এ কে এম শামসুদ্দিন
গত ১৫ এপ্রিল সুদানে সংঘাত শুরু হওয়ার পর সে দেশের প্রায় ১ লাখ নাগরিক দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশে পাড়ি জমিয়েছে। ৭ লাখের মতো নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশের অভ্যন্তরেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন। শুধু সুদানের নাগরিকই নন, সেখানে অন্যান্য দেশের নাগরিক এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত স্টাফরাও সুদান ত্যাগ করছেন।
সে দেশে আটকে পড়া আনুমানিক দেড় হাজার বাংলাদেশি নাগরিকের মধ্যে ১৩৬ জনের একটি দল ইতিমধ্যেই সৌদি আরবের জেদ্দা হয়ে দেশে এসে পৌঁছেছে।আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আরও ৫৫২ জন দেশে ফিরবে। জানা গেছে, যেসব বাংলাদেশি নাগরিকের সুদানে ব্যবসা ও বাণিজ্য আছে, তাঁদের অনেকেই এই মুহূর্তে সুদান ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা সংঘাতময় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পরবর্তী সময়ে সুদান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেবেন বলে অনুমান করা যাচ্ছে।
সুদান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান এবং সে দেশের আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফের প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে এই সহিংসতার শুরু। ১৫ এপ্রিল এই সংঘাত শুরু হওয়ার পর পাঁচ শতাধিক মানুষ মারা গেছে এবং সাড়ে চার হাজারের বেশি আহত হয়েছে। সুদানের দুই জেনারেলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বেশ কিছুদিন ধরেই চলে আসছিল। কিন্তু আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করা হলে কে ওই সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান হবেন, কে কার অধীনে কাজ করবেন—এমন কিছু ইস্যু নিয়ে তাঁদের মধ্যে প্রথমে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব একসময় সংঘাতে পরিণত হয়। এই সংঘাত অতি দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সুদানের এই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেশটিকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ সংঘর্ষ শুরুর আগেও এ দুই জেনারেলের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। এই দুজন সম্মিলিতভাবে ২০১৯ সালে সুদানের সাবেক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন। ২০২১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে বুরহান ও দাগালো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশের অভ্যন্তরীণ শাসন পরিচালনার জন্য ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল (টিএমসি) গঠন করে। বুরহানকে টিএমসির প্রধান করা হয়।এই কাউন্সিল দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য কাজ করতে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়, তা বাস্তবায়নের জন্য দেশটির রাজনৈতিক দল ও বেসামরিক সংগঠন তাদের টিএমসসিতে অন্তর্ভুক্ত করতে দাবি জানাতে থাকে।
আন্তর্জাতিক মহল থেকেও এ ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ আসে। শেষ পর্যন্ত টিএমসি ভেঙে দিয়ে গঠন করা হয় একটি সার্বভৌম পর্ষদ (এসসি)। সামরিক-বেসামরিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গঠিত এই পর্ষদ ২০১৯ সাল থেকে সুদান পরিচালনা করে আসছিল। এই সার্বভৌম পর্ষদের প্রধান করা হয় জেনারেল বুরহানকে। পর্ষদের উপনেতা করা হয় আরএসএফের প্রধান জেনারেল দাগালোকে। সার্বভৌম পর্ষদের নেতা হিসেবে বুরহান কার্যত সুদানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে যান।
কিন্তু দেশ পরিচালনার কিছুদিনের মধ্যেই বেসামরিক ব্যক্তিদের সঙ্গে জেনারেলদের মতপার্থক্য দেখা দেয়। ফলে দিন দিন সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ফলে ২০২১ সালে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকারব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর ২০২২ সালের মধ্যে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির এক চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
চুক্তি স্বাক্ষর হলে কী হবে? তাদের ভেতর পুনরায় মতবিরোধ শুরু হলে সেই সমঝোতাও চূড়ান্ত রূপ লাভ করতে পারেনি। এর পর থেকেই বুরহান ও দাগালোর মধ্যে বিরোধ তীব্র হতে থাকে। যে বিষয়টি বিরোধের একেবারে কেন্দ্রে চলে আসে তা হলো, আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তের পরিকল্পনা। একপর্যায়ে দাগালো আরএসএফের সশস্ত্র সদস্যদের দেশের বিভিন্ন অংশে মোতায়েন করেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি সুদানের সেনাবাহিনী। তারা এই ব্যবস্থাকে তাদের জন্য হুমকি হিসেবে ধরে নেয়। ফলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই উত্তেজনা অবসানে তাদের মধ্যে আলোচনাও শুরু হয়েছিল। তাতে আশা করা গিয়েছিল যে এই আলোচনার মধ্য দিয়ে হয়তো সমাধানের কোনো উপায় বেরিয়ে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। অতএব উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়; যা এখনো অব্যাহত আছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দেশটিতে এত দিন ধরে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, এই সংঘাতের ফলে তা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে জানতে হলে সুদানের অতীতের কিছু ঘটনার আলোকপাত করা প্রয়োজন। উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদানের আয়তন ১৮ লাখ ৮৬ হাজার ৬৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৪৮ হাজার। দেশটিতে সুন্নি মুসলমানের সংখ্যাই বেশি। মুসলমানরা আবার দুই ভাগে বিভক্ত। স্থানীয় বা নুবিয়ান মুসলমান এবং আরব বংশোদ্ভূত মুসলমান। সুদান পেট্রোলিয়াম ও খনিজ তেলসমৃদ্ধ দেশ। তেল ছাড়াও প্রাকৃতিক গ্যাস, সোনা, রুপা, জিপসাম, জিঙ্ক, লোহা, সিসা, ইউরেনিয়াম, কপার, গ্রানাইট, নিকেল, তামাসহ গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ সুদান। সুদানের ইতিহাস ও সভ্যতা মিসরীয় সভ্যতার ইতিহাসের চেয়ে অনেক প্রাচীন।
ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর চিরাচরিত ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির শিকার হয়ে সুদানের ঐক্য বিনষ্ট হয়। ১৯২৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসকেরা সুদানকে উত্তর-দক্ষিণ সুদানে বিভক্ত করে শাসন করেন। ব্রিটিশ শাসনের সময়েই উত্তর ও দক্ষিণ অংশে বিভেদের বীজ বপন করা হয়েছিল। সুদান প্রায় শত বছরের ওপর ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়; ফলে ১৯৫৬ সালে সুদান স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটিশরা সুদান ছেড়ে যাওয়ার আগেই দেশটিকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা আঁটে। সুদান ছেড়ে যাওয়ার আগে ১৯৫৫ সালে ব্রিটিশদের ইন্ধনেই খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধ বেধে যায়, যা ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চলে। গৃহযুদ্ধের একপর্যায় ১৯৭২ সালে দক্ষিণ সুদান স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। পরে ১৯৮৩ সালে সামরিক জান্তা জাফর নিমেরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সুদানে ফেডারেল সরকার ও ইসলামি আইন চালুর উদ্যোগ নিলে দক্ষিণ সুদানে পুনরায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের মদদে; এর পরই স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিণত হয় স্বাধীনতার দাবিতে। এই গৃহযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষে প্রায় ২০ লাখ মানুষ নিহত হয় এবং বাস্তুহারা হয় প্রায় ৫০ লাখ। শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২০১১ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতা লাভ করে।
২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হলে অধিকাংশ তেলক্ষেত্র হারায় সুদান। ফলে সুদানের অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপে পড়ে। দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশ কমে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০১৮ সালে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য সুদানের মুদ্রার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করা হয়। রুটি ও জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমানোর পরিণতিতে সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড চাপে পড়ে যায়। দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও অসন্তোষ শুরু হয়। তখন দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন একনায়ক শাসক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির। শেষ পর্যন্ত বশির ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
এ অবস্থায় সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ৬ মে সৌদি আরবের জেদ্দায় সুদানের সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বৈঠক শুরু হয়। এই বৈঠক যে ফলপ্রসূ হবে না, তা আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। যুদ্ধ বন্ধের এই সংলাপ চলাকালেও সুদানের রাজধানী খার্তুমে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। এই সংলাপের উদ্দেশ্য ছিল উভয় পক্ষের মধ্যে যে মতপার্থক্য আছে, তা মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত একটা লম্বা সময়ের জন্য যুদ্ধবিরতি পালন করা, যাতে সুদানের নাগরিকদের জন্য খাদ্য, ওষুধপত্র ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পৌঁছে দেওয়া যায়। সৌদি ও যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ প্রত্যাশিত ফল আনতে পারেনি।
সুদানে শান্তি ফিরিয়ে আনা ছাড়া এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। সুদানের এই সংঘাত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপরও প্রভাব ফেলছে। এই দেশগুলোও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুব বেশি উন্নত নয়। তার ওপর সুদানি শরণার্থীদের যদি আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে এর চাপ সেই সব দেশের ওপর পড়তে বাধ্য। দক্ষিণ সুদানের জন্যও এ পরিস্থিতি সুখকর নয়। কারণ, তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে দক্ষিণ সুদান সম্পূর্ণভাবে সুদানের অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। জ্বালানি তেল রপ্তানি হলো দক্ষিণ সুদানের অর্থ উপার্জনের মূল বা প্রধান উৎস। তা ছাড়া, রিজিওনাল সিকিউরিটি, টেররিজমের বিরুদ্ধে লড়াই ও ক্রস বর্ডার অর্গানাইজড ক্রাইমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে সুদানে শান্তি ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি। তবে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিবদমান দুই জেনারেলের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে, সুদানে শিগগিরই শান্তি ফিরে আসবে—তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট
গত ১৫ এপ্রিল সুদানে সংঘাত শুরু হওয়ার পর সে দেশের প্রায় ১ লাখ নাগরিক দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশে পাড়ি জমিয়েছে। ৭ লাখের মতো নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশের অভ্যন্তরেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন। শুধু সুদানের নাগরিকই নন, সেখানে অন্যান্য দেশের নাগরিক এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত স্টাফরাও সুদান ত্যাগ করছেন।
সে দেশে আটকে পড়া আনুমানিক দেড় হাজার বাংলাদেশি নাগরিকের মধ্যে ১৩৬ জনের একটি দল ইতিমধ্যেই সৌদি আরবের জেদ্দা হয়ে দেশে এসে পৌঁছেছে।আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আরও ৫৫২ জন দেশে ফিরবে। জানা গেছে, যেসব বাংলাদেশি নাগরিকের সুদানে ব্যবসা ও বাণিজ্য আছে, তাঁদের অনেকেই এই মুহূর্তে সুদান ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা সংঘাতময় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পরবর্তী সময়ে সুদান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেবেন বলে অনুমান করা যাচ্ছে।
সুদান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান এবং সে দেশের আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফের প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে এই সহিংসতার শুরু। ১৫ এপ্রিল এই সংঘাত শুরু হওয়ার পর পাঁচ শতাধিক মানুষ মারা গেছে এবং সাড়ে চার হাজারের বেশি আহত হয়েছে। সুদানের দুই জেনারেলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বেশ কিছুদিন ধরেই চলে আসছিল। কিন্তু আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করা হলে কে ওই সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান হবেন, কে কার অধীনে কাজ করবেন—এমন কিছু ইস্যু নিয়ে তাঁদের মধ্যে প্রথমে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব একসময় সংঘাতে পরিণত হয়। এই সংঘাত অতি দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সুদানের এই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেশটিকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ সংঘর্ষ শুরুর আগেও এ দুই জেনারেলের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। এই দুজন সম্মিলিতভাবে ২০১৯ সালে সুদানের সাবেক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন। ২০২১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে বুরহান ও দাগালো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশের অভ্যন্তরীণ শাসন পরিচালনার জন্য ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল (টিএমসি) গঠন করে। বুরহানকে টিএমসির প্রধান করা হয়।এই কাউন্সিল দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য কাজ করতে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়, তা বাস্তবায়নের জন্য দেশটির রাজনৈতিক দল ও বেসামরিক সংগঠন তাদের টিএমসসিতে অন্তর্ভুক্ত করতে দাবি জানাতে থাকে।
আন্তর্জাতিক মহল থেকেও এ ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ আসে। শেষ পর্যন্ত টিএমসি ভেঙে দিয়ে গঠন করা হয় একটি সার্বভৌম পর্ষদ (এসসি)। সামরিক-বেসামরিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গঠিত এই পর্ষদ ২০১৯ সাল থেকে সুদান পরিচালনা করে আসছিল। এই সার্বভৌম পর্ষদের প্রধান করা হয় জেনারেল বুরহানকে। পর্ষদের উপনেতা করা হয় আরএসএফের প্রধান জেনারেল দাগালোকে। সার্বভৌম পর্ষদের নেতা হিসেবে বুরহান কার্যত সুদানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে যান।
কিন্তু দেশ পরিচালনার কিছুদিনের মধ্যেই বেসামরিক ব্যক্তিদের সঙ্গে জেনারেলদের মতপার্থক্য দেখা দেয়। ফলে দিন দিন সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ফলে ২০২১ সালে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকারব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর ২০২২ সালের মধ্যে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির এক চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
চুক্তি স্বাক্ষর হলে কী হবে? তাদের ভেতর পুনরায় মতবিরোধ শুরু হলে সেই সমঝোতাও চূড়ান্ত রূপ লাভ করতে পারেনি। এর পর থেকেই বুরহান ও দাগালোর মধ্যে বিরোধ তীব্র হতে থাকে। যে বিষয়টি বিরোধের একেবারে কেন্দ্রে চলে আসে তা হলো, আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তের পরিকল্পনা। একপর্যায়ে দাগালো আরএসএফের সশস্ত্র সদস্যদের দেশের বিভিন্ন অংশে মোতায়েন করেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি সুদানের সেনাবাহিনী। তারা এই ব্যবস্থাকে তাদের জন্য হুমকি হিসেবে ধরে নেয়। ফলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই উত্তেজনা অবসানে তাদের মধ্যে আলোচনাও শুরু হয়েছিল। তাতে আশা করা গিয়েছিল যে এই আলোচনার মধ্য দিয়ে হয়তো সমাধানের কোনো উপায় বেরিয়ে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। অতএব উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়; যা এখনো অব্যাহত আছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দেশটিতে এত দিন ধরে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, এই সংঘাতের ফলে তা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে জানতে হলে সুদানের অতীতের কিছু ঘটনার আলোকপাত করা প্রয়োজন। উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদানের আয়তন ১৮ লাখ ৮৬ হাজার ৬৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৪৮ হাজার। দেশটিতে সুন্নি মুসলমানের সংখ্যাই বেশি। মুসলমানরা আবার দুই ভাগে বিভক্ত। স্থানীয় বা নুবিয়ান মুসলমান এবং আরব বংশোদ্ভূত মুসলমান। সুদান পেট্রোলিয়াম ও খনিজ তেলসমৃদ্ধ দেশ। তেল ছাড়াও প্রাকৃতিক গ্যাস, সোনা, রুপা, জিপসাম, জিঙ্ক, লোহা, সিসা, ইউরেনিয়াম, কপার, গ্রানাইট, নিকেল, তামাসহ গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ সুদান। সুদানের ইতিহাস ও সভ্যতা মিসরীয় সভ্যতার ইতিহাসের চেয়ে অনেক প্রাচীন।
ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর চিরাচরিত ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির শিকার হয়ে সুদানের ঐক্য বিনষ্ট হয়। ১৯২৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসকেরা সুদানকে উত্তর-দক্ষিণ সুদানে বিভক্ত করে শাসন করেন। ব্রিটিশ শাসনের সময়েই উত্তর ও দক্ষিণ অংশে বিভেদের বীজ বপন করা হয়েছিল। সুদান প্রায় শত বছরের ওপর ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়; ফলে ১৯৫৬ সালে সুদান স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটিশরা সুদান ছেড়ে যাওয়ার আগেই দেশটিকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা আঁটে। সুদান ছেড়ে যাওয়ার আগে ১৯৫৫ সালে ব্রিটিশদের ইন্ধনেই খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধ বেধে যায়, যা ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চলে। গৃহযুদ্ধের একপর্যায় ১৯৭২ সালে দক্ষিণ সুদান স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। পরে ১৯৮৩ সালে সামরিক জান্তা জাফর নিমেরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সুদানে ফেডারেল সরকার ও ইসলামি আইন চালুর উদ্যোগ নিলে দক্ষিণ সুদানে পুনরায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের মদদে; এর পরই স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিণত হয় স্বাধীনতার দাবিতে। এই গৃহযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষে প্রায় ২০ লাখ মানুষ নিহত হয় এবং বাস্তুহারা হয় প্রায় ৫০ লাখ। শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২০১১ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতা লাভ করে।
২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হলে অধিকাংশ তেলক্ষেত্র হারায় সুদান। ফলে সুদানের অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপে পড়ে। দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশ কমে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০১৮ সালে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য সুদানের মুদ্রার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করা হয়। রুটি ও জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমানোর পরিণতিতে সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড চাপে পড়ে যায়। দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও অসন্তোষ শুরু হয়। তখন দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন একনায়ক শাসক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির। শেষ পর্যন্ত বশির ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
এ অবস্থায় সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ৬ মে সৌদি আরবের জেদ্দায় সুদানের সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বৈঠক শুরু হয়। এই বৈঠক যে ফলপ্রসূ হবে না, তা আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। যুদ্ধ বন্ধের এই সংলাপ চলাকালেও সুদানের রাজধানী খার্তুমে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। এই সংলাপের উদ্দেশ্য ছিল উভয় পক্ষের মধ্যে যে মতপার্থক্য আছে, তা মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত একটা লম্বা সময়ের জন্য যুদ্ধবিরতি পালন করা, যাতে সুদানের নাগরিকদের জন্য খাদ্য, ওষুধপত্র ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পৌঁছে দেওয়া যায়। সৌদি ও যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ প্রত্যাশিত ফল আনতে পারেনি।
সুদানে শান্তি ফিরিয়ে আনা ছাড়া এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। সুদানের এই সংঘাত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপরও প্রভাব ফেলছে। এই দেশগুলোও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুব বেশি উন্নত নয়। তার ওপর সুদানি শরণার্থীদের যদি আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে এর চাপ সেই সব দেশের ওপর পড়তে বাধ্য। দক্ষিণ সুদানের জন্যও এ পরিস্থিতি সুখকর নয়। কারণ, তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে দক্ষিণ সুদান সম্পূর্ণভাবে সুদানের অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। জ্বালানি তেল রপ্তানি হলো দক্ষিণ সুদানের অর্থ উপার্জনের মূল বা প্রধান উৎস। তা ছাড়া, রিজিওনাল সিকিউরিটি, টেররিজমের বিরুদ্ধে লড়াই ও ক্রস বর্ডার অর্গানাইজড ক্রাইমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে সুদানে শান্তি ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি। তবে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিবদমান দুই জেনারেলের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে, সুদানে শিগগিরই শান্তি ফিরে আসবে—তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে