরাদ।

জানা গেছে, মামুন চিহ্নিত মাদক কারবারি। পারিবারিক সখ্যের কারণে ভুক্তভোগীর স্বামী নিয়মিত মামুনের সঙ্গে মাদক সেবন করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় মামুনের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন ভুক্তভোগীর স্বামী। পাওনা টাকা আদায় করতে না পেরে মামুন ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর পরিকল্পনা করে ধর্ষণকাণ্ড ঘটান মামুন-মোস্তাফিজুরেরা।

ইতিমধ্যেই পুলিশ মামুনের মাদক কারবার নিয়ে তথ্য পেয়েছে। মামুনের বিরুদ্ধে ৪টি মাদকসংশ্লিষ্ট মামলা রয়েছে। তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছেন দুবার। এর মধ্যে একটি ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি টেকনাফ থানায় এবং অন্যটি ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায়। দুবারই তিনি ইয়াবা বড়িসহ আটক হন। এ ছাড়া, তাঁর বিরুদ্ধে বগুড়া ও চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় একটি করে মামলা আছে।

ধর্ষণ ঘটনার নেপথ্য কারণ মামলার আসামি মামুনের মাদকসংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার পরিদর্শক মিজানুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, তদন্তের ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো কিছুই বাদ দিচ্ছেন না। সবকিছু মাথায় রেখেই তদন্ত করছেন।

হলে ব্যাচভিত্তিক ইয়াবা কারবার
হল সূত্রে জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলে চলে ব্যাচভিত্তিক ইয়াবা কারবার। প্রতিটি ব্যাচের এক বা একাধিকজনকে প্রতিনিধি বানিয়ে ইয়াবা কারবারে নেতৃত্ব দেওয়া হয়। সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচের যিনি রাজনৈতিক নেতা, তাঁর হাতে থাকে সব নিয়ন্ত্রণ। তিনি প্রতিটি ব্যাচে কারা ইয়াবা কারবার করবেন, সেটি ঠিক করে দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের এক কর্মী বলেন, এই হলের মূল ইয়াবা কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন ৪৩তম ব্যাচের এক ছাত্রলীগ কর্মী। এরপর তিনি ৪৪, ৪৫, ৪৬ ও ৪৭—এই চার ব্যাচের প্রতিনিধি নির্বাচন করে দিয়েছেন। তাঁরাই বিভিন্নভাবে এসব কারবার করে যাচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত মোস্তাফিজুরও ইয়াবা সেবন করেন। আর যে বহিরাগত মোস্তাফিজুরের সঙ্গে ওই দিন ছিলেন, তাঁর সঙ্গে সম্পর্কও ইয়াবা কারবারকেন্দ্রিক।

তবে এসব বিষয় অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান বলেন, তাঁর সংগঠন মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়েছে। এমন কেউ জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশ সূত্র বলছে, মামুনের সঙ্গে ভুক্তভোগীদের আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক ব্যবহার করেই ভুক্তভোগীকে ক্যাম্পাসে ডেকে নিয়ে আসেন মামুন।

ঢাকা জেলা (উত্তর) পুলিশ সুপার (পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আবদুল্লাহ কাফি আজকের পত্রিকাকে বলেন, তদন্ত করছেন। শিগগির তাঁরা তদন্তের অগ্রগতি সংবাদমাধ্যমকে জানাতে পারবেন।

সিসিটিভি ফুটেজে যা দেখা গেল
আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে ঘটনার দিনের ৭টি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের এসব ফুটেজে ভুক্তভোগীর স্বামী, বহিরাগত মামুন, ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজ, শিক্ষার্থী মুরাদসহ অন্যদের কখনো একা, কখনো দু-তিনজনকে একসঙ্গে বারবার হলে ঢুকতে-বেরোতে দেখা যায়।

একটি ফুটেজে রাত ১০টা ৪৩ মিনিটের দিকে হলের সামনের রাস্তা থেকে হল অফিসের পাশের মোড়ে ভুক্তভোগীর স্বামীকে দেখা যায় মুরাদের সঙ্গে। তখন ভুক্তভোগী পাশের চায়ের দোকানের দিক থেকে এসে স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মোস্তাফিজ তাঁদের দিকে এগিয়ে আসেন। একপর্যায়ে ভুক্তভোগীর স্বামীকে মারতে শুরু করেন মোস্তাফিজ। ধাক্কাতে ধাক্কাতে তাঁকে হল অফিসের পাশে নিয়ে যান। এরপর ভুক্তভোগী ও তাঁর স্বামী হলসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের দিকে যান। তাঁদের পেছনে দুজন শিক্ষার্থীকে দৌড়ে যেতে দেখা যায়।

রাত ১টা ১২ মিনিটের আরেক ফুটেজে দুজন শিক্ষার্থীকে হলের ডাইনিংয়ের রান্নাঘরের পেছনের দরজার তালা ভেঙে ফেলতে দেখা যায়। এর ৫ মিনিট পর মোস্তাফিজ দরজা খুলে হলের পেছনের জঙ্গলের দিকে দৌড় দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার প্রধান সুদীপ্ত শাহীন (ডেপুটি রেজিস্ট্রার) আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাত ২টার সময় ভুক্তভোগীসহ পুলিশ সদস্যরা ক্যাম্পাসে আসেন। তার আগেই মোস্তাফিজ পালিয়ে যান। তখন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মোস্তাফিজকে যাঁরা পালাতে সহায়তা করেন, তাঁদের আটক করা হয়। এরপর পুলিশকে নিয়ে ভুক্তভোগী ধর্ষণের স্থানে যান।

প্রক্টর ও প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি
জাবি প্রতিনিধি জানান, ধর্ষণের ঘটনায় গতকালও ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ এনে তাঁদের পদত্যাগ দাবি করেছেন।

দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘নিপীড়নবিরোধী মঞ্চ’-এর ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পারভীন জলি বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে ধর্ষণের মামলাটি করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা কোনো মামলা করেনি, শুধু একটা জিডি করেছে।’

প্রক্টর-প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ চেয়ে এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘ধর্ষককে যারা পালাতে সাহায্য করেছে, তারা ছাত্রলীগের কর্মী ছিল। কিন্তু প্রক্টর মোস্তাফিজকে খুঁজে আনতে পাঠিয়েছিলেন দুজন ছাত্রলীগের কর্মীকে। তাহলে প্রক্টরিয়াল টিমের কাজ কী? প্রভোস্টও তাঁর দায় এড়াতে পারেন না। আমরা তাঁর শাস্তি চাই। তাঁর স্বপদে থাকার কোনো অধিকার নেই।’

মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী, ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ ভূঁইয়া, অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান, অধ্যাপক রায়হান রাইন, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম প্রমুখ।

আরও পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত