কুদরত-ই-গুল
পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর পরলোকগত হওয়ার পর নানামুখী দেনার দায় ঠাকুর পরিবারের ঘাড়ে চাপে। এ জন্য বেশ কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয়। এমনকি কিছু আসবাবও বিক্রি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বাবা। কিন্তু জমিদারি ক্ষয়ে যায়নি তখনো। নানাবিধ কারণে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের ছোট ছেলেকে বেছে নিলেন শিলাইদহের জমিদারি দেখভাল করার জন্য; যা শুনে ঠাকুর পরিবারের অনেকে অবাক বনে যান। কবিস্বভাবের এই যুবক কীভাবে জমিদারির মতো গুরুতর ঝামেলা সামাল দেবেন! কিন্তু বাড়ির অভিভাবকের কথাই শিরোধার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হলেন। ৩০০ টাকা মাসোহারায় বাবার কথামতো স্ত্রী, দুই ছেলে এবং তিন মেয়েসহ সোজা চলে এলেন শিলাইদহে। মজার ব্যাপার এই ৩০০ টাকায় রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী সংসার চালিয়ে উদ্বৃত্ত টাকা স্বামীর বই কেনার জন্য গুছিয়ে রাখতেন। অনেকের ধারণা হতে পারে, জমিদারি চালান, ফলে নিজের ইচ্ছামতো টাকা খরচের সুযোগ থাকার কথা। কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। কারণ, বাবাকে কড়ায়গন্ডায় হিসাব দিতে হতো। যদিও রবীন্দ্রনাথ জমিদারির খরচ মিটিয়ে বেশ লাভের মুখ দেখাতে পেরেছিলেন।
অর্থনৈতিক আয়-উন্নতি ছাড়াও শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের জন্য আশীর্বাদের মতোই ছিল বলা যায়। এখানেই ঘটে তাঁর বহুমুখী সত্তার উদ্বোধন। বিষয়টা যেন এমন, ‘আমি এসেছি তবে কি শেষে/ কোন সবুজ দ্বীপেরও দেশে।’ এখানে এসে তাঁর সাহিত্যের শাখা-প্রশাখা পল্লবিত হলো, ফুলে-ফলে ভরে উঠল সৃষ্টির বাগান। এখানে থাকতেই তিনি পুরোদমে ‘সাধনা’ এবং ‘ভারতী’ পত্রিকায় লেখাসহ সম্পাদনার কাজ চালিয়ে গেছেন। কবিতা, ছোটগল্প, গান, প্রবন্ধ এবং ছিন্নপত্রের নানা চিঠি তিনি লিখেছেন অবলীলায়। এখানেই তিনি নিবিড় পরিবেশে, একান্তে করেছিলেন গীতাঞ্জলির সফল অনুবাদ; অর্থাৎ সাহিত্যিক হিসেবে বিকাশের একটা বড় অবদান এই শিলাইদহ দাবি করতেই পারে। আর পেয়েছিলেন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর একান্ত সুযোগ। এর ভেতর দিয়ে উন্মোচিত হয় রবীন্দ্রসত্তার নানা দিক। পরিবেশ সাহিত্যিক সত্তার পাশাপাশি ব্যক্তিসত্তা উন্মোচনের যে দারুণ এক অনুষঙ্গ হতে পারে, তা রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহে আগমন এবং বাস এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তই বটে।
শিলাইদহে তিনি সন্তানদের ডানপিটেমিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন অবলীলায়। তিনি মনে করতেন ইন্দ্রিয়চর্চার জন্য যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ানো, ঘোড়ায় চড়া, মাছধরা, নৌকা বাওয়া, লাঠি-সড়কি খেলা, সাঁতার কাটা, ঘর গোছানো, রান্নায় সহযোগিতা করা ইত্যাদি বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ নিজেও ভালো সাঁতার কাটতেন। তিনি গড়াই নদে এপার-ওপার অনায়াসে সাঁতার কাটতেন। এ ছাড়া শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী রোববার কাজের লোকদের ছুটি দিতেন। কারণ তিনি ঘরের সব কাজ সন্তানদের দিয়ে করাতেন। রান্নার কাজে সহায়তা করার জন্য তাঁদের প্রস্তুত করতেন। এতে ছিল রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ সমর্থন। এতে করে তারা যেন স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। প্রসঙ্গত, একটু মনোযোগ দিলেই বোঝা যায়, শহরের ছেলেমেয়েদের চেয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের ইন্দ্রিয়ানুভূতি তুলনামূলকভাবে প্রবল হয়। কারণ, ব্যতিক্রমহীনভাবে তারা ওই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই বেড়ে ওঠে। এখানে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর দূরদর্শিতার নজরানা দিতেই হয়। এটাকে তিনি শিক্ষার অন্যতম অঙ্গ মনে করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই ঘরে বেশি দিন থাকতে পারতেন না। তাই তাঁর জন্য অস্থায়ী ঘর বানানোর নানা কথা চাউর আছে। শান্তিনিকেতনে তাঁর থাকার জন্য নানা ঘরের কথা সবারই জানা। তিনি শিলাইদহের কুঠিবাড়িতেও বেশি দিন থাকতেন না। শীত পড়লেই সপরিবারে চলে যেতেন পদ্মার বালুচরে। যেন শীতের পাখি। রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রে পদ্মা সম্পর্কে বলছেন, ‘ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত, আমার তেমনি পদ্মা—আমার যথার্থ বাহন।’ যেখানে নির্জনতায় ঠাসা ধু-ধু বালুচর, চখাচখি পাখির খেলা, নদীর শান্ত-স্নিগ্ধ জলধারা, শীতল বাতাস আর ওপরে বিস্তীর্ণ আকাশ। সেখানে সঙ্গে থাকত দুটি ঢাকাই বজরা; যা ছিল ঘরের মতোই। থাকত বাড়ির মতো সব রকম সুযোগ-সুবিধা। সঙ্গে থাকত কয়েকটি জলিবোট। পদ্মাবোট তো ছিল নিত্যসঙ্গী; যা রবীন্দ্রসাহিত্যে এক বটবৃক্ষের সমান সহায়ক হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
চাকরদের জন্য থাকত চরের ওপর উলুখড় দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঘর। তিনি ছিন্নপত্রে নদী এবং তার চারপাশের বর্ণনা দেওয়ার সময় লিখেছেন, ‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়।’ এ ছাড়া নদীর ক্ষীণধারা আর বিস্তীর্ণ বালুরাশি এসব দেখে কবি মুগ্ধ হয়ে চিঠিতে লিখছেন, ‘জগৎসংসারে এ যে কী মহৎ আশ্চর্য ঘটনা, তা এখানে থাকলে বোঝা যায়।’ প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস, জীবনকে নির্মোহভাবে উদ্যাপন ও উপভোগ করার যে তরিকা, তা সত্যিই বিরল। তাঁর বাসা পরিবর্তনের মাধ্যমে চিন্তার নতুন নতুন জানালা গিয়েছে খুলে। বহুমুখী চিন্তার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে থেকেছেন চূড়ান্তভাবে যুক্ত; অর্থাৎ দেখেছেন চোখ দিয়ে, উপলব্ধি করেছেন অন্তর দিয়ে। এই দুইয়ের মিশেলে লিখে গেছেন অনর্গল। রবীন্দ্রনাথের সার্বক্ষণিক ইন্দ্রিয়গত এই প্রবল বোঝাপড়া ছিল বলেই তাঁর সৃষ্টিকর্ম অনন্য হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ এই নিভৃত এলাকায় থাকা সত্ত্বেও তাঁর বন্ধুর অভাব হয়নি। এখানে আসতেন ডি এল রায়, রাজশাহীর জেলা জজ, নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল মজুমদার, স্যার জগদীশচন্দ্র বসুসহ নানা গুণীজন। নিশ্চয় সেই বন্ধুরা ‘বাঙালির ম্যাড়মেড়ে আড্ডা’য় মশগুল থাকতেন না। তাঁরা সিরিয়াস আড্ডা দিতেন। তাঁদের আড্ডার বিষয় থাকত সাহিত্য, সংগীত, বিজ্ঞান, রাজনীতিসহ নানা বিষয়। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু প্রতি শনিবার এসে দুই রাত কাটিয়ে আবার সোমবারে কলেজের উদ্দেশে চলে যেতেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে একটি করে নতুন গল্পের বায়না করতেন। আর সপ্তাহান্তে একটি করে গল্প তাঁকে লিখতে হতো। এ রকম উত্তম বন্ধুর দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথের ছিল; যা বন্ধুত্বের ইতিহাসে এক দারুণ উদাহরণই বটে। ইতিহাস ঘাঁটলে চোখে পড়ে আমরা কিংবদন্তির মতো যা জানি তা হলো, ব্যতিক্রমহীনভাবে জমিদার মানেই জলসাঘর, নর্তকীর নৃত্য, নেশায় চুর হয়ে থাকা, ভোগ-বিলাসিতা আর অত্যাচার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এর সব ফরম্যাটের বাইরে জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন। এটা নানাজনের বর্ণনা থেকে আন্দাজ করা যায়। রবীন্দ্রনাথ সন্ধ্যায় জলিবোট নিয়ে পদ্মায় মাঝনদীতে নোঙর ফেলতেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু যাঁরা সাহিত্যে-সংগীতে সমঝদার, তাঁদেরসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেশ রাত পর্যন্ত গানের আসর জমাতেন। রবীন্দ্রনাথ স্বরচিত গান গাইতেন আবার অন্যকে দিয়েও গাওয়াতেন। এটা জমিদারেরই ঢং, কিন্তু সৃষ্টিশীল চেতনার এক অনন্য প্রকাশই বটে।
এ ছাড়া কখনো কখনো লেখা শুরু করলে রাত-দিন একাকার করে ফেলতেন। তিনি স্ত্রীকে বলতেন, ‘আমাকে খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি কোরো না।’ যেন তাঁর ‘এক হাতে থাকত বেত অন্য হাতে কলম’ কোনো রকম আলস্য এলে তাকে বেত দিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিতেন। এভাবে তিনি শিলাইদহের সময় অতিবাহিত করেছিলেন। অন্যদিকে শিলাইদহেই নিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় বই। যেন ছোটখাটো একটা লাইব্রেরি। এর মধ্যে থাকত গ্যটে, তুর্গিয়েনেভ, বালজাক, মোপাসাঁ, ওয়াল্ট হুইটম্যানসহ প্রভৃতি সাহিত্য, অমরকোষ ও সংস্কৃত বই। সাহিত্য ছাড়াও তিনি সঙ্গে রাখতেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞানের মতো দুর্বোধ্য বিষয়ের মোটা মোটা বই। এটা দিয়ে রবীন্দ্রনাথের পাঠের রুচির খবর পাওয়া যায়।
তাঁর বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথের বর্ণনায় এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে আমরা আবিষ্কার করি এই শিলাইদহে; যা সচরাচর দেখা যায় না। রথীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘দিনের শেষে সন্ধ্যার মুখে বাবা ও আমি বোটের ডেকে দুটি আরাম চেয়ারে বসে আছি। বাবার চেয়ার ডেকের ধারে ঘেঁষে জলের খুব কাছাকাছি পাতা। উনি যেমন চুপ করে বসে থাকলে পা নাচান, তেমনি পা দুলিয়ে চলছেন। জলে একটা ছোট্ট কিছু ফেলে দিলে যেমন শব্দ হয়, হঠাৎ তেমনি একটা শব্দ শুনতে পেলুম। বাবার দিকে চেয়ে দেখি ওঁর পা থেকে বহু পুরাতন অতিপ্রিয় কট্কি চটির একটা পাটি জলে পড়ে গেছে। ঝপাং করে জলে আর একটা হলো, চেয়ে দেখি বাবা ডেকে নেই, জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন চটিটাকে তুলে আনতে। স্রোতের টানে চটি অনেক দূর ভেসে গেছে—বাবা সাঁতার কেটে তাকে ধরবার চেষ্টা করছেন। অনেকক্ষণ বাদে জল থেকে উঠে এলেন—মুখে তৃপ্তির হাসি, হাতে চটির সেই পাটিটি।’ এই রবীন্দ্রনাথ আসলে জমিদার রবীন্দ্রনাথ নন, জটিল বিষয়ে শুধু ডুবে থাকা রবীন্দ্রনাথ নন। এই ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের ভেতর এক শিশু রবীন্দ্রনাথ বাস করত। সবকিছুর ঊর্ধ্বে এটি কবিসত্তার একটা রূপই বটে।
এর বাইরে নিয়মিত প্রজাদের দরবার করতেন। তারা যে সব সময় নালিশ নিয়ে হাজির হতো, তা নয়। ঘরের কথা, সুখ-দুঃখের কথাও ভাগাভাগি করত। তাদের মধ্যে নানামুখী বিবাদ মেটানোর জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সমাধানের ব্যবস্থা করতেন এবং তাদের সাধ্যের মধ্যে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। রবীন্দ্রনাথ যে কোমল হৃদয়ের ছিলেন, তার আঁচ পাওয়া যায় তাঁর এলাকায় কোনো প্রকার পাখি শিকার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে। এমনকি ইংরেজরা পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিল। একবার তিনি নদীর কিনারে রাতে পদ্মাবোটে অবস্থানকালে চখাচখির কান্না সহ্য করতে না পেরে অন্যত্র বোট সরিয়ে নিয়ে যান। হয়তো চখাচখির একটিকে কেউ হত্যা করেছিল। এ বিষয়গুলো অনেকের কাছে মামুলি মনে হলেও এটা দিয়ে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের সংবেদনশীলতা এবং স্পর্শকাতরতার অন্দরের খবরের পূর্বাভাস পাওয়া যায় বলে মনে করি।
শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনে যে এক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, এটা সন্দেহাতীত। এর মাধ্যমে শিলাইদহ যেমন ঐতিহাসিকভাবে হয়েছে স্মৃতিধন্য, তেমনি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির পথকে করেছে সহজ এবং সমৃদ্ধ। এই দেওয়া-নেওয়ার রসায়নের মধ্যে যে শিক্ষা আমরা অর্জন করি, তা কালের প্রবাহে অনন্য হয়ে থাকবে—এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর পরলোকগত হওয়ার পর নানামুখী দেনার দায় ঠাকুর পরিবারের ঘাড়ে চাপে। এ জন্য বেশ কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয়। এমনকি কিছু আসবাবও বিক্রি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বাবা। কিন্তু জমিদারি ক্ষয়ে যায়নি তখনো। নানাবিধ কারণে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের ছোট ছেলেকে বেছে নিলেন শিলাইদহের জমিদারি দেখভাল করার জন্য; যা শুনে ঠাকুর পরিবারের অনেকে অবাক বনে যান। কবিস্বভাবের এই যুবক কীভাবে জমিদারির মতো গুরুতর ঝামেলা সামাল দেবেন! কিন্তু বাড়ির অভিভাবকের কথাই শিরোধার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হলেন। ৩০০ টাকা মাসোহারায় বাবার কথামতো স্ত্রী, দুই ছেলে এবং তিন মেয়েসহ সোজা চলে এলেন শিলাইদহে। মজার ব্যাপার এই ৩০০ টাকায় রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী সংসার চালিয়ে উদ্বৃত্ত টাকা স্বামীর বই কেনার জন্য গুছিয়ে রাখতেন। অনেকের ধারণা হতে পারে, জমিদারি চালান, ফলে নিজের ইচ্ছামতো টাকা খরচের সুযোগ থাকার কথা। কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। কারণ, বাবাকে কড়ায়গন্ডায় হিসাব দিতে হতো। যদিও রবীন্দ্রনাথ জমিদারির খরচ মিটিয়ে বেশ লাভের মুখ দেখাতে পেরেছিলেন।
অর্থনৈতিক আয়-উন্নতি ছাড়াও শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের জন্য আশীর্বাদের মতোই ছিল বলা যায়। এখানেই ঘটে তাঁর বহুমুখী সত্তার উদ্বোধন। বিষয়টা যেন এমন, ‘আমি এসেছি তবে কি শেষে/ কোন সবুজ দ্বীপেরও দেশে।’ এখানে এসে তাঁর সাহিত্যের শাখা-প্রশাখা পল্লবিত হলো, ফুলে-ফলে ভরে উঠল সৃষ্টির বাগান। এখানে থাকতেই তিনি পুরোদমে ‘সাধনা’ এবং ‘ভারতী’ পত্রিকায় লেখাসহ সম্পাদনার কাজ চালিয়ে গেছেন। কবিতা, ছোটগল্প, গান, প্রবন্ধ এবং ছিন্নপত্রের নানা চিঠি তিনি লিখেছেন অবলীলায়। এখানেই তিনি নিবিড় পরিবেশে, একান্তে করেছিলেন গীতাঞ্জলির সফল অনুবাদ; অর্থাৎ সাহিত্যিক হিসেবে বিকাশের একটা বড় অবদান এই শিলাইদহ দাবি করতেই পারে। আর পেয়েছিলেন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর একান্ত সুযোগ। এর ভেতর দিয়ে উন্মোচিত হয় রবীন্দ্রসত্তার নানা দিক। পরিবেশ সাহিত্যিক সত্তার পাশাপাশি ব্যক্তিসত্তা উন্মোচনের যে দারুণ এক অনুষঙ্গ হতে পারে, তা রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহে আগমন এবং বাস এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তই বটে।
শিলাইদহে তিনি সন্তানদের ডানপিটেমিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন অবলীলায়। তিনি মনে করতেন ইন্দ্রিয়চর্চার জন্য যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ানো, ঘোড়ায় চড়া, মাছধরা, নৌকা বাওয়া, লাঠি-সড়কি খেলা, সাঁতার কাটা, ঘর গোছানো, রান্নায় সহযোগিতা করা ইত্যাদি বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ নিজেও ভালো সাঁতার কাটতেন। তিনি গড়াই নদে এপার-ওপার অনায়াসে সাঁতার কাটতেন। এ ছাড়া শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী রোববার কাজের লোকদের ছুটি দিতেন। কারণ তিনি ঘরের সব কাজ সন্তানদের দিয়ে করাতেন। রান্নার কাজে সহায়তা করার জন্য তাঁদের প্রস্তুত করতেন। এতে ছিল রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ সমর্থন। এতে করে তারা যেন স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। প্রসঙ্গত, একটু মনোযোগ দিলেই বোঝা যায়, শহরের ছেলেমেয়েদের চেয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের ইন্দ্রিয়ানুভূতি তুলনামূলকভাবে প্রবল হয়। কারণ, ব্যতিক্রমহীনভাবে তারা ওই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই বেড়ে ওঠে। এখানে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর দূরদর্শিতার নজরানা দিতেই হয়। এটাকে তিনি শিক্ষার অন্যতম অঙ্গ মনে করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই ঘরে বেশি দিন থাকতে পারতেন না। তাই তাঁর জন্য অস্থায়ী ঘর বানানোর নানা কথা চাউর আছে। শান্তিনিকেতনে তাঁর থাকার জন্য নানা ঘরের কথা সবারই জানা। তিনি শিলাইদহের কুঠিবাড়িতেও বেশি দিন থাকতেন না। শীত পড়লেই সপরিবারে চলে যেতেন পদ্মার বালুচরে। যেন শীতের পাখি। রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রে পদ্মা সম্পর্কে বলছেন, ‘ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত, আমার তেমনি পদ্মা—আমার যথার্থ বাহন।’ যেখানে নির্জনতায় ঠাসা ধু-ধু বালুচর, চখাচখি পাখির খেলা, নদীর শান্ত-স্নিগ্ধ জলধারা, শীতল বাতাস আর ওপরে বিস্তীর্ণ আকাশ। সেখানে সঙ্গে থাকত দুটি ঢাকাই বজরা; যা ছিল ঘরের মতোই। থাকত বাড়ির মতো সব রকম সুযোগ-সুবিধা। সঙ্গে থাকত কয়েকটি জলিবোট। পদ্মাবোট তো ছিল নিত্যসঙ্গী; যা রবীন্দ্রসাহিত্যে এক বটবৃক্ষের সমান সহায়ক হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
চাকরদের জন্য থাকত চরের ওপর উলুখড় দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঘর। তিনি ছিন্নপত্রে নদী এবং তার চারপাশের বর্ণনা দেওয়ার সময় লিখেছেন, ‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়।’ এ ছাড়া নদীর ক্ষীণধারা আর বিস্তীর্ণ বালুরাশি এসব দেখে কবি মুগ্ধ হয়ে চিঠিতে লিখছেন, ‘জগৎসংসারে এ যে কী মহৎ আশ্চর্য ঘটনা, তা এখানে থাকলে বোঝা যায়।’ প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস, জীবনকে নির্মোহভাবে উদ্যাপন ও উপভোগ করার যে তরিকা, তা সত্যিই বিরল। তাঁর বাসা পরিবর্তনের মাধ্যমে চিন্তার নতুন নতুন জানালা গিয়েছে খুলে। বহুমুখী চিন্তার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে থেকেছেন চূড়ান্তভাবে যুক্ত; অর্থাৎ দেখেছেন চোখ দিয়ে, উপলব্ধি করেছেন অন্তর দিয়ে। এই দুইয়ের মিশেলে লিখে গেছেন অনর্গল। রবীন্দ্রনাথের সার্বক্ষণিক ইন্দ্রিয়গত এই প্রবল বোঝাপড়া ছিল বলেই তাঁর সৃষ্টিকর্ম অনন্য হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ এই নিভৃত এলাকায় থাকা সত্ত্বেও তাঁর বন্ধুর অভাব হয়নি। এখানে আসতেন ডি এল রায়, রাজশাহীর জেলা জজ, নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল মজুমদার, স্যার জগদীশচন্দ্র বসুসহ নানা গুণীজন। নিশ্চয় সেই বন্ধুরা ‘বাঙালির ম্যাড়মেড়ে আড্ডা’য় মশগুল থাকতেন না। তাঁরা সিরিয়াস আড্ডা দিতেন। তাঁদের আড্ডার বিষয় থাকত সাহিত্য, সংগীত, বিজ্ঞান, রাজনীতিসহ নানা বিষয়। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু প্রতি শনিবার এসে দুই রাত কাটিয়ে আবার সোমবারে কলেজের উদ্দেশে চলে যেতেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে একটি করে নতুন গল্পের বায়না করতেন। আর সপ্তাহান্তে একটি করে গল্প তাঁকে লিখতে হতো। এ রকম উত্তম বন্ধুর দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথের ছিল; যা বন্ধুত্বের ইতিহাসে এক দারুণ উদাহরণই বটে। ইতিহাস ঘাঁটলে চোখে পড়ে আমরা কিংবদন্তির মতো যা জানি তা হলো, ব্যতিক্রমহীনভাবে জমিদার মানেই জলসাঘর, নর্তকীর নৃত্য, নেশায় চুর হয়ে থাকা, ভোগ-বিলাসিতা আর অত্যাচার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এর সব ফরম্যাটের বাইরে জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন। এটা নানাজনের বর্ণনা থেকে আন্দাজ করা যায়। রবীন্দ্রনাথ সন্ধ্যায় জলিবোট নিয়ে পদ্মায় মাঝনদীতে নোঙর ফেলতেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু যাঁরা সাহিত্যে-সংগীতে সমঝদার, তাঁদেরসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেশ রাত পর্যন্ত গানের আসর জমাতেন। রবীন্দ্রনাথ স্বরচিত গান গাইতেন আবার অন্যকে দিয়েও গাওয়াতেন। এটা জমিদারেরই ঢং, কিন্তু সৃষ্টিশীল চেতনার এক অনন্য প্রকাশই বটে।
এ ছাড়া কখনো কখনো লেখা শুরু করলে রাত-দিন একাকার করে ফেলতেন। তিনি স্ত্রীকে বলতেন, ‘আমাকে খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি কোরো না।’ যেন তাঁর ‘এক হাতে থাকত বেত অন্য হাতে কলম’ কোনো রকম আলস্য এলে তাকে বেত দিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিতেন। এভাবে তিনি শিলাইদহের সময় অতিবাহিত করেছিলেন। অন্যদিকে শিলাইদহেই নিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় বই। যেন ছোটখাটো একটা লাইব্রেরি। এর মধ্যে থাকত গ্যটে, তুর্গিয়েনেভ, বালজাক, মোপাসাঁ, ওয়াল্ট হুইটম্যানসহ প্রভৃতি সাহিত্য, অমরকোষ ও সংস্কৃত বই। সাহিত্য ছাড়াও তিনি সঙ্গে রাখতেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞানের মতো দুর্বোধ্য বিষয়ের মোটা মোটা বই। এটা দিয়ে রবীন্দ্রনাথের পাঠের রুচির খবর পাওয়া যায়।
তাঁর বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথের বর্ণনায় এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে আমরা আবিষ্কার করি এই শিলাইদহে; যা সচরাচর দেখা যায় না। রথীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘দিনের শেষে সন্ধ্যার মুখে বাবা ও আমি বোটের ডেকে দুটি আরাম চেয়ারে বসে আছি। বাবার চেয়ার ডেকের ধারে ঘেঁষে জলের খুব কাছাকাছি পাতা। উনি যেমন চুপ করে বসে থাকলে পা নাচান, তেমনি পা দুলিয়ে চলছেন। জলে একটা ছোট্ট কিছু ফেলে দিলে যেমন শব্দ হয়, হঠাৎ তেমনি একটা শব্দ শুনতে পেলুম। বাবার দিকে চেয়ে দেখি ওঁর পা থেকে বহু পুরাতন অতিপ্রিয় কট্কি চটির একটা পাটি জলে পড়ে গেছে। ঝপাং করে জলে আর একটা হলো, চেয়ে দেখি বাবা ডেকে নেই, জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন চটিটাকে তুলে আনতে। স্রোতের টানে চটি অনেক দূর ভেসে গেছে—বাবা সাঁতার কেটে তাকে ধরবার চেষ্টা করছেন। অনেকক্ষণ বাদে জল থেকে উঠে এলেন—মুখে তৃপ্তির হাসি, হাতে চটির সেই পাটিটি।’ এই রবীন্দ্রনাথ আসলে জমিদার রবীন্দ্রনাথ নন, জটিল বিষয়ে শুধু ডুবে থাকা রবীন্দ্রনাথ নন। এই ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের ভেতর এক শিশু রবীন্দ্রনাথ বাস করত। সবকিছুর ঊর্ধ্বে এটি কবিসত্তার একটা রূপই বটে।
এর বাইরে নিয়মিত প্রজাদের দরবার করতেন। তারা যে সব সময় নালিশ নিয়ে হাজির হতো, তা নয়। ঘরের কথা, সুখ-দুঃখের কথাও ভাগাভাগি করত। তাদের মধ্যে নানামুখী বিবাদ মেটানোর জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সমাধানের ব্যবস্থা করতেন এবং তাদের সাধ্যের মধ্যে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। রবীন্দ্রনাথ যে কোমল হৃদয়ের ছিলেন, তার আঁচ পাওয়া যায় তাঁর এলাকায় কোনো প্রকার পাখি শিকার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে। এমনকি ইংরেজরা পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিল। একবার তিনি নদীর কিনারে রাতে পদ্মাবোটে অবস্থানকালে চখাচখির কান্না সহ্য করতে না পেরে অন্যত্র বোট সরিয়ে নিয়ে যান। হয়তো চখাচখির একটিকে কেউ হত্যা করেছিল। এ বিষয়গুলো অনেকের কাছে মামুলি মনে হলেও এটা দিয়ে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের সংবেদনশীলতা এবং স্পর্শকাতরতার অন্দরের খবরের পূর্বাভাস পাওয়া যায় বলে মনে করি।
শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনে যে এক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, এটা সন্দেহাতীত। এর মাধ্যমে শিলাইদহ যেমন ঐতিহাসিকভাবে হয়েছে স্মৃতিধন্য, তেমনি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির পথকে করেছে সহজ এবং সমৃদ্ধ। এই দেওয়া-নেওয়ার রসায়নের মধ্যে যে শিক্ষা আমরা অর্জন করি, তা কালের প্রবাহে অনন্য হয়ে থাকবে—এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে