দেশের যেকোনো ক্রীড়া সংস্থার তুলনায় পেশাদারিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) যে সবচেয়ে এগিয়ে, এটাতে দ্বিমত করার সুযোগ কম। পেশাদারিতে তারা অনেক উন্নতি করেছে বলেই ক্রিকেটের তুমুল জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে ‘হতদরিদ্র’ এক ক্রীড়া সংস্থা থেকে গত দুই দশকে দেশের তো বটেই, ক্রিকেট বিশ্বেরই অন্যতম ধনী বোর্ডে পরিণত হয়েছে বিসিবি।

আর্থিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার পথে বিসিবির ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতেও এসেছে বড় পরিবর্তন। বেশির ভাগ স্থায়ী কমিটিতে সংগঠকদের ভূমিকা কমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে করপোরেট সংস্কৃতি, যেখানে মূলত ম্যানেজাররাই বিসিবির কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। যতই মনে হোক, পেশাদারির জায়গায় দেশের অন্য ক্রীড়া সংস্থার তুলনায় তারা অনেক এগিয়েছে, কখনো কখনো সেই ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেন স্বয়ং বোর্ড কর্তারাই। 

তামিম ইকবালের আকস্মিক অবসরের ঘটনা থেকে গতকাল নাজমুল হাসান পাপনের নতুন অধিনায়কের নাম ঘোষণা—প্রতিটি জায়গায় বিসিবির পেশাদারি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। তামিমের অবসরের ইস্যু এতটাই জটিল হয়ে গেল, সেটির সমাধান এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। পরে তামিম অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিলেন বিসিবি সভাপতির গুলশানের এক বাসভবনের পার্কিং এরিয়ায়। ফেসবুকে যেটি ট্রল হচ্ছে ‘পাপনের গ্যারেজ’ বলে। এই গ্যারেজেই বড় বড় সব সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়েছে গত এক দশকে। কেউ কেউ রসিকতা করে তাই বলেন, ‘বুম ধরলেই বোম!’  

গতকাল আরেকটি ‘বুম ধরলে বোমা’ ফেটেছে দেশের ক্রিকেটে। বিসিবির পরিকল্পনা ছিল ১২ আগস্ট অর্থাৎ আজ সকালে অধিনায়ক ও দল ঘোষণা করার। বৃহস্পতিবার রাতে এমনটা জানিয়েছিলেন ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুসও। শুক্রবার ছুটির দিনে ‘এক্সট্রা ঝামেলা’ এড়িয়ে কর্মদিবসে বড় ঘোষণা দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গেল গতকাল দুপুরে। 

সাকিব আল হাসানই হচ্ছেন এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের অধিনায়ক—নামটা অনুমিত হলেও বিসিবি সভাপতির এই আকস্মিক ঘোষণায় তবু বিস্ময় থাকল। হঠাৎ এভাবে, একটা পার্কিং এরিয়ায় এত বড় ঘোষণা—বিশ্বের আর কোন ক্রিকেট দেশে দেখা যায় এই ছবি? ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা ঠিক নয়। উপমহাদেশের ক্রিকেট বোর্ডগুলো যেহেতু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত, সেটি বিবেচনায় নিয়েই প্রশ্নটা করছি, ভারত-শ্রীলঙ্কাতেও কি এই দৃশ্যের নিয়মিত দেখা মেলে? 

দেখা মেলে না আরও অনেক দৃশ্যেরই, যেটা বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিয়মিত ছবি। এই যে কদিন আগে আইসিসির ট্রফি নিয়ে  ক্রিকেটার থেকে শুরু করে বোর্ড কর্মকর্তাদের ছবি তোলার ধুম, এটাও তো দেখা যায়নি অন্য বোর্ডগুলোয়। তারাও তোলে, তবে সেটি ট্রফি জেতে। ট্রফির সঙ্গে বোর্ড পরিচালকদের তোলা ছবি নিয়েও সামাজিক মাধ্যমে কম ট্রল হয়নি। এভাবেই ক্রিকেটের নানা ক্ষেত্রে পেশাদারি মনোভাব অটুট থাকে না বলেই কদিন পরপর আগুনে হাওয়া বয়ে যায় বাংলাদেশ দলে। ড্রেসিংরুমে গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয় নানা ঘটনার ঘনঘটায়।

এখানে অনেকে সংবাদমাধ্যমেরও দায় দেখেন। সংবাদমাধ্যম চেষ্টা করবেই বোর্ডের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিস্ফোরক মন্তব্য কিংবা সিদ্ধান্ত জানার। কিন্তু বোর্ডকেই তো এখানে পেশাদারি মনোভাবে সামলাতে হয় সবকিছু। সেটি তারা যে সামলাতে পারে না, অতীতে যেমন দেখা গেছে; সামনেও হয়তো দেখা যাবে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের নতুন অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে এই চ্যালেঞ্জটাও নিতে হবে।

অবশ্য সাকিব এসবে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের অন্য অধিনায়কের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এখানেই, বাকিরা অনেক সময় বিচলিত হয়ে পড়েন, ভেঙে পড়েন। তিনি এসবে তোয়াক্কা করেন না। এবার তিনি কতটা অবিচল থেকে সফল হতে পারেন, সেটিই দেখার।