Ajker Patrika

সিন্ডিকেটের কালো হাত আর কত দিন

মামুনুর রশীদ
সিন্ডিকেটের কালো হাত আর কত দিন

পৃথিবীর কোথাও কোনো উৎসবে এ রকম লক্ষ-কোটি মানুষ বাড়ি ফেরে কি না, আমার জানা নেই। তা-ও একা নয়, সপরিবারে। ট্রেন, বাস, লঞ্চে উঠছে মানুষ, শুধু মানুষ। দুটি ঈদে একই অবস্থা। আসলে এ হচ্ছে ফেরা। ঘরে ফেরা শুধু নয়, শিকড়ে ফেরা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে, এমনকি পাশের দেশের বাঙালিরা বড় কোনো ছুটি পেলে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা কাশ্মীর, হিমালয়, সিমলা ঘুরে আসে আর যারা অত দূর যেতে পারে না, তাদের জন্য নিদেনপক্ষে দীঘা হলেও হয়। কিন্তু গ্রামে যাওয়ার ব্যাপারটা নেই। তারপর খরচের দিকেও কোনো নজর থাকে না। বেতন-বোনাস নিঃশেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত টনক নড়ছে না। পরবর্তী মাসগুলোতে বেশ কষ্ট। তবু তোয়াক্কা নেই। 

রাজধানী শহর অথবা বড় শহরগুলোতে মানুষের নিতান্তই জীবিকার জন্য থাকা, কিন্তু আসল ঘর ওই গ্রামেই। আজকাল অবশ্য গ্রামগুলো দিন দিন শহরের চেহারা নিচ্ছে। তবুও একটা প্রাচীন অথবা নতুন বাজার আছে। চায়ের দোকান, দোকানে আবার অনবরত টেলিভিশন চলছে। এখন আলোচনার বিষয়বস্তু সব জায়গাতেই আগামী নির্বাচন। নির্বাচনই একমাত্র গণতন্ত্র, একমাত্র রাজনীতি।

যা-ই হোক, যে উত্তেজনা শুরু হয় ঈদের ছুটির আগ থেকে, তা পাঁচ-ছয় দিনের মাথায় কাজে ফেরার মধ্য দিয়ে স্তিমিত হতে থাকে। এবার ঘরে ফেরার বিষয়টি দেখা যাক। আমার এক বন্ধু প্রতি ঈদেই গ্রামে যায়। তার গ্রামটাও বেশি দূরে নয়, ঢাকা থেকে সব মিলে একেবারে ঘর পর্যন্ত ১৪০ কিলোমিটার। যেতে হয় তাকে বাসে, বাস ছাড়ে মহাখালী থেকে। এবার প্রবল বৃষ্টি। তাই খুব ভোরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। একটু দেরিতেই যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। সঙ্গের ভাইটিরও নানা কারণেই দেরি হয়ে গেল। বেলা ১২টার দিকে মহাখালীতে গাড়ির প্রবল জটলা। এর মধ্যে জানা গেল দ্রুতগামী বাসগুলোতে টিকিট নেই। লোকাল বাসে যেতে হবে। গাড়ি নেই, তবে বেলা ২টার আগে আসার সম্ভাবনা নেই। অগত্যা অপেক্ষা। বসার জায়গা নেই, দাঁড়িয়ে, হাঁটাহাঁটি করে কালক্ষেপণ। ২টার বাস আসতে আসতে আরও দেরি হয়ে গেল। স্বাভাবিক দিনগুলোতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের ভাড়া দুই শ টাকা। ঈদের সময় সেই ভাড়া গিয়ে দাঁড়ায় পাঁচ শ টাকায়। কিন্তু মহাখালী থেকে গাড়ি বের হওয়ার পরেই এই ভাড়া বাড়তে শুরু করে। চৌরাস্তা থেকে ভাড়া বেড়ে গিয়ে এক হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠে এবং কোনো রকম বসার সিটের নিশ্চয়তা ছাড়া। ছোট ছোট মোড়া বসিয়ে দেয় সিটের ফাঁকে ফাঁকে। এরপর ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে সপরিবারে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, সেখানেও ভাড়া পাঁচ শ টাকা। লোকাল বাসগুলো পারলে প্রতিটি গ্রামেই থামে, মহাখালী থেকে রওনা দিয়ে ময়মনসিংহ গিয়ে পৌঁছায় রাত ১০টায়। সেখান থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় ১২টা বেজে যায়।

এ তো গেল কাছাকাছি দূরত্বের কথা। কিন্তু যাদের বাড়ি প্রান্তিক জেলায়, অর্থাৎ পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও কিংবা দিনাজপুর, তাদের এই ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। ফিরতি পথেও সমস্যা একই রকম, তবু ঘরে ফেরা চাই। শেষ পর্যন্ত অনেকেরই বাড়ি ফেরা হয় না, দুর্ঘটনায় মৃত্যু এমনিতেই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা আর ঈদের সময় তো কথাই নেই। আগে যাত্রীরা ট্রেনের ছাদের ওপর উঠে যেত। গত বছর এবং এ বছর এ রকমটা দেখা যায়নি। সরকার বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে কিন্তু পরিস্থিতির এমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

তবে এবার যেসব জায়গায় রাস্তা প্রশস্ত হয়েছে, সেই সব জায়গায় অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এই যে ঈদের সময় দ্রব্যমূল্য, পরিবহন খরচের বাড়াবাড়ি, এতে একটি কথা খুবই চালু হয়েছে, তা হলো—সিন্ডিকেট। বাসের মালিক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা সবাই মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। আমরা সিন্ডিকেটকে জেনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে, যেখানে শিক্ষা, নিয়োগ সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাবিষয়ক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সিন্ডিকেটের প্রয়োগ এখন সর্বত্র। একেবারে নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষও কথায় কথায় সিন্ডিকেট শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণবিরোধী কোনো তৎপরতাকেও সিন্ডিকেট বলা হয়।

সিন্ডিকেট এখন রিকশাওয়ালাদের ভাড়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। সেই সঙ্গে সিএনজি, বাস, লঞ্চ ইত্যাদির ভাড়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ঐক্য প্রচেষ্টাকে সিন্ডিকেট বলে অভিহিত করা হয়, দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে তো আছেই। এই সিন্ডিকেটের হোতারা একটি উদ্দেশ্যেই নিবেদিত তা হলো, দ্রুত টাকা উপার্জন এবং তার জন্য সবচেয়ে মোক্ষম সময় হলো ঈদ। কল্পনা করা যায় যে কাঁচা মরিচের কেজি হাজার টাকা হয়ে গেল আবার তা দ্রুতই দেড় শ টাকায় নেমে এল! বাঙালির খাদ্যে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ লাগেই, কাজেই এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা সহজ। কী অদ্ভুত ব্যাপার, ভারতীয় সীমান্তে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজের আমদানি করা ট্রাক ঢুকছে শুনেই দাম কমে যাচ্ছে। আবার যাত্রী চলাচল কমে গেলে আগের ভাড়ায় ফিরে যায়। আগের ভাড়া ও দ্রব্যমূল্যও কম নয়, যা সিন্ডিকেটেরই অবদান।

আমাদের সংসদে এই সিন্ডিকেট নিয়ে বহুবার আলোচনা হয়েছে। সরকারি দলের সদস্যরা বলছেন যে সবই তাঁদের মন্ত্রীদের কারবার, তাঁরা নিজেরাও এর সঙ্গে জড়িত থাকেন। এ কথাও বলছেন যে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী এবং বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী এই সিন্ডিকেট সম্পর্কে শুধু অবহিতই নন, জড়িত। কারণ দুজনই ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরা কখনো নিজের স্বার্থ ভুলে গিয়ে জনগণের স্বার্থ দেখবেন, এটা আশা করা যায় না। জনগণের একটা অংশ যদিও তা সংখ্যালঘিষ্ঠ, তাদের পক্ষে যেকোনো পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্য সহনীয়। তারা যেভাবে আয় করে, সেভাবেই তারা ব্যয় করে থাকে। অতএব এ ক্ষেত্রে তাদের কিছুই গায়ে লাগে না। উপজেলা থেকে খোদ সচিবালয় পর্যন্ত আমলা ও সহযোগীদের কোনো অসুবিধা হয় না। একটি মাস যদি শুধু বেতনের অর্থে তাদের চলতে হয় (এমনকি বেতন দ্বিগুণ হওয়ার পরেও), তাহলে তারা বুঝতে পারত মানুষ কী অবস্থায় আছে।

মন্ত্রী-রাজনীতিবিদদের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে শুধুই নির্বাচন। দ্রব্যমূল্য, পরিবহন ব্যয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য—এসব তাদের কর্মসূচির মধ্যে নেই। ক্ষীণ কণ্ঠে মাঝে মাঝে বাম দলগুলো এসব কথা বলে থাকে, কিন্তু তাদেরও তৃণমূল পর্যায়ে কোনো কাজকর্ম নেই। ফলে সরকার প্রতিবাদহীন অবস্থায় খুব সুখে দেশ চালিয়ে যাচ্ছে। দুদক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ঘুমিয়েই থাকে।

বর্তমানে খুব ছোটখাটো বিষয়েও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ব্যতীত কোনো কিছু সম্ভব নয়—কলাবাগানের মাঠ বা ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের গাছ কাটা পর্যন্ত। এহেন পরিস্থিতিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত সব ব্যবস্থাকে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই; বরং তাদের অভিজ্ঞতায় রয়েছে যে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হয় না। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে দিন-রাত এসব কথা বলা হচ্ছে, তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ সিন্ডিকেট শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নয়, একেবারে তৃণমূল পর্যায়েও বিরাট ক্ষমতা নিয়ে বসে আছে। বরং যাদের ন্যূনতম ক্ষমতা আছে, তারা সরকারি দলের অনুগ্রহ পিপাসু। ছোট একটা পদ বা যেকোনো প্রকারে নির্বাচিত প্রতিনিধি হতে পারলে বিপুল অর্থ সমাগম হয়। তাদের সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রতিদিনই উত্থানের ইতিহাস প্রকাশিত হচ্ছে। কদর্যময় সেই ইতিহাসের মধ্যে রয়েছে ঠিকাদার, বালুখেকো ও ভূমিদস্যুদের জীবনী। মানুষ চোখের সামনে তাদের বিলাসবহুল জীবন যাপন দেখছে, অর্থ পাচারের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনাও চলছে। কিন্তু সেখানেও কোনো কার্যকারিতা লক্ষ করা যাচ্ছে না।

ফেসবুকের পোস্টে দেখলাম, এক ভদ্রলোক লিখেছেন, যখন কোনো জিনিসের দাম বাড়ে, তখন তিনি ওই জিনিস খাওয়া বন্ধ করে দেন। তারপর যখন ওই পণ্যে পচন ধরা দেয়, দাম কমতে থাকে, তখন সেটা তিনি কেনেন। এভাবেই সাশ্রয়ী তত্ত্বে তিনি বেঁচে থাকেন। বাঙালি সাশ্রয় করে নিজেকে কষ্ট দেয়, অধিকার প্রয়োগ করতে অক্ষম; বরং মেনে নেওয়াকে একটি অমোঘ সত্য হিসেবে ধরে নিয়েছে। তবু ঈদযাত্রায় সে প্রাণ দেবে, ঘরে ফিরতেই হবে—পরিবার নিয়ে ভীষণ কষ্ট করে বাড়ি যাবে এবং ফিরে আসবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে ঘরে বসে হাহাকার করবে, কিন্তু কোনো সংঘবদ্ধ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হবে না, এই পরিস্থিতিতে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে আর কত দিন?

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান হওয়া ইরানি নারী এখন পানামার জঙ্গলে

ঢাবি ছাত্রীকে যৌন হেনস্তাকারীর পক্ষে নামা ‘তৌহিদী জনতার’ আড়ালে এরা কারা

বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা হলেই মেয়াদ শেষ নতুন পরিচালনা কমিটির

এনসিপিকে চাঁদা দিচ্ছেন ধনীরা, ক্রাউডফান্ডিং করেও অর্থ সংগ্রহ করা হবে: নাহিদ ইসলাম

ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান, সন্তানসহ ছিটকে পড়তেই তরুণীর গালে ছুরিকাঘাত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত