ড. মইনুল ইসলাম
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২ সালের জুন মাসের শেষে কত দাঁড়াচ্ছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণায় রিজার্ভ হয়তো ৪১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে থাকবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এই ঘোষণা গ্রহণযোগ্য মনে করে না। কারণ, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) নাম দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকারের আদেশে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের ‘রিফাইনেন্সিং স্কিমের’ অধীনে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রভাবশালী রপ্তানিকারকদের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়েছে, সেটাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত না করতে বলেছে আইএমএফ। তার মানে, বাংলাদেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।
সরকার যে তথ্যটা জনগণ থেকে লুকাতে চাইছে তা হলো, এই সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার অবয়বে আর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যেহেতু ঋণগ্রহীতা রপ্তানিকারকেরা ওই ইডিএফ ঋণের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় তাঁদের রপ্তানি আয় ঋণদানকারী ব্যাংককে ফেরত দিচ্ছেন না, তাই প্রায় সব ব্যাংকেই ওই ইডিএফ লোন ‘ফোর্সড লোনে’ পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে। তার মানে, এই ইডিএফ লোন মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ইডিএফের নামে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের পুঁজি পাচারের এহেন সহজ হাতিয়ার আমাদের সরকার কর্তৃক উপহার দেওয়ার কাহিনি দেশবাসীকে জানানো আমাদের কর্তব্য মনে করি।
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ঋণের ব্যাপারটি আরেকটু খোলাসা করা যাক। ইডিএফের ঋণ দেওয়া হয় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে। রপ্তানিকারকেরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও একসেসরিজ আমদানির এল/সির বিপরীতে এই ঋণের বৈদেশিক মুদ্রা দেশীয় ব্যাংকের সঙ্গে বিদেশি ব্যাংকের লেনদেনে অন্তর্ভুক্ত করার কথা।
রপ্তানি পণ্যের মূল্য বৈদেশিক মুদ্রায় পাওয়া গেলে ওই ঋণগ্রহীতার তাঁর দেশীয় ব্যাংককে সুদাসলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ফেরত দেওয়ার কথা। ফেরত পেলে তারপর ওই ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রায় ওই ঋণের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংককে ফেরত দেবে, এটাই নিয়ম। এই প্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ করলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের রিজার্ভ ইডিএফ ঋণের কারণে না কমারই কথা! এর জন্য সর্বোচ্চ ২৭০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এই সময়সীমার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ব্যাংকে ফেরত না এলে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ওই বাণিজ্যিক ব্যাংকের নামে ঋণটাকে ‘ফোর্সড লোনে’ পরিণত করে। ফলে, দেশীয় টাকায় ঋণের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত এলেও বৈদেশিক মুদ্রায় ফেরত আসবে না।
অভিযোগ রয়েছে যে আমাদের দেশের রপ্তানিকারকদের বৃহদংশই তাঁদের রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ দেশে ফেরত আনছেন না। তাঁরা এই বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে বিভিন্ন দেশে ঘরবাড়ি, ব্যবসাপাতি, অ্যাপার্টমেন্ট কিনছেন। বেগম সাহেব এবং পরিবারের সদস্যরা বিদেশের সেই ঘরবাড়িতে বসবাস করছেন, ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করছে, সাহেবও কিছুদিন পরপর বিদেশের বাড়িতে বেড়িয়ে আসছেন। ঈদুল ফিতর-ঈদুল আজহায় সবাই দেশে এসে উৎসবে শরিক হচ্ছেন, আত্মীয়-স্বজনের বিয়েশাদিতে অংশ নিচ্ছেন।
এভাবেই গড়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, ইতালি, ফ্রান্স, দুবাই এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি পুঁজি পাচারকারীদের রমরমা বসতি। কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের ‘সেকেন্ড হোম’ ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ‘বাংলাদেশি ফ্রেটারনিটি’ এভাবেই বহুল পরিচিতি অর্জন করেছে। টরন্টোর কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ‘বেগমপাড়া’ গড়ে ওঠেনি, কোনো এলাকার নামও ‘বেগমপাড়া’ দেওয়া হয়নি। ওই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের পুঁজি পাচারকারীরা বাজার দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে ঘরবাড়ি কিনে বেগম সাহেবাসহ তাঁদের পরিবারের বসবাসের ব্যবস্থা করে চলেছেন। ফলে টরন্টোর রিয়েল এস্টেটের বাজারে হু হু করে মূল্যস্ফীতি ঘটে চলেছে। মিডিয়ায় এই ইস্যু নিয়ে হইচই শুরু হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কানাডার সরকারকে বিষয়টির প্রতি কড়া নজর দিতে হয়েছে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে। এখন সরকারের নানা এজেন্সি থেকে প্রশ্ন করা হচ্ছে পাচার করা অর্থের ব্যাপারে, টরন্টোর বাংলাদেশি কমিউনিটির পক্ষ থেকেও এই পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নাকি প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে।
টরন্টোর বেগমপাড়ায় বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা দেশের আমদানিকারক ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং রাজনীতিবিদদের টপকে সবচেয়ে বড় মালিকগোষ্ঠীর দাবিদার হতে পারে বলে একটা সাধারণ ধারণা গড়ে উঠেছে। রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এ দেশের বহুল প্রচলিত সমস্যা। এর সঙ্গে রয়েছে রপ্তানিকারকেরা, তাঁদের রপ্তানি আয়ের একাংশ বিদেশে রেখে দেওয়ার পুরোনো সমস্যা। খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, যেসব রপ্তানিকারক এই দুটো পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার করছেন কিংবা তাঁদের রপ্তানি আয়ের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ফেরত আনছেন না, তাঁরাই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ইডিএফের লোন বাগিয়ে নিচ্ছেন।
ওই লোনের অর্থও যে বিদেশে পাচার হয়ে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? অতএব, কার মাথা থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এভাবে ‘রিফাইনেন্সিং স্কিমের’ অধীনে ঋণ হিসেবে ইডিএফ লোন দেওয়ার মতলবটা বেরিয়ে এসেছিল, তা জানা প্রয়োজন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। এর মাধ্যমে দেশ থেকে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা যে বিদেশে পাচার হয়ে গেল, তার দায়ভার তো শেষ বিচারে তাঁকেই নিতে হবে! বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের এহেন তছরুপ কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকই মেনে নিতে পারেন না।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কাউকে ঋণ না দেওয়ার জন্য আমরা অনেকেই বহুদিন ধরে সরকারকে সাবধান করে দিচ্ছিলাম, কিন্তু ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রবল স্ফীতি প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো প্রণোদিত করেছে ইডিএফের মতো কর্মসূচি শুরু করতে। কেউ কেউ বলেছেন, বর্তমানে রিজার্ভ যেভাবে জমা রাখা হয় তাতে ওখান থেকে নামকাওয়াস্তে সুদ পাওয়া যায়, ঋণ দিলে তার চেয়ে বেশি সুদ পাওয়া যাবে। এহেন ভুয়া যুক্তি দিয়ে হয়তো তাঁর সম্মতি আদায় করা গেছে! এখন ২০২২ সালে যখন বাণিজ্য ঘাটতির বেলাগাম বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় রিজার্ভের দ্রুত পতন শুরু হয়েছে, তাতে অর্থনীতি অদূর ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। ভারতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
কিন্তু সেখানে তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কাউকে বা কোনো গোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়ার দাবি উঠছে না! আমাদের দেশে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পরই রিজার্ভ থেকে দেশে-বিদেশে ঋণ প্রদানের জন্য আমাদের সরকারের নীতিপ্রণেতারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন? বিপদের দিনে অর্থনীতিতে যাতে কোনো বিপর্যয় নেমে না আসে, তার রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা পালন করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সে জন্যই রিজার্ভের বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অর্থনীতির জন্য আস্থার প্রতীক এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভ মাত্র ১ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে ‘প্যানিক’ সৃষ্টি হয়েছিল, এ কথা আমরা ভুলে গেলাম কেন?
বর্তমান ৩৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ অনেকের কাছে এখনো স্বস্তিদায়ক মনে হতে পারে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী চলমান ভয়ংকর মূল্যস্ফীতি সংকট ক্রমহ্রাসমান রিজার্ভ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করাই স্বাভাবিক। ইতিমধ্যেই আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানা পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি শ্লথ করা যাচ্ছে কি না কিংবা থামানো যাচ্ছে কি না, সেটাই আমাদের নীতিপ্রণেতাদের জন্য ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হয়ে দাঁড়াবে। জ্বালানি তেল, এলএনজি, গম, চাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতির যে আগুন লেগেছে, সেটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হলে সহজে নিভবে না, জাহাজভাড়ার উল্লম্ফনও থামবে না। এর সঙ্গে অচিরেই যোগ হতে যাচ্ছে বিশ্বমন্দা।
মন্দার কারণে যদি আমাদের পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যায় কিংবা থেমে যায়, তাহলে অর্থনীতি মহাবিপদে পড়বে। অতএব, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারা সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দিতে হবে। এই পর্যায়ে আমাদের অর্থনৈতিক নীতিপ্রণেতাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত ৩৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভকে আগামী বছর আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়ে আনা। তাহলেই অর্থনীতিতে আবার স্বস্তি ফিরে আসবে। আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি ব্যয়ের যে স্ফীতি ঘটে চলেছে, সে ব্যাপারে সরকারের তেমন কিছু করার নেই, কিন্তু কম-প্রয়োজনীয় আমদানির আইটেম কাটছাঁট করে কিংবা শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করতেই হবে।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২ সালের জুন মাসের শেষে কত দাঁড়াচ্ছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণায় রিজার্ভ হয়তো ৪১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে থাকবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এই ঘোষণা গ্রহণযোগ্য মনে করে না। কারণ, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) নাম দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকারের আদেশে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের ‘রিফাইনেন্সিং স্কিমের’ অধীনে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রভাবশালী রপ্তানিকারকদের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়েছে, সেটাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত না করতে বলেছে আইএমএফ। তার মানে, বাংলাদেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।
সরকার যে তথ্যটা জনগণ থেকে লুকাতে চাইছে তা হলো, এই সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার অবয়বে আর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যেহেতু ঋণগ্রহীতা রপ্তানিকারকেরা ওই ইডিএফ ঋণের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় তাঁদের রপ্তানি আয় ঋণদানকারী ব্যাংককে ফেরত দিচ্ছেন না, তাই প্রায় সব ব্যাংকেই ওই ইডিএফ লোন ‘ফোর্সড লোনে’ পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে। তার মানে, এই ইডিএফ লোন মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ইডিএফের নামে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের পুঁজি পাচারের এহেন সহজ হাতিয়ার আমাদের সরকার কর্তৃক উপহার দেওয়ার কাহিনি দেশবাসীকে জানানো আমাদের কর্তব্য মনে করি।
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ঋণের ব্যাপারটি আরেকটু খোলাসা করা যাক। ইডিএফের ঋণ দেওয়া হয় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে। রপ্তানিকারকেরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও একসেসরিজ আমদানির এল/সির বিপরীতে এই ঋণের বৈদেশিক মুদ্রা দেশীয় ব্যাংকের সঙ্গে বিদেশি ব্যাংকের লেনদেনে অন্তর্ভুক্ত করার কথা।
রপ্তানি পণ্যের মূল্য বৈদেশিক মুদ্রায় পাওয়া গেলে ওই ঋণগ্রহীতার তাঁর দেশীয় ব্যাংককে সুদাসলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ফেরত দেওয়ার কথা। ফেরত পেলে তারপর ওই ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রায় ওই ঋণের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংককে ফেরত দেবে, এটাই নিয়ম। এই প্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ করলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের রিজার্ভ ইডিএফ ঋণের কারণে না কমারই কথা! এর জন্য সর্বোচ্চ ২৭০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এই সময়সীমার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ব্যাংকে ফেরত না এলে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ওই বাণিজ্যিক ব্যাংকের নামে ঋণটাকে ‘ফোর্সড লোনে’ পরিণত করে। ফলে, দেশীয় টাকায় ঋণের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত এলেও বৈদেশিক মুদ্রায় ফেরত আসবে না।
অভিযোগ রয়েছে যে আমাদের দেশের রপ্তানিকারকদের বৃহদংশই তাঁদের রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ দেশে ফেরত আনছেন না। তাঁরা এই বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে বিভিন্ন দেশে ঘরবাড়ি, ব্যবসাপাতি, অ্যাপার্টমেন্ট কিনছেন। বেগম সাহেব এবং পরিবারের সদস্যরা বিদেশের সেই ঘরবাড়িতে বসবাস করছেন, ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করছে, সাহেবও কিছুদিন পরপর বিদেশের বাড়িতে বেড়িয়ে আসছেন। ঈদুল ফিতর-ঈদুল আজহায় সবাই দেশে এসে উৎসবে শরিক হচ্ছেন, আত্মীয়-স্বজনের বিয়েশাদিতে অংশ নিচ্ছেন।
এভাবেই গড়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, ইতালি, ফ্রান্স, দুবাই এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি পুঁজি পাচারকারীদের রমরমা বসতি। কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের ‘সেকেন্ড হোম’ ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ‘বাংলাদেশি ফ্রেটারনিটি’ এভাবেই বহুল পরিচিতি অর্জন করেছে। টরন্টোর কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ‘বেগমপাড়া’ গড়ে ওঠেনি, কোনো এলাকার নামও ‘বেগমপাড়া’ দেওয়া হয়নি। ওই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের পুঁজি পাচারকারীরা বাজার দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে ঘরবাড়ি কিনে বেগম সাহেবাসহ তাঁদের পরিবারের বসবাসের ব্যবস্থা করে চলেছেন। ফলে টরন্টোর রিয়েল এস্টেটের বাজারে হু হু করে মূল্যস্ফীতি ঘটে চলেছে। মিডিয়ায় এই ইস্যু নিয়ে হইচই শুরু হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কানাডার সরকারকে বিষয়টির প্রতি কড়া নজর দিতে হয়েছে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে। এখন সরকারের নানা এজেন্সি থেকে প্রশ্ন করা হচ্ছে পাচার করা অর্থের ব্যাপারে, টরন্টোর বাংলাদেশি কমিউনিটির পক্ষ থেকেও এই পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নাকি প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে।
টরন্টোর বেগমপাড়ায় বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা দেশের আমদানিকারক ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং রাজনীতিবিদদের টপকে সবচেয়ে বড় মালিকগোষ্ঠীর দাবিদার হতে পারে বলে একটা সাধারণ ধারণা গড়ে উঠেছে। রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এ দেশের বহুল প্রচলিত সমস্যা। এর সঙ্গে রয়েছে রপ্তানিকারকেরা, তাঁদের রপ্তানি আয়ের একাংশ বিদেশে রেখে দেওয়ার পুরোনো সমস্যা। খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, যেসব রপ্তানিকারক এই দুটো পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার করছেন কিংবা তাঁদের রপ্তানি আয়ের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ফেরত আনছেন না, তাঁরাই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ইডিএফের লোন বাগিয়ে নিচ্ছেন।
ওই লোনের অর্থও যে বিদেশে পাচার হয়ে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? অতএব, কার মাথা থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এভাবে ‘রিফাইনেন্সিং স্কিমের’ অধীনে ঋণ হিসেবে ইডিএফ লোন দেওয়ার মতলবটা বেরিয়ে এসেছিল, তা জানা প্রয়োজন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। এর মাধ্যমে দেশ থেকে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা যে বিদেশে পাচার হয়ে গেল, তার দায়ভার তো শেষ বিচারে তাঁকেই নিতে হবে! বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের এহেন তছরুপ কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকই মেনে নিতে পারেন না।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কাউকে ঋণ না দেওয়ার জন্য আমরা অনেকেই বহুদিন ধরে সরকারকে সাবধান করে দিচ্ছিলাম, কিন্তু ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রবল স্ফীতি প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো প্রণোদিত করেছে ইডিএফের মতো কর্মসূচি শুরু করতে। কেউ কেউ বলেছেন, বর্তমানে রিজার্ভ যেভাবে জমা রাখা হয় তাতে ওখান থেকে নামকাওয়াস্তে সুদ পাওয়া যায়, ঋণ দিলে তার চেয়ে বেশি সুদ পাওয়া যাবে। এহেন ভুয়া যুক্তি দিয়ে হয়তো তাঁর সম্মতি আদায় করা গেছে! এখন ২০২২ সালে যখন বাণিজ্য ঘাটতির বেলাগাম বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় রিজার্ভের দ্রুত পতন শুরু হয়েছে, তাতে অর্থনীতি অদূর ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। ভারতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
কিন্তু সেখানে তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কাউকে বা কোনো গোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়ার দাবি উঠছে না! আমাদের দেশে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পরই রিজার্ভ থেকে দেশে-বিদেশে ঋণ প্রদানের জন্য আমাদের সরকারের নীতিপ্রণেতারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন? বিপদের দিনে অর্থনীতিতে যাতে কোনো বিপর্যয় নেমে না আসে, তার রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা পালন করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সে জন্যই রিজার্ভের বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অর্থনীতির জন্য আস্থার প্রতীক এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভ মাত্র ১ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে ‘প্যানিক’ সৃষ্টি হয়েছিল, এ কথা আমরা ভুলে গেলাম কেন?
বর্তমান ৩৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ অনেকের কাছে এখনো স্বস্তিদায়ক মনে হতে পারে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী চলমান ভয়ংকর মূল্যস্ফীতি সংকট ক্রমহ্রাসমান রিজার্ভ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করাই স্বাভাবিক। ইতিমধ্যেই আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানা পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি শ্লথ করা যাচ্ছে কি না কিংবা থামানো যাচ্ছে কি না, সেটাই আমাদের নীতিপ্রণেতাদের জন্য ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হয়ে দাঁড়াবে। জ্বালানি তেল, এলএনজি, গম, চাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতির যে আগুন লেগেছে, সেটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হলে সহজে নিভবে না, জাহাজভাড়ার উল্লম্ফনও থামবে না। এর সঙ্গে অচিরেই যোগ হতে যাচ্ছে বিশ্বমন্দা।
মন্দার কারণে যদি আমাদের পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যায় কিংবা থেমে যায়, তাহলে অর্থনীতি মহাবিপদে পড়বে। অতএব, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারা সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দিতে হবে। এই পর্যায়ে আমাদের অর্থনৈতিক নীতিপ্রণেতাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত ৩৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভকে আগামী বছর আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়ে আনা। তাহলেই অর্থনীতিতে আবার স্বস্তি ফিরে আসবে। আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি ব্যয়ের যে স্ফীতি ঘটে চলেছে, সে ব্যাপারে সরকারের তেমন কিছু করার নেই, কিন্তু কম-প্রয়োজনীয় আমদানির আইটেম কাটছাঁট করে কিংবা শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করতেই হবে।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে